পার্বত্য জেলা বান্দরবান সদর উপজেলার বাঘমারা, জামছড়ি, নাসালং পাড়া, আন্তা পাড়া, ক্যনাইজু পাড়া, মনজয় পাড়া, রাজবিলা এখনও সন্ত্রাসপ্রবণ এলাকা হিসেবে পরিচিত। প্রায়ই এসব এলাকায় চাঁদাবাজি, অপহরণ, খুন, গুমসহ নানা ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটছে।
একের পর এক হত্যাকাণ্ডে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে পার্বত্য জেলা বান্দরবান। চলতি বছরের প্রায় আড়াই মাসে (৭ মার্চ পর্যন্ত) জেলার বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে খুন হয়েছেন ১৮ জন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় স্থানীয়দের মাঝে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক। এ অবস্থায় পাহাড়ে পর্যাপ্ত সেনা ক্যাম্প স্থাপন ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান জোরদারের দাবি জানিয়েছেন পার্বত্য এলাকার বাসিন্দারা।
সর্বশেষ গত রোববার জেলার রোয়াংছড়ি উপজেলার সাঙ্গু নদীর পাড় থেকে চার যুবকের গুলিবিদ্ধ মরদেহ উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
জানা যায়, ২০২২ সালের ৩ জানুয়ারি লামা রূপসীপাড়া ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ড অংহ্লা পাড়ায় শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে গিয়ে সন্ত্রাসীর গুলিতে নিহত হন মংক্যচিং মার্মা (৩৬)। ৬ জানুয়ারি বান্দরবান সদর থানার রাজবিলা ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ড থংজমা পাড়ায় নিজ বাড়িতে নিহত হন সিংয়ানু মারমা (৩০)। এ ঘটনায় তার স্বামীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
এরপর ২ ফেব্রুয়ারি বান্দরবানের রুমা জোনের একটি সেনা টহল দলকে রুমা বথিপাড়া এলাকায় লক্ষ্য করে পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা গুলি চালায়। পরে উভয়পক্ষের গুলিবিনিময়ে সেনাবাহিনীর সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার হাবিবুর রহমান নিহত হন। একই ঘটনায় তিন সন্ত্রাসীও নিহত হয়। এ ঘটনায় আরেক সেনাসদস্য ফিরোজ পায়ে গুলিবিদ্ধ হন।
২৫ ফেব্রুয়ারি রুমা উপজেলার গ্যালেংগা ইউনিয়নের আবু পাড়ায় পাড়াপ্রধান লংরুই ম্রোসহ (৬৫) তার পরিবারের পাঁচজনকে কুপিয়ে হত্যা করে পাড়াবাসীরা। এ ঘটনায় ওই পাড়ার ২২ জনকে গ্রেফতার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায় পুলিশ।
২৬ ফেব্রুয়ারি রোয়াংছড়ি উপজেলার নতুন পাড়ায় মংসিং শৈ মারমা (৩৬) নামে এক যুবককে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। ৩ মার্চ রোয়াংছড়ি উপজেলার নোয়াপতং ইউনিয়নের নারী কারবারি পাড়া এলাকার একটি জুম ঘরে চুইরংমা মারমাকে (৪০) গলা কেটে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় একজনকে গ্রেফতার করে রোয়াংছড়ি থানা পুলিশ।
৫ মার্চ রোয়াংছড়ি উপজেলার তারাছা ইউনিয়নের মারমা পাড়ায় উনু মং রয়েল (৩৮) নামে জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) এক সদস্যকে হত্যা করে মরদেহ নিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। সর্বশেষ ৬ মার্চ রোয়াংছড়ি ও রুমা উপজেলার মধ্যবর্তী তারাছা ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ড মংবাইতং পাড়া এলাকার নদীর দক্ষিণপাড় থেকে গুলিবিদ্ধ চার পাহাড়ি যুবকের মরদেহ উদ্ধার করে রুমা থানা পুলিশ ও সেনাবাহিনী।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই দুই মাসে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের বেশিরভাগই হয়েছে পাহাড়ে সক্রিয় কিছু আঞ্চলিক সংগঠনের আধিপত্য বিস্তার ও সন্ত্রাসীদের দ্বন্দ্বের জেরে।
সর্বশেষ গত রোববার জেলার রোয়াংছড়ি উপজেলার সাঙ্গু নদীর পাড় থেকে চার যুবকের গুলিবিদ্ধ মরদেহ উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে জানতে চাইলে বান্দরবানের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অশোক কুমার পাল গণমাধ্যমকে বলেন, পাহাড় ও সমতলের হত্যাকাণ্ড এক নয়। দুই নারী ও পাড়াপ্রধান লংরুই ম্রোসহ তার পরিবারের পাঁচজনকে হত্যা মামলার আসামিদের গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ। বাকি হত্যাকাণ্ডগুলো আঞ্চলিক সংগঠন জেএসএস, ইউপিডিএফ, মগ লিবারেশন পার্টি এদের ক্ষমতার আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্বে হয়েছে।
পুলিশের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, পাহাড় তাদের (সন্ত্রাসীদের) জন্য যত সহজ আমাদের জন্য তত কঠিন। যাতায়াত দুর্গমতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে তারা এ অপকর্মগুলো চালিয়ে যাচ্ছে। তবে দ্রুত সেনাবাহিনীর সহায়তায় যৌথভাবে অভিযান চালিয়ে সন্ত্রাসীদের নির্মূল করা হবে।
পার্বত্য জেলা বান্দরবানে ১১টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বসবাস। ১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তির পর থেকে শান্তি সম্প্রীতি নিয়ে বসবাস করে আসছিলেন এ জেলার মানুষ। কিন্তু সম্প্রতি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর অন্তর্কোন্দল ও আধিপত্য বিস্তারে বিভিন্ন উপদল সৃষ্টি হওয়ায়, নিজেদের মধ্যে চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন বিষয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জড়িয় পড়ছে তারা। এতে প্রাণ হারাচ্ছেন সশস্ত্র সংগঠনের সদস্যসহ পাহাড়ের সাধারণ মানুষ।
সম্প্রতি একের পর এক হত্যাকাণ্ডে বান্দরবান পরিণত হয়েছে আতঙ্কের নগরীতে। পাহাড়ে সহিংসতা বন্ধে ও শান্তিশৃঙ্খলা ফেরাতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
এদিকে, শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের নামে পাহাড়ের রাজনৈতিক সংগঠনগুলো গুম, খুন ও চাঁদাবাজি চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানালেন পার্বত্য নাগরিক পরিষদের সভাপতি কাজী মো. মজিবুর রহমান।
সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা বলেন, ১৯৯৭ সালে বর্তমান সরকার শান্তিচুক্তি করার পর বান্দরবানে শান্তি ছিল তবে হঠাৎ করেই পার্বত্য জেলা বান্দরবানে আইনশৃংঙ্খলা পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে ওঠেছে আর এই শান্তি ও সম্প্রীতির জেলার সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখতে আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে এই সন্ত্রাসী বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
তারা বলেন, আমাদের শান্তি প্রিয় জেলাটি আজ অশান্তির পথে। সবচেয়ে আমাদের জন্য যেটি বেশি অশনি সংকেত সেটি হলো বান্দরবানে যে কয়েকটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠি পাহাড়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাচ্ছে তাদের বেশিরভাগ সদস্য তরুণ যুবক। আর এই যুবকরাই পথভ্রষ্ট হয়ে পার্বত্য এলাকার আঞ্চলিক বিভিন্ন সংগঠনে যোগ দিয়ে নিজের জাতি গোষ্ঠির ওপর নিজেরাই হামলা করছে।
আরও বলেন, অত্যাধুনিক অস্ত্র হাতে বান্দরবানের বিভিন্ন দুর্গম এলাকাতে সন্ত্রাসীদের বিচরণ এখন নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই আগামীর সুন্দর বান্দরবান রক্ষায় প্রশাসনকে আরো জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে এবং প্রয়োজনে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১২১৬
আপনার মতামত জানানঃ