কোভিড-১৯ মহামারি হানা দেওয়ার পর থেকেই নির্মাণ সামগ্রীর দাম বেড়েই চলেছে। তার ওপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আরও বৃদ্ধির কারণ হচ্ছে। ফলে ঠিকাদাররা চাপের মুখে সরকারের প্রতি নির্মাণ সামগ্রীর সাম্প্রতিক মূল্যানুসারে সরকারি কাজের দর ঠিক করার দাবি করছেন।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, সড়ক নির্মাণে তাদের অধীনে দেশি-বিদেশি ২৩২ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বর্তমানে ২২ হাজার ৮২৯ কোটি টাকার কাজ করছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, দেশে এখন প্রায় ২ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প চলমান। যার ৮০ শতাংশ বা অর্থাৎ ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা নির্মাণ প্রকল্প।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বৈশ্বিক পরিস্থিতির বিরুপ প্রভাব (ইউক্রেন যুদ্ধ) সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও সংস্থার অধীনে প্রকল্পের বাস্তবায়নে পড়েছে। গত কয়েক মাসে তারা নতুন টেন্ডার কমই জারি করেছে বলে উল্লেখ করেন তারা।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব
গত বছরের শেষ দিকে মাইল্ড স্টিল রডের দাম কয়েকদফা বৃদ্ধির পর প্রতিটনে প্রায় ৮০ হাজার টাকায় ঠেকেছিল। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়া হামলা করার এক সপ্তাহের মাথায় রডের দাম টনপ্রতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮৭ হাজার টাকা।
রড প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলো জানিয়েছে, নির্মাণ সামগ্রীটির বড় অংশের কাঁচামাল ইউক্রেন থেকে আসতো। সেখান থেকে সরবরাহ বিচ্ছিন্নতায় দেশের বাজারে রডের দাম বেড়েছে।
গত দুই সপ্তাহে নির্মাণ পণ্য সিমেন্টের দাম ১৮ শতাংশ বেড়েছে। বর্তমানে বাজারে প্রতিব্যাগ সিমেন্ট বিক্রি হচ্ছে ৪২০-৪৮৫ টাকার মধ্যে। যা গত বছরের শেষ দিকে ছিল ৩৮৫-৪১৫ টাকা।
প্রতিটন আমদানিকৃত পাথরের দাম ৩ হাজার থেকে বেড়ে ৪ হাজার টাকা হয়েছে। বিটুমিন প্রতিড্রাম সাড়ে ৬ হাজার টাকা থেকে হয়েছে ৯,৮০০ টাকা। প্রতি হাজার ইটের দাম ৬-৭ হাজার থেকে বেড়ে বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ১০ হাজার টাকায়।
বাংলাদেশ অটো রি-রোলিং অ্যান্ড স্টিল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মানোয়ার হোসেন বলেন, রডের মূল কাঁচামাল স্ক্র্যাপ লোহা আমদানির খরচ টনপ্রতি আগে ছিল ৪৩৫ ডলার। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর যা এখন প্রায় ৫০০ ডলারে ঠেকেছে। এছাড়া এসব কাঁচামাল সমুদ্রপথে আনা বেশ কঠিন ও ব্যয়বহুল হয়েছে।
কমেছে নতুন দরপত্র
গৃহায়ণ ও গণপূর্ত বিভাগের অধীনে ১৯ হাজার কোটি টাকার নির্মাণ প্রকল্প চলমান। বাংলাদেশ গণপূর্ত ঠিকাদার সমিতির প্রায় ১,০০০ সদস্য এসব নির্মাণকাজে ঠিকাদারি করছে।
সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক বাবুল আক্তার বাবলা জানান, অন্যান্য সকল খাতের ঠিকাদারদের মতো, তারাও কোনো নতুন দরপত্রে অংশ নিচ্ছেন না।
দুই সপ্তাহ ধরে বিভিন্ন নির্মাণ সামগ্রীর দাম আগের চেয়ে আরো ২০ শতাংশ বেড়েছে। এতে প্রায় ৬০টি প্রকল্পের নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে গেছে।
গণপূর্ত বিভাগের সচিব মো. শহীদ উল্লা খন্দকার বলেন, নতুন টেন্ডার নোটিশ করা বন্ধ আছে, তা বলা যাবে না। কিন্তু নতুন রেট অব শিডিউল না হওয়ায়, আপাতত পুরাতন প্রকল্পগুলোর কাজ চলছে। নতুন প্রকল্প যেগুলো নেওয়া হয়েছে, সেগুলো দ্রুত টেন্ডার নোটিশ করা হবে।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) অধীনে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকায় ১৪৩টি প্রকল্প চলমান। এর মধ্যে ৭০টি নির্মাণ প্রকল্প।
এলজিইডির ঢাকা মেট্রাপলিটন ঠিকাদার সমিতির যুগ্ম-সম্পাদক শেখ কাউসার আহমেদ বলেন, উপকরণের দাম আছে, পাশাপাশি শ্রমিকদের মজুরিও বেড়েছে ৩০-৪০ শতাংশ। চরম বিপাকে ঠিকাদাররা।
এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী মো. আব্দুর রশীদ খান বলেন, নির্মাণ সামগ্রীর বাজারদর বৃদ্ধির কারণে, দরপত্র আহ্বান বন্ধ হয়নি। অর্থবছরের বরাদ্দ অনুযায়ী টেন্ডার দেওয়া হয়। তবে কিছু টেন্ডারে ঠিকাদাররা অংশ নেয়নি।
সমস্যাটি সমাধানের জন্য এপর্যন্ত নতুন রেট শিডিউল প্রণয়নেরও কোনো অগ্রগতি অর্জিত হয়নি। পরিকল্পনা বিভাগের সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, সরকার সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের জন্য একটি ঐক্যবদ্ধ রেট অব শিডিউল প্রস্তুতের কাজ করছে। এটি প্রণীত হলে, একই ধরনের কাজে ভিন্ন ভিন্ন কোম্পানির ভিন্ন দাম ধরার সুযোগ বন্ধ হয়ে যাবে।
তিনি বলেন, নতুন এ রেট শিডিউলে দ্রব্যমূল্য ও উপকরণের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হবে। তবে এনিয়ে এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসেনি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতিবছর নির্মাণ সামগ্রীর বাজারদর আপডেট করে রেট অব শিডিউল নতুন করে প্রণয়ন করার কথা। গত ২০১৯ সালে এই শিডিউল প্রণয়নের পর এখন পর্যন্ত কোনো পরিবর্তন আনেনি সরকার।
অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর টিবিএসকে বলেন, সরকার চাইলে এসব নির্মাণ সামগ্রীর ঊর্ধ্বমুখী বাজারদর নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। দরকার সদিচ্ছা।
তিনি বলেন, নির্মাণ সামগ্রীর বাজার নজরদারিতে সরকারের কোনো যথাযথ নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ আছে বলে মনে হয় না। থাকলেও কার্যকর নয়। মনিটরিং জোরালো করতে হবে।
পাশের দেশ ভারতের সরকার এ বিষয়ে জোরালো পদক্ষেপ নিয়েছে। নির্মাণ সামগ্রীর কাঁচামাল আমদানিতে ভারতের সরকার নিজেরা নিয়োজিত হয়েছে। প্রয়োজনে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তারা ভর্তুকি দিয়েছে, যেটা বাংলাদেশ পারেনি।
অর্থনীতিবিদ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, উন্নয়ন প্রকল্পগুলি বাধাগ্রস্ত হতে থাকলে ৩৫ লাখ নির্মাণ শ্রমিকসহ এগুলোর ওপর নির্ভরশীল আরও ২০ লাখ শ্রমিক সমস্যায় পড়বে।
মহামারি জনিত আয় হারানো এবং নিত্যপণ্যের মূল্যের ঊর্ধ্বগতির উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রকল্প এলাকায় কাজ বন্ধ হলে, তারাও বেকার হয়ে পড়বে। তিনি সরকারকে অবকাঠামোগত প্রকল্পগুলি চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের উপায় বের করার পরামর্শ দেন।
সংশ্লিষ্টদের মতামত
নির্মাণ উপকরণের দাম বৃদ্ধির প্রভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হবে কি না তা এখনও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন প্রকল্পটির পরিচালক ড. মো. ওয়ালিউর রহমান। তবে তিনি মনে করেন, রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ দীর্ঘ হলে তার একটা প্রভাব পড়বে।
তিনি বলেন, প্রতিটি প্রকল্পেই উপকরণের মূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে প্রাইস কন্টেঞ্জেন্সি (বা জরুরি ভিত্তিতে মূল্য সমন্বয়ের) খাতে বরাদ্দ দেওয়া থাকে। আবার কিছু প্রকল্পে পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) নির্মাণ উপকরণ মূল্যসূচকের ভিত্তিতে প্রয়োজনে বাড়তি অর্থ পরিশোধ করতেও বরাদ্দ দেয় সরকার। এর ভিত্তিতে ঠিকাদারকে প্রয়োজনে বাড়তি অর্থ ছাড় করা যায়। কিন্তু বাড়তি চাহিদা প্রকল্পের ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) বরাদ্দের চেয়ে বেড়ে গেলে, বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হবে।
সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) ঠিকাদার সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক প্রদীপ কুমার বলেন, আমরা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নতুন রেট অব শিডিউল দেওয়ার জন্য কয়েকদফা আলোচনা করেও কোনো সমাধান পাইনি। তাই আমরা গত বছরের ডিসেম্বর থেকে কোনো নতুন টেন্ডারে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী একেএম মনির হোসেন পাঠান বলেন, আমরা রেট অব শিডিউল নিয়ে মন্ত্রণালয়ের সাথে কয়েকদফা আলাপ করেছি। সরকার দ্রুত একটি সিদ্ধান্তে আসবে।
তিনি বলেন, “আপাতত কোনো প্রকল্পের জন্য নতুন টেন্ডার নোটিশ হচ্ছে না। চলমান প্রকল্পগুলোকে কীভাবে সচল রাখা যায়, সে বিষয়ে ঠিকাদারদের সাথে আলোচনা করা হচ্ছে। আমরা তাদেরকে সাধ্যমতো সমর্থন দেওয়ার চেষ্টা করছি। তবে, কিছু ছোটখাটো প্রকল্পের টেন্ডার ইস্যু হয়েছে, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে।”
সারাদেশে অধিকাংশ উন্নয়নমূলক কাজ বাস্তবায়নকারী সরকারের অন্যান্য বিভাগগুলোর অবস্থাও প্রায় একই রকম। সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও সংস্থার জারি করা নতুন দরপত্রের সংখ্যা গত সাত মাসে বা তারও বেশি সময় ধরে কমেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ ঠিকাদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক মেজবাউর রহমান রতন বলেন, “নির্মাণ সামগ্রীর দাম একদিকে বেশি। অন্যদিকে, বর্তমানে চলমান বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য সরকার কোনো ব্যয় বৃদ্ধি করেনি। ফলে বেকায়দায় পড়েছে ঠিকাদাররা।
আব্দুল মোনেম লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মাঈনুদ্দিন মোনেম বলেন, উপকরণের দাম বাড়ায় নির্মাণ কাজ ব্যাহত হচ্ছে। সরকারের দ্রুত এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিয়ে দর সমন্বয় করা উচিত।
ঠিকাদার সমিতির কর্মকর্তারা জানান, চলমান প্রকল্প নিয়েই অসুবিধায় থাকায় ঠিকাদাররা নতুন দরপত্রে অংশ নিতে আগ্রহী নন।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩০০
আপনার মতামত জানানঃ