ইউক্রেন সীমান্তে প্রায় এক লাখ সেনা মোতায়েন করে রেখেছে প্রতিবেশী দেশ রাশিয়া। যেকোনো মুহূর্তে রুশ সেনারা দেশটিতে আক্রমণ করতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও ইঙ্গিত দিয়েছে যে, আগামী বুধবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) ইউক্রেনে হানা দেওয়ার পরিকল্পনা করছে রাশিয়া। তবে রাশিয়ার কর্তৃপক্ষ এ ধরনের কথাবার্তাকে মার্কিন ‘প্রোপাগান্ডা’ বলে অভিহিত করেছে।
জার্মানির ডের স্পিগেল পত্রিকা গত শনিবার ইউক্রেনে সম্ভাব্য রুশ হামলার দিনক্ষণ–সম্পর্কিত খবরটি প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (সিআইএ) ও সামরিক সূত্র উভয়ই ন্যাটো জোটের সদস্যদের ইউক্রেনে সম্ভাব্য রুশ হামলার বিষয়ে সতর্ক করেছে। এই জরুরি সতর্কতায় বলা হয়, বুধবার ভোরের দিকে ইউক্রেনে হামলা শুরু করতে পারে রাশিয়া।
পশ্চিমাদের ভাষ্যমতে, মস্কো সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ইউক্রেন সীমান্তে এক লাখের বেশি সেনা মোতায়েন করেছে। সীমান্তে এই রুশ সেনা মোতায়েনের উদ্দেশ্য হলো ইউক্রেনে হামলা চালানো।
তবে ইউক্রেনে হামলা চালানোর পরিকল্পনা অস্বীকার করে আসছে রাশিয়া। মস্কো বলছে, পূর্ব ইউরোপে ন্যাটো জোটের ক্রমবর্ধমান বিস্তৃতির জন্য তারা হুমকি বোধ করছে।
ইউক্রেন সংকট নিষ্পত্তির জন্য জোর কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চলছে। পাশাপাশি উভয় পক্ষ সামরিক প্রস্তুতিও নিচ্ছে।
ইউক্রেন ইস্যু নিয়ে গত শুক্রবার পশ্চিমা শীর্ষ রাজনীতিবিদেরা টেলিফোনে আলাপ-আলোচনা করেছেন।
ইউরোপের বিভিন্ন পত্রপত্রিকা জানিয়েছে, পশ্চিমা শীর্ষ নেতাদের আলোচনার মূল বিষয়বস্তু ছিল—রাশিয়ার সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তি করে ইউরোপে যুদ্ধ প্রতিরোধ করা।
একটি সংক্ষিপ্ত নোটিশে পশ্চিমা নেতাদের মধ্যে এই টেলিফোন কনফারেন্স হয়। ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন হলে করণীয় বিষয়ে পশ্চিমা নেতারা একমত হয়েছেন।
আলোচনায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস, ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ও অন্যান্য ইউরোপীয় রাষ্ট্র-সরকারপ্রধানেরা অংশ নেন।
ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেয়েন প্রথমবারের মতো রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইইউর সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে কথা বলেছেন।
এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বাসভবন হোয়াইট হাউসের ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার জ্যাক সুলিভান আবারও বলেছেন যে, ইউক্রেনে যেকোনো দিন হামলা করতে পারে রাশিয়া। একইসঙ্গে হামলার শিকার হলে ইউক্রেনকে সহায়তার কথাও পুনর্ব্যাক্ত করেছে বাইডেন প্রশাসন।
বুধবার ইউক্রেনে রাশিয়ার সম্ভাব্য হামলার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে রোববার মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন’র স্টেট অব দ্য ইউনিয়ন অনুষ্ঠানে জ্যাক সুলিভান বলেন, ‘আমরা কোনো দিনের কথা নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। কিন্তু আমরা বলে আসছি যে, আমরা এমন এক অবস্থায় রয়েছি, যখন যেকোনো দিন ইউক্রেনে রাশিয়ার বড় ধরনের সামরিক অভিযান শুরু হতে পারে। এটি এমনকি অলিম্পিক শেষ হওয়ার আগে সামনের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেও হতে পারে।’
পশ্চিমাদের ভাষ্যমতে, মস্কো সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ইউক্রেন সীমান্তে এক লাখের বেশি সেনা মোতায়েন করেছে। সীমান্তে এই রুশ সেনা মোতায়েনের উদ্দেশ্য হলো ইউক্রেনে হামলা চালানো।
পরে সিবিএস’র ‘ফেস দ্য নেশন’ অনুষ্ঠানে দেওয়া পৃথক সাক্ষাৎকারে হোয়াইট হাউসের এই ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার বলেন, ‘সামরিক জোট ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত প্রতি ইঞ্চি ভূখণ্ড আমরা রক্ষা করবো। এবং আমরা মনে করি, রাশিয়া আমাদের এই বার্তাটি পুরোপুরি জানে।’
অবশ্য যাকে নিয়ে এতো সংকট সেই ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য নয়। পূর্ব ইউরোপের এই দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন এই সামরিক জোটের সদস্য হতে আগ্রহী এবং মূলত এই জায়গাতেই রাশিয়ার আপত্তি রয়েছে।
এদিকে বুধবারই ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার সম্ভাবনার বিষয়টি নিশ্চিত করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দফতর পেন্টাগনের মুখপাত্র জন কিরবিও। ‘ফক্স নিউজ সানডে’ অনুষ্ঠানে রোববার দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘রুশ হামলার বিষয়ে সামনে আসা রিপোর্টগুলো নিশ্চিত করার মতো অবস্থানে আমি নেই।’
তবে রাশিয়া যেকোনো দিন ইউক্রেনে হামলা চালাতে পারে বলে উল্লেখ করেন জন কিরবি। তিনি আরও বলেন, ‘বিভিন্ন দিক থেকে আমরা তথ্য পাচ্ছি। আবার এসব তথ্যের সবগুলোই গোয়েন্দা সংস্থার এক্সক্লুসিভ তথ্য নয়। সোজা দৃষ্টিতে যা দেখা যায়, সেসব তথ্যও এর মধ্যে রয়েছে। ইউক্রেন সীমান্তে বর্তমানে এক লাখেরও বেশি রুশ সেনা অবস্থান করছে।’
ইউক্রেনে রাশিয়া হামলা চালাতে পারে বলে অনেকটা স্পষ্ট করে বলে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে পশ্চিমের সব নেতা বিষয়টিতে এত দিন ততটা গুরুত্ব দেননি। কিন্তু গতকাল থেকে পশ্চিমা নেতাদের ইউক্রেন পরিস্থিতি নিয়ে সত্যিকারের উদ্বেগ প্রকাশ করতে দেখা গেছে।
মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন ফেব্রুয়ারির শুরুতে পোল্যান্ডে ১ হাজার ৭০০ সেনা পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেখানে নতুনভাবে আরও তিন হাজার সেনা যোগ করা হচ্ছে বলে মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগনের এক মুখপাত্র জানিয়েছেন।
পেন্টাগনের ওই মুখপাত্র বলেন, ন্যাটো জোটভুক্ত মিত্রদের নিরাপত্তা প্রদান ও পূর্ব ইউরোপে সম্ভাব্য রুশ আগ্রাসন প্রতিরোধ করার জন্যই পোল্যান্ডে অতিরিক্ত মার্কিন সেনার সমাবেশ ঘটানো হয়েছে।
এ ছাড়া মার্কিন এফ-১৬ যুদ্ধবিমানগুলোকে জার্মানিতে অবস্থিত ঘাঁটি থেকে কৃষ্ণ সাগরের নিকটবর্তী রুমানিয়ার একটি ঘাঁটিতে স্থানান্তর করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভানের উদ্ধৃতি দিয়ে জার্মানির ডের স্পিগেল পত্রিকা জানিয়েছে, বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত শীতকালীন অলিম্পিক চলাকালেই ইউক্রেনে রুশ আক্রমণ শুরু হয়ে যেতে পারে। এই আক্রমণ সম্ভবত যুদ্ধবিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে শুরু হবে। যাতে বেসামরিক লোকজন নিহত হতে পারে।
জ্যাক সুলিভান মার্কিন নাগরিকদের ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ইউক্রেন ছেড়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
অন্যান্য ইউরোপীয় দেশও নিজ নিজ নাগরিকদের ইউক্রেন ছাড়তে বলেছে।
ইউক্রেনে বর্তমানে গুরুতর ও অপ্রত্যাশিত অবস্থার বিরাজ করার কথা বলেছে নরওয়ে।
কানাডা তার নাগরিকদের সতর্ক করে বলেছে, রাশিয়ার সামরিক পদক্ষেপ শুরু হলে বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশে ভ্রমণ ব্যাহত হতে পারে।
ইসরায়েল তার কূটনীতিকদের পরিবারের সদস্যদের ইউক্রেন থেকে বের করে আনার পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে।
যুক্তরাজ্য, হল্যান্ড, ইতালি, স্পেন ও লিথুয়ানিয়ার সরকার তাদের নাগরিকদের ইউক্রেন ছেড়ে যেতে বা সাবধানতা অবলম্বন করতে পরামর্শ দিয়েছে।
গতকাল জার্মানির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জরুরি কাজ ছাড়া দেশটির নাগরিকদের ইউক্রেন ভ্রমণে সতর্কতা জারি করেছে।
নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়াও তাদের নাগরিকদের ইউক্রেন ছাড়ার আহ্বান জানিয়েছে।
জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ আগামীকাল সোমবার কিয়েভ ও মঙ্গলবার মস্কো যাবেন। উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে তিনি মস্কোতে প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে আলাপ করবেন।
গত দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে ইউক্রেন-রাশিয়া সীমান্তে প্রায় ১ লাখ রুশ সেনা মোতায়েন রেখেছে রাশিয়া। সীমান্তের পাশাপাশি ২০১৫ সালে ইউক্রেনের কাছে থেকে দখল নেওয়া দ্বীপ ক্রিমিয়াতেও সম্প্রতি বাড়ানো হয়েছে সেনা উপস্থিতি; এছাড়া গত সপ্তাহে কৃষ্ণ সাগরে সামরিক মহড়া শুরু করেছে রাশিয়া।
এই পরিস্থিতিতে খুবি স্বাভাবিকভাবেই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে ইউক্রেন ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো। পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন (ন্যাটো), যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোর আশঙ্কা, ইউক্রেনে যে কোনো সময় হামলা চালাতে পারে রাশিয়া। তবে এই আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে মস্কো জানিয়েছে, ইউক্রেনে হামলার কোনো পরিকল্পনা রাশিয়ার নেই।
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অঙ্গরাজ্য ও রাশিয়ার প্রতিবেশীরাষ্ট্র ইউক্রেন কয়েক বছর আগে ন্যাটোর সদস্যপদের জন্য আবেদন করার পর থেকেই উত্তেজনা শুরু হয়েছে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে। সম্প্রতি ন্যাটো ইউক্রেনকে সদস্যপদ না দিলেও ‘সহযোগী দেশ’ হিসেবে মনোনীত করার পর আরও বেড়েছে এই উত্তেজনা।
১৯৪৯ সালে গঠিত ন্যাটোকে রাশিয়া বরাবরই পাশ্চাত্য শক্তিসমূহের আধিপত্য বিস্তারের হাতিয়ার হিসেবে মনে করে; এবং ঐতিহাসিকভাবেই বিশ্বের বৃহত্তম দেশ রাশিয়া পাশ্চাত্য আধিপিত্যবাদের বিরোধী।
এদিকে, লন্ডনে নিযুক্ত ইউক্রেনের রাষ্ট্রদূত ভ্যাদিম প্রিসতাইকো বিবিসিকে গতকাল জানিয়েছেন, রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ এড়াতে ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্যপদের আবেদন প্রত্যাহার করার বিষয়টি বিবেচনা করতে প্রস্তুত; কিন্তু একই সঙ্গে তিনি বলেন, একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ন্যাটোর সদস্যপদের জন্য আবেদন করা ইউক্রেনের সাংবিধানিক অধিকার।
সোমবার বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্র কুলেবা জানান, ইউরোপের দেশগুলোর প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বিষয়ক সংস্থা অর্গানাইজেশন ফর সিকিউরিটি অ্যান্ড কোঅপারেশন ইন ইউরোপ (ওএসসিই) মাধ্যমে রাশিয়াকে বৈঠকের আহ্বান জানানো হবে।
ওএসসিইর সদস্য রাষ্ট্ররা পরস্পরের সামরিক তৎপরতা নিয়ে একে অন্যকে প্রশ্ন করতে পারে। রাশিয়া নিজেও এই সংস্থার সদস্য।
বিবিসিকে কুলেবা বলেন, ‘রাশিয়া যদি সত্যিই ওসসিইকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে, তাহলে অবশ্যই সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী সীমান্তে সেনা মোতায়েনের কারণ স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করবে মস্কো।’
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদমির জেলেনস্কি অবশ্য জানিয়েছেন, আসছে দিনগুলোতে রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালাতে পারে- এমন কোনো প্রমাণ তিনি পাননি।
রোববার জেলেনস্কির সঙ্গে প্রায় ১ ঘণ্টা টেলিফোনে কথা বলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এ সময় ইউক্রেনের প্রতি ‘অটুট সমর্থনের’ প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।
জবাবে জেলেনস্কি ধন্যবাদ জানিয়ে বাইডেনকে ইউক্রেন সফরের আমন্ত্রণ জানান। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট সেই আবেদন গ্রহণ করেছেন কিনা— সে বিষয়ে এখনও কিছু বলেনি হোয়াইট হাউস।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮০৫
আপনার মতামত জানানঃ