রুশ গোলা থেকে জীবন বাঁচাতে নিজ দেশ ছাড়ছেন অনেক ইউক্রেনীয়। সীমান্ত দিয়ে পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, রোমানিয়ায় ঢুকছে ইউক্রেনের শরণার্থীরা। জাতিসংঘ জানিয়েছে, রাশিয়ার সামরিক অভিযানের শুরুর পর এ পর্যন্ত ইউক্রেন ছাড়তে বাধ্য হয়েছে ১২ লাখের বেশি শরণার্থী। এবার এর সাথে সাথেই উন্মোচিত হচ্ছে ইউরোপের ভালো মানুষের চেহারা।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার জানিয়েছে, এ পর্যন্ত দেশ ছেড়েছেন ১২ লাখ ৯ হাজার ৯৭৬ জন। যার অর্ধেকের বেশি মানুষ পোল্যান্ডে প্রবেশ করেছেন। প্রতিবেশী হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া, মলদোভা এবং রোমানিয়াতে আশ্রয় নিয়েছেন বাকিরা।
২৮৬ ইউক্রেনিয়ানকে সীমান্ত থেকে ফেরাল যুক্তরাজ্য
ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরু করার পর থেকে ৫৮৯ জন ইউক্রেনিয়ান এই সীমান্তে আসেন বলে জানা যাচ্ছে। তাদের মধ্য থেকে ২৮৬ জনকে যুক্তরাজ্যে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।
অনেক শরণার্থী ফ্রান্সের ক্যালে বন্দর দিয়ে যুক্তরাজ্যে প্রবেশের চেষ্টা করছে। এর আগে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন, ব্রিটেন খুবই ‘আন্তরিক দেশ’। কিন্তু কারা প্রবেশ করার চেষ্টা করছে, তাদের যাচাই-বাছাই করে দেখতে চায়।
রাশিয়ার হামলা শুরুর পর ১২ দিনে ইউক্রেন থেকে ১৭ লাখের বেশি মানুষ পাশের দেশগুলোতে গেছেন বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর।
সংস্থাটি বলছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে সবচেয়ে দ্রুত বাড়তে থাকা এ শরণার্থী সংকট মারাত্মক আকার নিতে যাচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ভাষ্যমতে, এ যুদ্ধে ৪০ লাখের মতো মানুষ ইউক্রেন ছাড়তে পারেন।
‘অবৈধ অভিবাসীদের’ ঢুকতে দেয়নি হাঙ্গেরি
ইউক্রেনের সংঘাত থেকে পালিয়ে আসাদের জন্য সীমান্ত খোলা রাখলেও ‘অবৈধ অভিবাসীদের’ ক্ষেত্রে নীতির পরিবর্তন করেনি হাঙ্গেরি৷ জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলকে এমন তথ্য জানিয়ে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইউক্রেনের শরণার্থীদের সঙ্গে অন্যদের তুলনার কড়া সমালোচনা করেছেন৷
২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রুশ সামরিক অভিযানের পর থেকে সীমান্তবর্তী ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো সেখান থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের আশ্রয় দিচ্ছে৷ এগিয়ে এসেছে কঠোর অভিবাসন নীতির কারণে সমালোচিত হাঙ্গেরির সরকারও৷
দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী পিটার সিয়ার্টো জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলকে বলেন, ‘‘আমাদের সমস্ত সীমান্ত পয়েন্টগুলো খোলা রয়েছে, দৈনিক ২৪ ঘণ্টা সেখানে কার্যক্রম চলছে৷’’
তবে ইউক্রেন থেকেও সবাইকে প্রবেশের সুযোগ দিচ্ছে না বুদাপেস্ট৷ বিষয়টি ব্যাখ্যা করে সিয়ার্টো বলেন, ‘‘আমরা ইউক্রেনীয় নাগরিকসহ যারা ইউক্রেনে বৈধভাবে বসবাস করতেন তাদেরকে আসতে দিচ্ছি এবং ভালো যত্ন নিচ্ছি৷’’
তিনি জানান, এখন পর্যন্ত প্রতিবেশী দেশটির এক লাখের বেশি শরণার্থীকে তারা আশ্রয় দিয়েছেন৷
ইউক্রেনবাসীর মানবেতর জীবন
প্রাণ বাঁচাতে দিগ্বিদিক ছুটে বেড়াচ্ছে ইউক্রেনের সাধারণ মানুষ। কেউ জানে না তাদের শেষ গন্তব্য কোথায়। তবু বেঁচে থাকার তাগিদে হেঁটেই সন্তানকে নিয়ে ছুটে চলছেন অসহায় মা।
এক শরণার্থী বলেন, আমরা এখানে হেঁটে এসেছি। প্রায় ১২ ঘণ্টা ধরে এখানে অবস্থান করছি। আমার মতো অনেকেই প্রাণে বাঁচতে এখানে এসেছে। কিয়েভে তারা বার বার বোমা হামলা চালাচ্ছে। তারা যে কোনো সময় যে কোনো স্থানেই আক্রমণ করতে পারে। আমি আর কিছু বলতে পারবো না, আমি খুবই ক্লান্ত।
রাশিয়ার একের পর এক বিমান হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ। আর তাই জীবন বাচাঁতে পোল্যান্ডের সীমান্তে ভিড় করছেন ইউক্রেনের বেসামরিক নাগরিকরা।
রুশ সেনাদের অভিযান থেকে বাঁচতে অনেকে আবার দেশ ছেড়ে পালাতে না পেরে আশ্রয় নিয়েছেন গির্জায়। পরিবার নিয়ে কোনো রকম বেঁচে থাকাটাই যেন এখন তাদের একমাত্র চাওয়া।
এ অবস্থায় বিভিন্ন দেশের পাশাপাশি শরণার্থীদের গ্রহণে এগিয়ে এসেছে জার্মানি। ইউক্রেনের নাগরিকদের জার্মানি প্রবেশে কোনো ভিসা লাগবে না বলে জানিয়েছে বার্লিন। সে লক্ষ্যে শরণার্থীদের জন্য আশ্রয়শিবির নির্মাণের কথা জানিয়েছে জার্মান রেড ক্রস।
জার্মান রেড ক্রস প্রধান ক্রিসটফ জোনেন বলেন, সর্ব প্রথম আমরা সীমান্ত অতিক্রম করা মানুষদের খাবার, পানি, স্যানেটাইজার দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। সত্যি বলতে ইউক্রেনের যুদ্ধের গতিশীলতা দেখে আমরা এখনো নিশ্চিত হয়ে বলতে পারছি না, আমরা কত জনকে আশ্রয় দিতে পারবো। তবে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার তথ্যমতে, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত এক লাখ মানুষ তাদের ঘর-বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে।
বর্ণবাদী ইউরোপ
যুদ্ধের কারণে কয়েক বছর ধরে আফগানিস্তান থেকে তাড়া খেয়ে বাদামি চামড়ার যে আফগানরা ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করছেন, তাদের ঢুকতে না দিয়ে নির্মমভাবে সীমান্ত থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার কাজটি ইউরোপীয় দেশগুলো করে এসেছে।
সেই ইউরোপে এক সপ্তাহের মধ্যে রাশিয়ার সহিংস আগ্রাসনের মুখে পড়ে ইউক্রেন থেকে পালিয়ে এসেছে প্রায় ১০ লাখ মানুষ। মোটা দাগে সবাই জানে, প্রতিবেশী দেশ হিসেবে উদ্বাস্তুদের যেভাবে স্বাগত জানানো উচিত, তেমন করেই তাদের স্বাগত জানানো হচ্ছে। কিন্তু এর মধ্য দিয়েও ইউরোপের বর্ণবাদী দ্বিচারিতার মুখোশ খুলে গেছে।
ইউক্রেনের সীমান্তসংলগ্ন দেশটি লাখ লাখ ইউক্রেনীয় উদ্বাস্তুকে উষ্ণ সমাদরে গ্রহণ করেছে। অথচ মাস কয়েক আগেও আফগান শরণার্থীদের মুখের ওপর তারা দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। পোল্যান্ডের সরকারি নিরাপত্তাকর্মী ও সেখানকার মানুষ বর্ণবাদী মানসিকতার পরিচয় দিচ্ছে।
ইউক্রেন থেকে তাড়া খেয়ে আসা মানুষগুলোর মধ্যে যাদের গায়ের রং ইউরোপীয়দের মতো নয়, তাদের তারা ঢুকতে দিতে চাইছে না।
এসডব্লিউ/এসএস/১২৫৫
আপনার মতামত জানানঃ