চলমান যুদ্ধের এমন ঘোলাটে পরিস্থিতিতে আগামীর পথ দেখাটা বেশ কঠিন হতে পারে। যুদ্ধক্ষেত্রের খবর, কূটনৈতিক স্থিরাবস্থা, শোক এবং বাস্তুচ্যুতদের আবেগ; এসব অপ্রতিরোধ্য হতে পারে। তবে আমরা এক মুহূর্তের জন্য পিছিয়ে যাই এবং ইউক্রেনের সংঘাত কোন দিকে এগিয়ে যেতে পারে, তা বিবেচনা করি। রাজনীতিবিদ এবং সামরিক পরিকল্পনাবিদরা গবেষণা করছেন এমন কিছু পরিস্থিতি নিয়ে।
ইউক্রেনের পরাজয়
যুদ্ধের এই পর্যায়ে দেখা যাবে রাশিয়া তার সামরিক অভিযান বাড়িয়েছে। ইউক্রেনজুড়ে নির্বিচারে রকেট হামলা এবং গোলাবর্ষণ চালিয়েছে। রুশ বিমান বাহিনীর ব্যাপক ধ্বংসলীলা অব্যহত রয়েছে।
সাইবার হামলার শিকার হয়ে ইউক্রেনের বিভিন্ন জাতীয় অবকাঠামো ভেঙে পড়েছে। এতে করে বিদ্যুৎ সংযোগ ও যোগাযোগের নেটওয়ার্ক ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
দুঃসাহসী প্রতিরোধের পরও কিয়েভের পরাজয় ঠেকানো সম্ভব হয়নি। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে হত্যা করা হয়েছে অথবা তিনি পশ্চিমে পালিয়ে গেছেন। ইউক্রেনের মসনদে বসেছে রুশপন্থি কোনো সরকার।
এদিকে ভ্লাদিমির পুতিন তার কাঙ্ক্ষিত বিজয় ঘোষণা করছেন। ইউক্রেন থেকে কিছু সৈন্য প্রত্যাহার করেছেন, আবার কিছু সৈন্য নিরাপত্তার খাতিরে ইউক্রেনেই রেখে দিয়েছেন। এমন দৃশ্যে হাজার হাজার উদ্বাস্তুকে পশ্চিমাঞ্চলে পালিয়ে যেতে দেখা যাবে। এমন দৃশ্যের অবতারণা মোটেও অসম্ভব নয়।
দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ
এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে পরিণত হতে পারে। এমনও হতে পারে যে রুশ সৈন্যরা ইউক্রেনে আটকা পড়ে তাদের মনোবল হারিয়ে ফেলেছে। আবার রসদের অভাব কিংবা দুর্বল নেতৃত্বের কারণে রাশিয়ার জয় পেতে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। কিয়েভ দখল করতে রুশ বাহিনীর দীর্ঘ সময় লাগতে পারে। কারণ সেখানকার জনগন এখনো প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছে।
আবার ইউক্রেনের আরো কিছু শহর রাশিয়া দখল করে ফেললেও সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে বেগ পেতে হতে পারে। ইউক্রেনের বিশাল স্থলসীমা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে রাশিয়াকে বিপুলসংখ্যক সৈন্য মোতায়ন করতে হবে, যা প্রায় অসম্ভব।
আবার এতদিনে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা বাহিনী শক্তিশালী বিদ্রোহী গোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। স্থানীয়দের পূর্ন সমর্থন রয়েছে তাদের প্রতি। পশ্চিমারা ইউক্রেনকে যথেষ্ট রসদ সরবরাহ করবে। হয়তো একসময় রাশিয়ার নেতৃত্ব পরির্তন হবে। ১৯৮৯ সালে ইসলামপন্থিদের বিরুদ্ধে পরাজিত হয়ে আফগানিস্তান ত্যাগ করার মতো তখন ইউক্রেনও ত্যাগ করতে হতে পারে রুশ বাহিনীকে।
ইউরোপীয় যুদ্ধ
এই যুদ্ধ ইউক্রেন সীমান্ত পেরিয়ে ইউরোপের অন্যান্য অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। ন্যাটোর অংশ নয়, এমন সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র, যেমন মলদোভা ও জর্জিয়াতে সৈন্য পাঠিয়ে রাশিয়ার সাবেক সাম্রাজ্যের আরও অংশ পুনরুদ্ধার করতে চাইতে পারেন পুতিন।
পুতিন পশ্চিমাদের ইউক্রেনীয় বাহিনীকে অস্ত্র সরবরাহ করাকে আগ্রাসন বলে ঘোষণা করতে পারেন। তিনি কালিনিনগ্রাদের উপকূলীয় উপনিবেশের সাথে একটি স্থল করিডোর স্থাপনের জন্য লিথুনিয়ার মতো ন্যাটো সদস্যভুক্ত বাল্টিক দেশগুলোতে সৈন্য পাঠানোর হুমকি দিতে পারেন।
ন্যাটোর সঙ্গে যুদ্ধ হলে তা হবে অত্যন্ত বিপজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ সামরিক জোট সনদের ৫ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ন্যাটোভুক্ত কোনো সদস্যের ওপর হামলা করাটা সবার ওপর হামলার শামিল।
কিন্তু পুতিন ঝুঁকি নিতে পারেন, যদি তিনি মনে করেন যে এটিই তার নেতৃত্বকে বাঁচানোর একমাত্র উপায়। যদি তিনি ইউক্রেনে পরাজয়ের মুখোমুখি হন, তবে তার ক্ষোভ আরো বাড়তে পারে।
বলা হচ্ছে, এই রুশ নেতা দীর্ঘদিনের আন্তর্জাতিক নিয়ম ভঙ্গ করতে আগ্রহী। পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রেও এই একই যুক্তি প্রয়োগ দেখা যেতে পারে। এই সপ্তাহে পুতিন তার পারমাণবিক বাহিনীকে উচ্চ স্তরের সতর্কতার মধ্যে রেখেছেন। বেশিরভাগ বিশ্লেষকের ধারণা যে এই সতর্কতার অর্থ তাদেরকে ব্যবহার করার সময় ঘনিয়ে এসেছে।
কূটনৈতিক সমাধান
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, ‘এখন বন্দুক কথা বলছে, কিন্তু সংলাপের পথ সবসময় খোলা থাকতে হবে। অবশ্যই সংলাপ চলছে।’
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ ফোনে প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে কথা বলেছেন। আশ্চর্যজনকভাবে, রাশিয়ান এবং ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারা বেলারুশের সঙ্গে সীমান্তে আলোচনার জন্য মিলিত হয়েছেন। তারা হয়তো খুব বেশি অগ্রগতি পাননি।
কিন্তু আপাতত মনে করা হচ্ছে, আলোচনায় রাজি হয়ে পুতিন অন্তত আলোচনার মাধ্যমে যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনাকে মেনে নিয়েছেন।
অথবা এমন একটি দৃশ্য কল্পনা করা যাক, যেখানে এই যুদ্ধ রাশিয়ার অনুকূলে যাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা মস্কোর মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদিকে পুতিন বুঝতে পেরেছেন যে তিনি তার ধারণক্ষমতার বাইরে হাত বাড়িয়েছেন।
তিনি ভাবছেন যে, যুদ্ধ বন্ধ করার চেয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়াটাই তার নেতৃত্বের জন্য বেশি হুমকিস্বরূপ। আবার যুদ্ধ বন্ধ না হলে চীন রাশিয়া থেকে গ্যাস কিনবে না বলে হুমকি দিচ্ছে।
এমন সময় পুতিন যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য কোনো একটি উপায় খুঁজতে শুরু করেছেন। ইতোমধ্যে ইউক্রেনও বুঝতে আরম্ভ করেছে যে প্রাণহানির চেয়ে রাজনৈতিক সমঝোতা করাটাই শ্রেয়।
পুতিনের ক্ষমতাচ্যুতি
রাশিয়া যখন আক্রমণ শুরু করে, তখন ভ্লাদিমির পুতিন ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমরা যেকোনো ফলাফলের জন্য প্রস্তুত।’ কিন্তু সেই ফলাফল হিসেবে যদি তিনি ক্ষমতা হারান, এটা অকল্পনীয় মনে হতে পারে, তবে এখন বিশ্বে বিভিন্ন বিষয়ে পরিবর্তন এসেছে এবং এ জাতীয় বিষয়গুলো এখন ভাবা হচ্ছে।
লন্ডনের কিংস কলেজের ওয়ার স্টাডিজের ইমেরিটাস অধ্যাপক প্রফেসর স্যার লরেন্স ফ্রিডম্যানের মতে এখন কিয়েভের মতো মস্কোতেও শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এটা ঠিক যে পুতিন একটি বিপর্যয়কর যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। হাজার হাজার রুশ সৈন্য মারা যাচ্ছে। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা হুমকি হয়ে উঠছে। এতে করে জনসমর্থন হারাতে পারেন পুতিন। বিপ্লবের সম্ভাবনাও দেখা যাবে। সেই বিরোধিতাকে দমন করতে তিনি রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বাহিনীকে ব্যবহার করবেন।
এর ফলে রাশিয়ার সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অভিজাত শ্রেণির যথেষ্ট সদস্যরা তার বিরুদ্ধে চলে যাবে। পশ্চিমারা স্পষ্ট করে দেবে, যদি পুতিন ক্ষমতা ত্যাগ করেন এবং তার পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত বেশি মধ্যপন্থি নেতৃত্ব আসে, তাবে রাশিয়ার উপর থেকে কিছু নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবে এবং স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখা হবে।
উপরোক্ত সবগুলো ঘটনা যে একত্রে ঘটবে এমনটা ভাবা ঠিক হবে না। ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতি মিলে ভিন্ন ফলাফল তৈরি করতে পারে। কিন্তু যদি এই দ্বন্দ্ব চলতে থাকে, তবে বহির্বিশ্বের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক যে পরিবর্তন হবে তা একেবারে নিশ্চিত করেই বলা যায়।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩০০
আপনার মতামত জানানঃ