ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার জেরে উদ্ভূত মানবিক সংকট নিরসনে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে একটি প্রস্তাব আনা হয়েছে। বৃহস্পতিবার(২৪ মার্চ) অনুষ্ঠিত ভোটাভুটিতে এ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে বাংলাদেশ। ১৪০ ভোটে প্রস্তাবটি পাস হয়েছে। জাতিসংঘের ওয়েবসাইট থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
ইউক্রেনের পক্ষ থেকে অধিবেশনে প্রস্তাবটি উত্থাপন করা হয়। এতে ইউক্রেনের বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা এবং মানবিক সহায়তার সুযোগ দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। একইসঙ্গে রুশ হামলার ফলে দেশটিতে সৃষ্ট ‘ভয়াবহ’ মানবিক পরিস্থিতির জন্য মস্কোর সমালোচনা করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দফতরে সাধারণ পরিষদের জরুরি অধিবেশনে এই প্রস্তাবের ওপর ভোটাভুটিতে অংশ নেয় সদস্য দেশগুলো। শেষ পর্যন্ত সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে পাস হয় প্রস্তাবটি। তবে রাশিয়ার জন্য এটি মেনে চলার কোনও বাধ্যবাধকতা নেই।
এদিনের ভোটাভুটিতে প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয় বাংলাদেশসহ ১৪০ সদস্য দেশ। বিপক্ষে ভোট দেয় পাঁচটি দেশ। আর ভোটদানে বিরত ছিল চীন, পাকিস্তান ও ভারতসহ ৩৮ দেশ।
মধ্যপ্রাচ্যের আলোচিত দুই মার্কিন মিত্র সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতও প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে। বিপক্ষে ভোট দেওয়া পাঁচ দেশ হলো রাশিয়া, বেলারুশ, উত্তর কোরিয়া, ইরিত্রিয়া ও সিরিয়া।
এর আগে গত ২ মার্চ ইউক্রেনে হামলা বন্ধে একটি প্রস্তাব পাস করে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে। ওই সময়ে ১৪১টি দেশ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছিল। তবে তখন ভোটদানে বিরত ছিল বাংলাদেশ।
তখন বাংলাদেশের ভোটদানে বিরত থাকার ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা শান্তি চাই, সেইজন্য আমরা যুদ্ধ চাই না। যুদ্ধের বিরুদ্ধে আমরা। যুদ্ধের সপক্ষে আমরা ভোট দেইনি। খসড়া প্রস্তাবটি পড়লে দেখবেন, এটা যুদ্ধ বন্ধের জন্য নয়, কাউকে দোষারোপের জন্য। আমরা শান্তি চাই। আমরা চাই না, কোথাও যুদ্ধ হোক’।
এর আগে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন থেকে রাশিয়ান সেনাদের দ্রুত সরিয়ে নিতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপিত খসড়া প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছিল রাশিয়া। সেখানে ভোটাভুটিতে অংশ নিয়ে ১৫ দেশের মধ্যে সমর্থন জানায় ১১টি দেশ। আর ভোট দেওয়ায় বিরত ছিল ভারত, চীন, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাংলাদেশ।
তখন ঢাকায় নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেকজান্দার মান্টিটাস্কি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘কথিত ভোটের সময় বাইরের প্রচণ্ড চাপ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ নিস্ক্রিয় অবস্থান নেয়। সে জন্য বাংলাদেশের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা। বাংলাদেশ ভোটদানে বিরত ছিল। এ সম্পর্কে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন খুব সুনির্দিষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। সুতরাং, এ বিষয়ে বাড়তি কিছু বলার নেই’।
এদিনের ভোটাভুটিতে প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয় বাংলাদেশসহ ১৪০ সদস্য দেশ। বিপক্ষে ভোট দেয় পাঁচটি দেশ। আর ভোটদানে বিরত ছিল চীন, পাকিস্তান ও ভারতসহ ৩৮ দেশ।
কিন্তু, রাশিয়ান রাষ্ট্রদূতের বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জ্ঞাপনের কিছুক্ষণ বাদেই খবর আসে, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ইউক্রেন বিষয়ক একটি প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ আগের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলেও পূর্বের ন্যায় ভোটদানে বিরত ছিল ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, চীন (মোট ৩৮টি দেশ)। প্রস্তাবের পক্ষে ১৪০ টি এবং বিপক্ষে (রাশিয়া সহ) ৫টি দেশ ভোট দিয়েছে।
খুব স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের এমন দ্রুত অবস্থান পরিবর্তনকে ঘিরে সচেতন মহলে শুরু হয়েছে ব্যাপক কৌতুহল। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন অবশ্য ইতিমধ্যেই এবারের প্রস্তাবের পক্ষে ভোটদানের কারণ ব্যখ্যা করেছেন। শুক্রবার সকালে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘রেজুলেশনের (প্রস্তাবের) পক্ষে ভোট দেওয়ার মূল কারণ হচ্ছে মানবিকতা। বাংলাদেশ সারা বিশ্বে মানবিক দেশ হিসেবে সুপরিচিত। আমরা সবসময় শান্তির পক্ষে এবং যুদ্ধের বিপক্ষে। যে কোন যুদ্ধে সাধারণ নাগরিক সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এটি আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা থেকেই জানি। জাতিসংঘের রেজুলেশনে বলা হয়েছে, যারা নির্যাতিত এবং আহত হয়েছে তাদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার জন্য। যেহেতু আমরা চাই, যারা নির্যাতিত হয়েছে তারা সব ধরনের সুবিধা পাক, সেই জন্য আমরা এ রেজুলেশনে রাজি হয়েছি’। আগেরটাতে মনে হয়েছিল এক পক্ষকে দোষারোপ করা হচ্ছে, বলেও মন্তব্য করেন মন্ত্রী।
তবে, এবারের গৃহীত প্রস্তাবটি ২ মার্চ গৃহীত প্রস্তাব থেকে ভিন্ন কিছু নয় বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, ‘ইউক্রেনের পক্ষ থেকে উত্থাপিত এই প্রস্তাবে রাশিয়ার সমালোচনা করা হয়েছে এই বলে যে, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের ফলে শোচনীয় মানবিক বিপর্যয় তৈরি হয়েছে। প্রস্তাবে অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধের কথা বলা হয়েছে এবং ইউক্রেনের শহরগুলোতে রাশিয়ার সৈন্যরা যে অবরোধ তৈরি করেছে তা তুলে নেয়ার দাবি করা হয়েছে, যা কার্যত রাশিয়ার সৈন্যদের প্রত্যাহারেরই আহবান। আজকে গৃহীত এই প্রস্তাব ২ মার্চ জরুরি বিশেষ অধিবেশনে গৃহীত প্রস্তাব থেকে ভিন্ন কিছু নয়’।
জাতিসংঘে বাংলাদেশের এবারের অবস্থান সকলের মনোযোগ খুব বেশি আকর্ষণ করার পেছনে অন্য কারণও আছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তারা বলেন, এবারের প্রস্তাবটি উত্থাপিত হওয়ার ঠিক আগেই বাংলাদেশ সফর করে গেছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের রাজনৈতিক বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড। দক্ষিণ এশিয়ায় নিজের ত্রিদেশীয় সফরের অংশ হিসেবে ঢাকা সফর শেষে তিনি ভারতে যান এবং সেখান থেকে শ্রীলঙ্কা গমন করেন।
গত ১০ ডিসেম্বর গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাব এবং র্যাবের সাবেক ও বর্তমান সাতজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ওই নিষেধাজ্ঞার ঠিক ১০০ দিনের মাথায় ১৯ মার্চ তিন দিনের জন্য বাংলাদেশ সফরে ঢাকা পৌঁছেন বাইডেন প্রশাসনের পররাষ্ট্র বিষয়ক অন্যতম শীর্ষ কর্মকর্তা ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড। বাংলাদেশ-মার্কিন অংশীদারিত্ব সংলাপের সূচনা বক্তব্যেই ইউক্রেন ইস্যু তুলে তিনি বলেছিলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকালীন সময়ে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের হুমকি রয়েছে।’ তিনি বেশ সোজাসাপ্টাই জানান, যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটে বাংলাদেশকে পাশে চায়।
ওদিকে, বাংলাদেশ সফর শেষে ভারতে পৌঁছেও মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি দেশটির সংবাদ মাধ্যম ‘এনডিটিভি’কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ইউক্রেন সংঘাতের প্রসঙ্গ টানেন। গণতান্ত্রিক দেশগুলোকে অবশ্যই ‘রাশিয়া ও চীনের মতো স্বৈরাচারের’ বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘পুতিনের সিদ্ধান্তের কারণে গণতান্ত্রিক দেশগুলোকে একসঙ্গে দাঁড়াতে হবে এবং রাশিয়ার বিপরীতে তাদের অবস্থান গড়ে তুলতে হবে। গণতান্ত্রিক দেশগুলোকে অবশ্যই রাশিয়া ও চীনের মতো স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। বিশেষ করে এই মুহুর্তে যখন রাশিয়া এবং চীনের মতো স্বৈরাচারী রাষ্ট্রগুলো দেখাচ্ছে যে তারা শান্তি এবং নিরাপত্তার জন্য কতোটা হুমকি হতে পারে’।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ শুরু করে রাশিয়া। তখন অনেকেই ভেবেছিলেন কিয়েভের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার উৎখাত করা সম্ভব। তবে বুধবার যখন এই আগ্রাসনের এক মাস পূর্ণ হয়েছে তখন রুশ বাহিনী কার্যত থমকে আছে। অসংখ্য রুশ সেনার প্রাণহানির পরও অবিলম্বে এই যুদ্ধ অবসানের কোনও ইঙ্গিত দৃশ্যত নেই। অন্যদিকে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার প্রভাব টের পেতে শুরু করেছে মস্কো। রাশিয়ার ওপর নতুন করে আরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং ইউক্রেনকে আরও সামরিক সহযোগিতা দেওয়া নিয়ে এই সপ্তাহে ব্রাসেলস এবং ওয়ারশোতে বৈঠকে বসবেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং তার গুরুত্বপূর্ণ মিত্ররা।
ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, খাদ্য সরবরাহ নিয়ে আশঙ্কা, নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় চীন-রাশিয়ার ঘনিষ্ঠতা নিয়ে বিশ্বজুড়ে আর্থিক এবং ভূরাজনৈতিক আলোড়ন তৈরি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতেই বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে এই ভোটাভুটি অনুষ্ঠিত হলো। তবে মস্কোর মিত্র হিসেবে পরিচিত চীন এদিন সরাসরি রাশিয়ার পক্ষে ভোট দেওয়ার বদলে ভোট দেওয়া থেকে বিরত ছিল।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯০১
আপনার মতামত জানানঃ