করোনা মহামারিতে বিশ্বে বিপর্যস্ত দেশগুলোর মধ্যে ভারত একটি। করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর পাশাপাশি লকডাউনের কারণে নাজেহাল অবস্থায় রয়েছে দেশটি। এরইমধ্যে বায়ুদূষণের ফলে দৃষ্টিসীমা কমে আসা, দূষণে শ্বাসকষ্টসহ নানা ধরনের সমস্যা চরম আকার ধারণ করেছে ভারতে।
বিশ্বের দূষিত ১০০ শহরের ৬৩টিই রয়েছে ভারতে। এর মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহর হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে ভারতের রাজস্থানের ভিওয়াড়ি।
২০২১ সালে বিশ্বের ১১৭টি দেশ, অঞ্চল ও ভূখণ্ড এবং ৬ হাজার ৪৭৫টি শহরের বায়ুর মান বিশ্লেষণ করে তালিকা প্রকাশ করেছে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক দূষণ প্রযুক্তি সংস্থা আইকিউএয়ার। খবর: এনডিটিভি
রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতের গড় বায়ুদূষণ ৫৮.১ মাইক্রোগ্রামস প্রতি কিউবিক মিটার, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বেঁধে দেওয়া মানের ১০ গুণেরও বেশি।
২০২১ সালের তুলনায় দিল্লির দূষণ বেড়েছে ১৫ শতাংশ এবং ডব্লিউএইচওর মানের ২০ গুণ বেশি দূষণ রয়েছে। তবে শুধুমাত্র শহর হিসেবে ৪ নম্বরে আছে রাজধানী। এক নম্বরে রাজস্থানের ভিওয়াড়ি।
আইকিউএয়ারের রিপোর্টে ভিওয়াড়িকেই পৃথিবীর দূষিততম স্থান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। দ্বিতীয় অবস্থানে উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদ। তিনে চীনের শহর হোটান। তালিকায় সব থেকে দূষিত ১৫টি শহরের ১০টিই হলো ভারতের, যার বেশিরভাগের অবস্থান রাজধানীর আশেপাশেই।
দূষিত ১০০ শহরের তালিকায় ভারতের ৬৩টির অর্ধেকের বেশিই হরিয়ানা এবং উত্তরপ্রদেশে অবস্থিত। ভিওয়াড়ি, গাজিয়াবাদ এবং দিল্লি ছাড়াও প্রথম ১৫-তে রয়েছে জৌনপুর, নয়দা, বাহয়ালপুর, বাগপত, হিসার, ফরিদাবাদ, গ্রেটার নয়দা এবং রোহতক। ভারতের ছয়টি মেট্রো সিটি- দিল্লি, মুম্বাই, কলকাতা, চেন্নাই, বেঙ্গালুরু এবং হায়দ্রাবাদের মধ্যে একমাত্র চেন্নাইতেই গত এক বছরে দূষণের মাত্রা বাড়েনি। এক বছরে খারাপ থেকে অতি খারাপ দূষণ দিল্লিতে দেখা গেছে ১৬৮ দিন। কলকাতায় ৮৪ দিন এবং মুম্বাইতে ৩৯ দিন।
এদিকে, বায়ুদূষণের দিক দিয়ে ২০২১ সালে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত দেশ হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে বাংলাদেশ। টানা চতুর্থবারের মতো এ খ্যাতি পেয়েছে বাংলাদেশ। শীর্ষ দূষিত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ শনাক্ত হওয়ার পাশাপাশি বিশ্বের শীর্ষ দূষিত রাজধানীর তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে আছে রাজধানী ঢাকা।
আইকিউএয়ার বলছে, ২০২১ সালে বিশ্বের কোনো দেশই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্দেশিত বায়ুমানের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি।
বিশ্বের দূষিত ১০০ শহরের ৬৩টিই রয়েছে ভারতে। এর মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহর হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে ভারতের রাজস্থানের ভিওয়াড়ি।
প্রাথমিকভাবে বায়ু দূষণের কারণ হিসেবে পড়শি উত্তরপ্রদেশ এবং হরিয়ানার কৃষি জমিতে খড়বিচালি পোড়ানোকে চিহ্নিত করা হয়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টে কেন্দ্রের দেয়া তথ্য জানাচ্ছে, দিল্লির দূষণের মাত্র ১০ ভাগ হচ্ছে পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলিতে খড়বিচালি পোড়ানো ফলে। যানবাহন, ডিজেল চালিত জেনারেটর এবং শিল্প থেকে বায়ু দূষণের পরিমাণ তার চেয়ে অনেক বেশি।
শীতের গোড়ায় বায়ুদূষণের ফলে বাড়ছে অসুস্থতার ঘটনাও। চোখ জ্বালা, চোখ দিয়ে জল গড়ানো, কাশি-কফের সমস্যার পাশাপাশি শ্বাসনালী ও ফুসফুসে সংক্রমণের ঘটনাও বাড়ছে।
দিল্লি সরকারের পক্ষে দূষণ মোকাবিলায় কিছু বিধিনিষেধ মেনে চলার কথা বলা হয়েছে শহরবাসীকে। বাইরে বেরোলে গলায় স্কার্ফ এবং চোখের জ্বলুনি কমাতে সানগ্লাস পরার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এমনকি, ঘরে থাকাকালীনও প্রয়োজন বুঝে মাস্ক পরার কথাও বলা হয়েছে। শিল্প দূষণ কমাতে ইতিমধ্যেই দিল্লির ১১টি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে ছয়টি বন্ধ রাখা হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে কেন্দ্র ও দিল্লি সরকার একাধিক পদক্ষেপ করলেও তা এখনো স্বস্তি দিতে পারেনি দিল্লিবাসীকে।
প্রায় প্রতি বছরই ভারত সরকার অথবা দেশটির সুপ্রিম কোর্ট আতশবাজি পোড়ানোয় নিষেধাজ্ঞা জারি করে থাকে। তবে মাঠপর্যায়ে তা খুব কমই কার্যকর হতে দেখা যায়। এর সঙ্গে যোগ হয় দিল্লির প্রতিবেশী পাঞ্জাব ও হরিয়ানায় কৃষকদের খড় পোড়ানোর মৌসুম। পরবর্তী বছরে চাষের জন্য মাঠ প্রস্তুত করতে পুরোনো খড়কুটোয় আগুন ধরিয়ে দেন কৃষকরা। দিল্লির বায়ুদূষণের জন্য অন্তত ৩৫ শতাংশ দায়ী এ থেকে তৈরি ধোঁয়া।
ভারত সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, অর্থনৈতিক কার্যক্রমে নজর দিতে গিয়ে তারা বায়ুদূষণ রোধে যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছে না। গত ১ নভেম্বর স্কটল্যান্ডে কপ২৬ সম্মেলনে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা দিয়েছেন, ভারত ২০৭০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনবে। তবে কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, বৈশ্বিক জলবায়ু সংকট মোকাবিলার এই লক্ষ্যমাত্রায় ভারত অন্তত দুই দশক বেশি সময় নিচ্ছে।
বিশ্লেষকরা জানান, অবস্থানগত কারণে দিল্লির এই সমস্যা গুরুতর হচ্ছে৷ আশেপাশে কোনো জলাধার না থাকায় ও আবহাওয়ার ধাঁচ শীতপ্রধান ও শুষ্ক হওয়ায় দূষিত বাতাস পালাবার জায়গা পায় না৷ এছাড়া, তীব্র বেগে চলা বাতাস প্রায়ই সাথে করে আরো বাড়তি ধোঁয়া নিয়ে আসে, যা আরো খারাপ করে পরিস্থিতি৷
তারা বলেন, প্রতি শীতেই আমরা বিভিন্ন হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিশ্বাসজনিত ও হৃদরোগ-সম্পর্কিত রোগীদের বাড়ন্ত দেখতে পাই৷ দীর্ঘদিন ধরে দূষিত বাতাসে শ্বাস নেওয়া স্বাভাবিক স্বাস্থ্যের বিকাশ রোধ করে৷ দিল্লিতে বর্তমানে প্রতি তিনজনে একজন শিশুর ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ বহু শিশুর ফুসফুস সম্পূর্ণ বেড়ে ওঠে না ও সেখানে রক্তক্ষরণও হয়ে থাকে৷
২০১৯ সালে কৃষিবর্জ্য পোড়ানো থামাতে আইনী নির্দেশ এলেও, তার বাস্তবায়ন এখনও হয়নি৷ জাতীয় সবুজ ট্রাইবুনাল নভেম্বর মাসে আতশবাজি পোড়ানো বন্ধ করা নিয়ে আলোচনা করছে বলে জানাচ্ছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম৷ দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল ‘গ্রিন অ্যাপ’ চালু করেছেন, যাতে করে দূষণবিষয়ক নাগরিক নালিশ নথিভুক্ত করা যায়৷
বিশেষজ্ঞদের মতে, অবিলম্বে শহরে বিকল্প গণপরিবহণের কথা ভাবতে হবে, বাড়াতে হবে সাইকেলের মতো পরিবেশবান্ধব যানচলাচল৷ পুনর্ব্যবহারের বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন ও শিল্পক্ষেত্রে পরিবেশবান্ধব জ্বালানির ব্যবহার চালু করতে হবে বলে পরামর্শ দেন তারা। তবে এসবের কিছুই সরকারী তৎপরতা ছাড়া সম্ভব নয় বলে মনে করেন তারা৷
তারা জানিয়েছেন, আসলে সরকার ভোট ব্যাংক অটুট রাখতে চায়। হিন্দুদের চটালে তো তারা ভোট পাবে না। পৃথিবীজুড়েই রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত পরিবেশ সম্পর্কে অসচেতন। না হলে, সমুদ্রের জলস্তর বাড়ছে, প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নিতে শুরু করেছে, কিন্তু কেউ জরুরি ব্যবস্থা নিচ্ছেন না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪০২
আপনার মতামত জানানঃ