বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারির প্রভাব ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। ফলশ্রুতিতে অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত ভারতে বেকার হয়ে পড়েছে লাখ লাখ যুবক। সেই বেকারদের একাংশ হতাশ হয়ে বেছে নিচ্ছেন আত্মহত্যার পথ। বেকারত্ব ছাড়াও নানা কারণেই ভারতে বাড়ছে আত্মহত্যা। উদ্বেগের বিষয় হলো দিন দিন এর সংখ্যা বাড়ছেই।
মোদী সরকারের জমানায় মাত্র দু’বছরে ঋণের জ্বালা আর বেকারত্বে ২৫ হাজার ভারতীয় আত্মহত্যা করেছেন। ২০১৮ থেকে ২০২০-র মধ্যে এইসব আত্মহত্যাগুলো ঘটেছে। বুধবার সংসদে বেকারত্ব সংক্রান্ত আলোচনার ভাষণে এমনই জানালেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রাই।
তার দেওয়ার তথ্য মতে, ভারতে ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে এসব আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। এরমধ্যে বেকারত্বের কারণে ৯ হাজার ১৪০ জন এবং ঋণের জালে জর্জরিত হয়ে ১৬ হাজার ৯১ জন আত্মহত্যা করেছেন।
ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর (এনসিআরবি) তথ্য তুলে ধরে নিত্যানন্দ রাই বলেন, ২০১৮ সালে ভারতে বেকারত্বের কারণে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৭৪১ জন, ২০১৯ সালে সেটা বেড়ে হয় ২ হাজার ৮৫১ জন এবং ২০২০ সালে এই সংখ্যা বেড়ে হয় দাঁড়ায় ৩ হাজার ৫৪৮ জন।
এছাড়া ঋণে জর্জরিত হয়ে ২০১৮ সালে আত্মহত্যা করেন ৪ হাজার ৯৭০ জন, ২০১৯ সালে ৫ হাজার ৯০৮ জন এবং ২০২০ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫ হাজার ২১৩ জন।
ভারতে এবারের বাজেট অধিবেশনে বারবার বেকারত্বের প্রসঙ্গ উঠেছে। বিভিন্ন বিরোধী দলের সাংসদরা বারবার অভিযোগ করেছেন, বাজেট সুরাহা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। করোনা আবহে দেশে কর্মহীনতার সংখ্যা বেড়েছে।
এই পরিস্থিতিতে বিরোধীদের লাগাতার চাপের মুখে রাই জানিয়েছেন, সরকারের বিষয়টির ওপর নজর আছে। বেকারত্ব এবং ঋণে জর্জরিত হয়ে যাতে নাগরিকরা মানসিকভাবে ভেঙে না-পড়েন, সরকার সেটা দেখছে। পাশাপাশি, কর্মসংস্থানের সুযোগও যাতে সৃষ্টি হয়, তা-ও নিশ্চিত করতে চাইছে।
তিনি জানান, মানসিক স্বাস্থ্য আরও মজবুত করতে সরকার দেশের ৬৯২ জেলায় মানসিক স্বাস্থ্য কর্মসূচি চালাচ্ছে। একইসঙ্গে দেশজুড়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য কর্মসূচিরও প্রসার ঘটাচ্ছে। এই সব কর্মসূচিতে আত্মহত্যা প্রতিরোধ, কর্মক্ষেত্রে চাপ হ্রাস, দক্ষতা বৃদ্ধি এবং স্কুল-কলেজে কাউন্সেলিংয়ের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে।
কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী সম্প্রতি বেকারত্ব ইস্যুতে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে তীব্র আক্রমণ করেছিলেন। রাহুলের অভিযোগ ছিল, গত ৫০ বছরে দেশে বেকারত্বের হার শীর্ষে পৌঁছেছে।
ঋণে জর্জরিত হয়ে ২০১৮ সালে আত্মহত্যা করেন ৪ হাজার ৯৭০ জন, ২০১৯ সালে ৫ হাজার ৯০৮ জন এবং ২০২০ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫ হাজার ২১৩ জন।
রাহুল দাবি করেছিলেন, ইউপিএ সরকার ১০ বছরে দেশের ২৭ কোটি নাগরিককে বেকারত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছিল। আর, নরেন্দ্র মোদী সরকারের জমানায় ইতিমধ্যেই দেশের ২৩ কোটি নাগরিক বেকারত্বের মুখে পড়েছে। রাহুলের সেই দাবি যে নেহাত মিথ্যে নয়, তা যেন এবার প্রমাণ করে দিল কেন্দ্রীয় সরকারেরই দেওয়া বেকারত্বের কারণে আত্মহত্যার পরিসংখ্যান।
করোনা প্রাদুর্ভাবের আগেই ভারতে বেকারত্বের হার পৌঁছে যায় ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে। অতিমারির কারণে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে বলেই আশঙ্কা।
২০২০ সালে মার্চে করোনার হানার পর থেকেই ভারতে কাজের বাজার বিপর্যস্ত। দীর্ঘ লকডাউনের ধাক্কায় ২০২০ সালের এপ্রিল ও মে মাসে বেকারত্বের হার ২০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। এরপর লকডাউন শিথিল হওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে তা ধীরে ধীরে নামতে থাকে।
কিন্তু মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ে সে পরিস্থিতি বদলে যায়। সংক্রমণ রোধ করতে রাজ্যগুলো স্থানীয় লকডাউন এবং বিধিনিষেধের পথে হাঁটায় আবারও বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পায়। বাড়তে বাড়তে মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে ভারতে বেকারত্বের হার দুই অঙ্ক পেরিয়ে যায়। বিধিনিষেধ শিথিল হওয়ায় তা আবারও কমতে থাকে। সংশ্লিষ্ট মহলের ব্যাখ্যা, আর্থিক কর্মকাণ্ডে গতি আসা এবং বর্ষা মৌসুমের ওপর নির্ভর করেই বদলে যায় কাজের বাজারের অবস্থা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থনীতির গতি কমে যাওয়ায় গত বছর লকডাউনের আগে থেকেই বেকারত্ব বাড়ছিল। ফলে করোনা মোকাবিলায় পুরো দেশ ঘরবন্দি হতেই বেকারত্বের হার অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল। পরবর্তীকালে আর্থিক কর্মকাণ্ড শুরু হলে বেকারত্বের হার কমতে শুরু করে বটে, কিন্তু কর্মসংস্থানের গতি প্রত্যাশার তুলনায় অনেক পিছিয়েই ছিল। কাজকর্ম শুরু হলেও নিয়োগে ধারাবাহিক উন্নতি তেমন একটা চোখে পড়েনি।
মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা না দিলে এবং প্রতিষেধক প্রয়োগের সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে তাকে শুরুতেই শক্ত হাতে থামানো গেলে ভয় কাটত বলে মনে করছেন ভারতের সংশ্লিষ্ট মহল। তাদের মতে, উৎপাদন এবং পরিষেবা বৃদ্ধির হাত ধরে অর্থনীতি দ্রুত ঘুরে দাঁড়ানো নিশ্চিত হলে নিয়োগও বাড়ত। কিন্তু সিএমআইই তথ্য বলছে, এপ্রিলে তা তো হয়নি, বরং কর্মী আরও কমেছে। এমনকি কাজ খুঁজতেও বেরিয়েছেন অনেক কম মানুষ।
পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, আত্মহত্যার এই ঘটনা ভারতে মানুষের বেঁচে থাকার গভীর অনিচ্ছার ছবি ফুটিয়ে তুলেছে।
তাদের মতে, ‘এটা বেশিরভাগ ভারতীয়দের জন্য বড় ধাক্কা। সমৃদ্ধ পশ্চিমাঞ্চলে মুম্বাইয়ের মতো বড় শহর ও বন্দর রয়েছে। পাশেই রয়েছে ভারতের বাণিজ্য কেন্দ্র গুজরাট রাজ্য। সেখানে বড় বড় প্রকল্পে হাজার হাজার কোটি রুপি বিনিয়োগ করা হয়। প্রতিদিন কাজের সন্ধানে বিভিন্ন রাজ্য থেকে হাজার হাজার মানুষ সেখানে চলে যায়। তারপরও যদি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে, তাহলে বুঝতে হবে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের অর্থনৈতিক অবস্থা আসলেই অনেক ভয়াবহ।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৫৬
আপনার মতামত জানানঃ