ক্ষমতা হারানোর দ্বারপ্রান্তে ইমরান খান৷ আগামী ২৫ মার্চ আস্থা ভোটে হেরে গেলে বিদায় ঘণ্টা বেজে যেতে পারে তার৷ আস্থা ভোট এড়িয়ে ইমরান ক্ষমতায় থাকতে চাইলে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপের আশঙ্কাও করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা৷
কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে বলে দিয়েছে, ওআইসি সম্মেলনের পর আপনি ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন।
সংসদ সদস্যদের আস্থা অর্জন করে ক্ষমতায় টিকে থাকার তেমন সম্ভাবনা নেই ইমরান খানের সামনে। কারণ তার দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করেনি। অন্যদিকে তার দলের ভিতরেও বিদ্রোহের আলামত স্পষ্ট। বলার অপেক্ষা রাখে না সেনাবাহিনীর ছায়াচ্যুত হয়ে গেছে ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)।
মূলত দেশের চরম অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণেই আবার মেয়াদ পূর্ণ হবার আগে সরকার পরিবর্তনের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে পাকিস্তানে৷ পাকিস্তানে মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধির ধারা এখনো অব্যাহত৷ দ্রব্যমূল্য আকাশছোঁয়া৷ ইমরান সরকারের বিরুদ্ধে অবশ্য সরকার পরিচালনায় সার্বিক ব্যর্থতার অভিযোগও তোলা হয়েছে৷ এবং এসব অভিযোগ শুধু বিরোধীদের নয়, ইমরানের পাকিস্তান তেহরিক-ই ইনসাফ (পিটিআই)-এর অন্তত ২৪ জন সদস্যও এ বিষয়ে বিরোধীদের সঙ্গে একমত বলে সংবাদমাধ্যমের খবর৷
আর তাই আগামী শুক্রবার সংসদে অনুষ্ঠেয় আস্থাভোটে তাদের ভোটও যেতে পারে ইমরানের বিরুদ্ধে৷ নিজের দলের সাংসদরাও বিরুদ্ধে ভোট দিলে সাড়ে তিন বছরের মাথায় ইমরান খানের বিদায় নিশ্চিত বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা৷ ৩৪২ সদস্যের সংসদের নিম্নকক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে হলে কমপক্ষে ১৭২টি ভোট পেতে হবে ইমরান খানের সরকার, বর্তমান পরিস্থিতিতে তা একরকম অসম্ভব৷
পাকিস্তানের সংসদের নিম্নকক্ষ জাতীয় পরিষদের স্পিকার আসাদ কায়সার ইতিমধ্যে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপনের তারিখ ঘোষণা করেছেন। সে অনুযায়ী আগামী ২৫ মার্চ সকাল ১১টায় ইমরান সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্তা প্রস্তাবটি তোলা হবে। সংবিধান অনুযায়ী, অনাস্থা প্রস্তাব যথাযথভাবে স্পিকার বা সংসদ সচিবালয়ে জমা দেওয়ার ১৪ দিনের মধ্যে সংসদ অধিবেশন ডাকা বাধ্যতামূলক। সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের নেতৃত্বাধীন বিরোধী দলগুলোর আইনপ্রণেতারা অনাস্থা প্রস্তাবটি জমা দিয়েছিলেন গত ৮ মার্চ৷ সে অনুযায়ী ২২ মার্চের মধ্যেই স্পিকার আসাদ কায়সারের অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপনের জন্য বিশেষ অধিবেশন ডাকার কথা।
অথচ অনাস্থা প্রস্তাবের জন্য ধার্য করা হয়েছে ২৫ মার্চকে৷ দুদিন পর প্রস্তাব উত্থাপনের তারিখ নির্ধারণের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সংসদ সচিবালয় ২২ থেকে ২৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের মূল কক্ষে অনুষ্ঠেয় ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের ৪৮তম সম্মেলনের কথা উল্লেখ করেছে। শুধু সরকারবিরোধীরা দেরিতে অধিবেশন ডাকায় প্রতিবাদে সোচ্চার হলেও পরে তারা তা মেনে নেন৷
তবে বিরোধীরা বলছেন, ইমরান খানের সরকার সময় নষ্ট করার কৌশল অবলম্বন করে ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা করছেন৷ অনাস্থা ভোট কমানো নিশ্চিত করতে বিরোধীদের অপহরণ করা হতে পারে— এমন আশঙ্কাও করছেন তারা৷
বিরোধীরা বলছেন, ইমরান খানের সরকার সময় নষ্ট করার কৌশল অবলম্বন করে ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা করছেন৷ অনাস্থা ভোট কমানো নিশ্চিত করতে বিরোধীদের অপহরণ করা হতে পারে— এমন আশঙ্কাও করছেন তারা৷
শুধু জেনারেল বাজওয়া নয় সেনাবাহিনীর শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট জেনারেল নাদিম আঞ্জুমসহ চার সামরিক কর্মকর্তা ইমরান খানের সঙ্গে সাক্ষাতের পর স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, ইমরান খানকে টিকিয়ে রাখার কোনো পথই আর খোলা নেই। তার মানে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ এতদিন যে চেষ্টা করে আসছিল সবই ভেস্তে গেলো।
যেমনি আগে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে সুশাসনের অভাব তথা দুর্নীতি ও অর্থনৈতিক ব্যর্থতার অভিযোগ এনে এবারও পাকিস্তানের সেনানায়কেরা একই কথা বলছেন। আর সেই ব্যর্থতার দায় নিয়ে ইমরানকে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার স্পষ্ট কথাও তারা বলে দিয়েছেন। এবার দেখার পালা নওয়াজ শরিফদের মতো ভাগ্য যে ইমরান খানের জন্যও অপেক্ষা করছে কি না।
এদিকে ইমরান ক্ষমতায় টিকতে পারবেন কি না কিংবা ক্ষমতায় থাকার জন্য কোনো আইনি ফাঁকফোকর আছে কি না, তা নিয়ে একটি বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ডন।
প্রতিবেদনের শুরুতে পাকিস্তানি সাংবাদিক হামিদ মিরের করা একটি সাম্প্রতিক টুইটের প্রসঙ্গ টেনে আনা হয়েছে। ওই টুইটের সঙ্গে একটি ভিডিও ক্লিপ প্রকাশ করেন হামিদ মির। ভিডিওটি ২০২১ সালের ৪ মার্চ ধারণ করা। গত বছর অনাস্থা ভোটের আগে আইনপ্রণেতাদের উদ্দেশে ইমরান খানের দেওয়া ভাষণ এটি।
সেখানে ইমরান খানকে বলতে শোনা যায়, ‘আপনারা যদি আমার প্রতি খুশি না হন, তাহলে হাত তুলে বিরোধিতা প্রকাশ করতে পারেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘এটি আপনাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। আপনারা বলতে পারেন যে আপনারা ইমরান খানের সঙ্গে নেই। আমি আপনাদের সিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকব। ধরে নেব আমি যোগ্য নই।’ এরপর ইমরান খানের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে যখন ভোটাভুটি হলো, তখন ১৭৮ জন আইনপ্রণেতা ইমরানের প্রতি সমর্থন জানিয়ে হাত তুলেছিলেন। ওই আস্থা ভোটে টিকে যান ইমরান।
সন্দেহ নেই, এক বছরে পাল্টেছে পরিস্থিতি। এখন আর আইনপ্রণেতাদের সমর্থন পাওয়ার ব্যাপারে ইমরানের মধ্যে আগের সেই আত্মবিশ্বাস দেখা যাচ্ছে না। তিনি প্রধানমন্ত্রিত্বের যোগ্য কি যোগ্য নন, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়াকে ‘গণতান্ত্রিক অধিকার’ বলে মনে করেন না।
এখন প্রধানমন্ত্রী ইমরান মনে করেন, যারা তার বিরুদ্ধে ভোট দেবেন, তারা বিরোধী দলের কাছে বিক্রি হয়ে গেছেন। ইতিমধ্যে বিভিন্ন জনসভায় এ অভিযোগ তুলতে দেখা গেছে তাকে। জাতীয় টেলিভিশনে দেওয়া বক্তব্যে তার উপদেষ্টা ও অনুগত মন্ত্রীরাও একই ধরনের অভিযোগ করছেন। এখন পিটিআইয়ের পক্ষত্যাগীরা বিরোধী দলের আতিথেয়তা উপভোগ করছেন।
ইমরান খানকে এখন পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে, তিনি যেন রাজধানী ইসলামাবাদে অবস্থিত বিভিন্ন প্রাদেশিক ভবনে অভিযান চালান, সিন্ধু প্রদেশে গভর্নরের শাসন আরোপ করেন এবং নিজ দলের সম্ভাব্য বিদ্রোহী সদস্যদের আগে থেকেই অযোগ্য ঘোষণা করেন। অথচ এক বছর আগেও নিজ দলের সদস্যের বিরোধিতাকেও তাদের রাজনৈতিক অধিকার বলে উল্লেখ করা হয়েছিল।
এখন প্রশ্ন হলো, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে কীভাবে এ কৌশলগুলো আইনসিদ্ধ উপায়ে ব্যবহার করতে পারেন।
ডনের প্রতিবেদনে বলা হয়, পাকিস্তানের সংবিধানে কিছু জরুরি বিধি রয়েছে। এ ছাড়া সংবিধানের ২৩২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, নির্দিষ্ট কিছু পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে প্রেসিডেন্ট জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারেন। এর আগে প্রেসিডেন্টকে অবশ্যই নিশ্চিত হতে হবে যে দেশে জরুরি পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এর কারণে পাকিস্তান কিংবা দেশটির কোনো অংশ যুদ্ধ, বহিঃশক্তির আক্রমণ কিংবা অভ্যন্তরীণ অস্থিরতাজনিত নিরাপত্তা হুমকিতে আছে।
আপাতত পাকিস্তানে যুদ্ধ কিংবা বহিঃশক্তির আক্রমণের পরিস্থিতি নেই। সে ক্ষেত্রে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি কোনো প্রদেশের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা ইস্যুতে জরুরি অবস্থা ঘোষণার কথা ভাবতে পারেন। তবে এ ধরনের জরুরি অবস্থা ঘোষণার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রাদেশিক পরিষদ থেকে প্রস্তাব পাস করিয়ে নিতে হবে।
প্রেসিডেন্ট যদি এ প্রক্রিয়ায় না গিয়ে নিজে নিজেই ব্যবস্থা নিতে চান, তবে প্রস্তাবটিতে পার্লামেন্টের দুই কক্ষের অনুমোদনের প্রয়োজন পড়বে। পার্লামেন্টের প্রতিটি কক্ষ এ ক্ষেত্রে ১০ দিন করে সময় পাবে। এ সময়ের মধ্যে সংশ্লিষ্ট প্রদেশের কার্যক্রম চলবে।
তবে অভ্যন্তরীণ অস্থিরতাকে কারণ দেখিয়ে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার এ প্রচেষ্টা আলোর মুখ দেখবে বলে মনে হয় না। কারণ, এ প্রচেষ্টা বিরোধীদের প্রতি সরকারের বিদ্বেষকে স্পষ্ট করে তুলবে। ইতিমধ্যে কয়েকজন মন্ত্রীর বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট হয়েছে যে তারা সত্যিকার অর্থে অনাস্থা ভোট থামাতে চান। এমন অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী অন্য কৌশলগুলো ব্যবহারের চেষ্টা করতে পারেন।
পাকিস্তানের সংবিধানের ২৩৪ অনুচ্ছেদের আওতায় প্রাদেশিক পরিষদকে পাশ কাটিয়ে গভর্নরের শাসন জারি করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রদেশের গভর্নর প্রেসিডেন্টকে জানাবেন যে সংবিধানের বিধির সঙ্গে সংগতি রেখে প্রাদেশিক শাসন চালানো যাচ্ছে না। তবে অন্যান্য জরুরি পরিস্থিতির মতো এ ক্ষেত্রে যথোপযুক্ত কারণ দেখাতে হবে। তা না হলে স্পষ্টতই বোঝা যাবে, সংশ্লিষ্ট প্রাদেশিক সরকারকে অপসারণের জন্যই এ পরিকল্পনা সাজানো হয়েছে।
পিটিআই অভিযোগ করে আসছে যে বিরোধী দলগুলো তাদের দলের আইনপ্রণেতাদের কিনে নিচ্ছে। এ ধরনের কেনাবেচার প্রবণতার বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট আদেশ জারি করতে পারেন বলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জোর গুঞ্জন রয়েছে। এ আদেশের ধরন কেমন হতে পারে, তা বলা মুশকিল।
তবে এ ধরনের আদেশ যদি সংবিধানের অনুচ্ছেদ ‘৬৩-এ’–এর ঘোষিত বিধিনিষেধকেও ছাপিয়ে যায়, তাহলে এর মধ্য দিয়ে মৌলিক মতপ্রকাশের স্বাধীনতা লঙ্ঘিত হওয়ার ঝুঁকি থেকেই যায়। কারণ, ৬৩-এ অনুচ্ছেদের আওতায় ঘোষিত বিধিনিষেধকেই ইতিমধ্যে কঠোর ও অগণতান্ত্রিক বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৬২ ও অনুচ্ছেদ ৬৩ এর আওতায় আইনপ্রণেতাদের মনোভঙ্গি সম্পর্কে ধারণার ভিত্তিতে তাদের দণ্ডিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া খুব বেশি কিছু করার সুযোগ সরকারের হাতে নেই। তবে এমনটা করা হলে একই পদ্ধতি ব্যবহার করে দেশের প্রচলিত বিচারব্যবস্থা বাতিলের সুযোগ পেয়ে যাবে সরকার।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৫৮
আপনার মতামত জানানঃ