অনলাইনে ডলার-পাউন্ড-ইউরোর পাশাপাশি কেনাকাটা করা যায় বিটকয়েনে। তবে অন্যান্য মুদ্রাব্যবস্থায় যেমন সে দেশের সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক জড়িত থাকে, বিটকয়েনের ক্ষেত্রে তা নয়। ২০০৯ সালে সাতোশি নাকামোতো ছদ্মনামের কেউ কিংবা একদল সফটওয়্যার ডেভেলপার নতুন ধরনের ভার্চ্যুয়াল মুদ্রার প্রচলন করে। এ ধরনের মুদ্রা ক্রিপ্টোকারেন্সি নামে পরিচিতি পায়। নাকামোতোর উদ্ভাবিত সে ক্রিপ্টোকারেন্সির নাম দেওয়া হয় বিটকয়েন।
বিটকয়েন লেনদেনে কোনো ব্যাংকিং ব্যবস্থা নেই। ইলেকট্রনিক মাধ্যমে অনলাইনে দুজন ব্যবহারকারীর মধ্যে সরাসরি (পিয়ার-টু-পিয়ার) আদান-প্রদান হয়। লেনদেনের নিরাপত্তার জন্য ব্যবহার করা হয় ক্রিপ্টোগ্রাফি নামের পদ্ধতি। সাম্প্রতিক সময়ে বিটকয়েন আলোচনায় আসার কারণ মূল্যস্ফীতি। বিটকয়েনে যারা বিনিয়োগ করেছিল, হঠাৎই তাদের সম্পদ বেড়েছে কয়েক শ গুণ।
তবে এই ক্রিপ্টোকারেন্সি কি এ বার বিষিয়ে তুলছে পৃথিবীর পরিবেশও? পরোক্ষে অন্যতম কারণ হয়ে উঠতে চলেছে আরও বেশি পরিমাণে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের? আরও দ্রুত হারে পৃথিবীর উষ্ণায়নের? সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় মিলল সেই ইঙ্গিত। জানাল, ক্রিপ্টোকারেন্সি যুগের প্রধান হাতিয়ার বিটকয়েনই পৃথিবীর পরিবেশ আরও বিষাক্ত হয়ে ওঠার কারণ হয়ে উঠেছে।
চীনে নিষিদ্ধের পর কেন বাতাসে ছড়াচ্ছে বিষ?
ক্রিপ্টোকারেন্সি-বিষয়ক যেকোনো কর্মকাণ্ড অবৈধ ঘোষণা করেছে চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে বিটকয়েনের মতো হাজারো ভার্চ্যুয়াল মুদ্রা কার্যত নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো দেশটিতে। পিপলস ব্যাংক অব চায়না এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ভার্চ্যুয়াল মুদ্রাসংক্রান্ত ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড হলো অবৈধ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। এতে জনগণের সম্পত্তির নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়।
বিশ্বের বড় ক্রিপ্টোকারেন্সি বাজারগুলোর একটি চীন। দেশটির বড় কোনো ঘটনা ক্রিপ্টোকারেন্সির বৈশ্বিক দরে প্রভাব ফেলে। যেমন নিষিদ্ধকরণের ঘোষণায় বিটকয়েনের দাম এক ধাক্কায় কমেছে দুই হাজার ডলারের বেশি। ক্রিপ্টোকারেন্সিকে অবৈধভাবে অর্থ পাচারের মাধ্যম মনে করে চীন। দীর্ঘদিন ধরে এমন মুদ্রার ওপর খড়গহস্ত দেশটি। গতকালের ঘোষণা সেটিরই অংশ।
২০১৯ সালে চীনে ক্রিপ্টোকারেন্সির কেনাবেচা সরকারিভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে অনলাইনে বৈদেশিক অর্থ লেনদেনের মাধ্যমগুলোতে তা চালু ছিল। তবে গত বছর চীন সরকারকে বেশ কঠোর হতে দেখা গেছে।
বিটকয়েন নির্মাতা ও শ্রমিকদের চীনে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তার পরিণতিতে মূলত জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভর করে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎশক্তির উৎপাদন হয় যে সব দেশে, আমেরিকা-সহ সেই সব দেশে ছড়িয়ে পড়েছেন বিটকয়েন নির্মাতা ও শ্রমিকরা।
তাদের কাজও চলছে এখন সেই সব দেশে। ফলে, আমেরিকা-সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন। যার জেরে উষ্ণায়নের রথের রশির লাগাম টেনে ধরা আরও মুশকিল হয়ে উঠতে চলেছে।
গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকা ‘জুল’-এ। প্রকাশিত হয়েছে গতকাল সোমবার।
বিটকয়েন তৈরি করার পদ্ধতির নাম— ‘বিটকয়েন মাইনিং’। খনি থেকে বিটকয়েন উত্তোলন করা হয় না যদিও। নতুন নতুন বিটকয়েন তৈরি হয় কম্পিউটারে। সেই কম্পিউটারগুলিকে অত্যন্ত শক্তিশালী হতে হয়। আর সেই কম্পিউটারগুলি চালাতে প্রয়োজন হয় প্রচুর পরিমাণে বিদ্যুৎশক্তির।
সেই বিদ্যুৎশক্তির প্রয়োজন মেটাতেই বিটকয়েন নির্মাতা ও শ্রমিকরা গোড়ার দিকে বেছে নিয়েছিলেন চীনকে। বেজিং-সহ চীনের প্রায় সর্বত্রই বিশাল বিশাল জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থাকায়। জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র চালাতে জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভর করতে হয় না।
সেখান বিদ্যুৎশক্তির উৎপাদন হয় নদীর জলপ্রবাহের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে। কিন্তু ২০১৩ সাল থেকেই চীন বিটকয়েন রুখতে বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠে। পরের কয়েক বছরে দেশের ব্যাঙ্কগুলির ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে শুরু করে বেজিং। তার পর গোটা চীনেই বিটকয়েন নিষিদ্ধ হয়।
এর পরেই যারা বিটকয়েন তৈরি করেন সেই নির্মাতা ও শ্রমিকরা বাঁচার তাগিদে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেন মূলত আমেরিকা, কাজাখস্তান-সহ বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে। যে দেশগুলিতে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎশক্তির বড় অংশের উৎপাদন হয় জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভর করে।
এর ফলে, আমেরিকা-সহ বিশ্বের বহু দেশে আরও বেশি পরিমাণে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের কারণ হয়ে উঠেছে ক্রিপ্টোকারেন্সি— বিটকয়েন।
চীনে কাজকর্ম নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ার পর বিটকয়েন নির্মাতা ও শ্রমিকরা এখন কোন কোন দেশের কোন কোন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছেন তা জানতে গবেষকরা কেম্ব্রিজ সেন্টার ফর অলটারনেটিভ ফিনান্স-এর মাধ্যমে বিটকয়েন নির্মাতা ও শ্রমিকদের ব্যবহার করা আইপি অ্যাড্রেসগুলি সংগ্রহ করেন। সেগুলি খতিয়ে দেখেন।
তাতে দেখা গিয়েছে, বিটকয়েন নির্মাতারা এখন তাদের কাজের ক্ষেত্র হিসাবে মূলত বেছে নিয়েছে আমেরিকা, কাজাখস্তান-সহ বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশকে। ওই সব দেশেই প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎশক্তির বড় অংশেরই উৎপাদন হয় জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভর করে।
বিটকয়েন নির্মাতাদের এখন পছন্দের জায়গা যেগুলি সেই আমেরিকার টেক্সাস, কেনটাকি ও জর্জিয়াতেও প্রয়োজনীয় বি়দ্যুৎশক্তির সিংহভাগেরই উৎপাদন হয় কয়লা ও প্রাকৃতিক গ্যাসের মতো জীবাশ্ম জ্বালানির নির্ভরতায়।
বিটকয়েন নির্মাতাদের পরবর্তী লক্ষ্যগুলির মধ্যে রয়েছে ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও ইউরোপের কয়েকটি দেশও যেখানে বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদনের বড় বল-ভরসা এখনও জীবাশ্ম জ্বালানিই।
এর ফলে, বিটকয়েন উৎপাদন আর কয়েক বছরের মধ্যে বিশ্বে আরও বেশি পরিমাণে গ্রিনহাউস নির্গমনের অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে উঠতে চলেছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন গবেষকরা।
জ্বালানি নিয়ে উদ্বেগ
এদিকে, কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিটকয়েনে বিদ্যুত ব্যবহারের সূচক বলছে ইউক্রেন বা নরওয়ের মত দেশে সারা দেশের জন্য যে পরিমাণ বিদ্যুতের প্রয়োজন হয় তার থেকেও বেশি বিদ্যুতের দরকার হয় বিটকয়েন মাইনিং করতে।
এই জ্বালানির কতটা নবায়নযোগ্য তা জানা নেই, তবে জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ডানা ইয়েমলিওনক বলছেন যে কাজাখস্তানে ব্যবহৃত জ্বালানির মাত্র ২% আসে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে।
তিনি বলেন, এখানে জ্বালানি মূলত কয়লা নির্ভর- বিশেষ করে তাপ ও বিদ্যুতের জন্য যে জ্বালানি ব্যবহার করা হয়, তার উৎস কয়লা। ক্রিপ্টোকারেন্সি মাইনিং যেভাবে বেড়েছে তাতে জ্বালানির ঘাটতি দেখা দিতে পারে এমন উদ্বেগও তৈরি হয়েছে।
প্রসঙ্গত, চীন গত বছর যখন হঠাৎ করেই ক্রিপ্টোকারেন্সির খনিগুলো নিষিদ্ধ করে দেয়, তখন থেকেই প্রতিবেশি কাজাখস্তানে এই ব্যবসা দ্রুত প্রসার লাভ করতে শুরু করে। বিটকয়েন, যা ক্রিপ্টো মুদ্রা নামে পরিচিত তার খনি ব্যবসায় বা কয়েন মাইনিং-এ মধ্য এশিয়ার এই দেশটি এখন দ্বিতীয় স্থানে। এই ব্যবসায় প্রথম স্থানে রয়েছে আমেরিকা।
কাজাখস্তানের সরকার বলছে এক বছরে যে পরিমাণ মুদ্রা মাইনিং হয়েছে, তাতে দেশ জুড়ে এক বছরে জ্বালানির চাহিদা ৭-৮% বেড়েছে। দেশটিতে ক্রিপ্টোমুদ্রা খননের কাজে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ ব্যবহার হচ্ছে তা কাজাখস্তানের একটি বড় শহরের আলোর চাহিদা মেটানোর জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানির সমান।
ডানা থাকেন কারাগান্ডা নামে একটি শহরে, যেখানে কাজাখস্তানের সবচেয়ে বড় কয়লাখনি রয়েছে। তার সন্দেহ, ক্রিপ্টোকারেন্সি মাইনিং থেকে দেশটি যে সম্পদ আয় করছে তার থেকে দেশটিকে পরিবেশের জন্য যে মাশুল দিতে হচ্ছে তা অনেক বেশি।
প্রতিদিন ঘর থেকে বেরলেই দূষণের মাত্রা আমার চোখে পড়ে। শীতকালে যখন বাতাস থাকে না, তখন দূষণে পাশের বাড়িটাও দেখা যায় না। তারা আয় করবে আর তার জন্য কেন এই দূষিত বাতাসে আমাকে নিঃশ্বাস নিতে হবে?
এসডব্লিউ/এসএস/১৪২০
আপনার মতামত জানানঃ