তামাক ব্যবহারের ফলে দেশে প্রতি বছর এক লাখ ৬১ হাজার মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। পঙ্গুত্ব বরণ করছে আরও কয়েক লাখ মানুষ।
শনিবার ‘তামাক কর ও মূল্য পদক্ষেপ: কোম্পানির কূটকৌশল ও আমাদের করণীয়’ শীর্ষক ওয়েবিনারে এ তথ্য জানান তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক প্রকল্প প্রধান হাসান শাহরিয়ার।
এসময় জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় বাজেটে তামাকের ওপর কর ও মূল্য বৃদ্ধির দাবি জানান তামাকবিরোধী সংগঠনের নেতারা।
বক্তারা বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২১ সালের তথ্যমতে, সবচেয়ে কম দামে সিগারেট পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৫টি দেশের মধ্যে ১০৭তম। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে সবচেয়ে কম দামি সিগারেটের মূল্য বাংলাদেশের কম দামি সিগারেটের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। কার্যকর করারোপের অভাবেই দেশে সিগারেট সস্তা থেকে যাচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের ২০১৯ সালের প্রতিবেদনের বরাতে ওয়েবিনারে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে সিগারেটের অবৈধ বাণিজ্য ২৭টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম, মাত্র ১ দশমিক ৮ শতাংশ। সুতরাং সিগারেটের রাজস্ব ফাঁকি তথা অবৈধ বাণিজ্য নিয়ে যে প্রচারণা তা নীতিনির্ধারকদের বিভ্রান্ত করার প্রচেষ্টা মাত্র। সিগারেট থেকে যে রাজস্ব আসে তার প্রায় পুরোটাই (৯৬ শতাংশ) ভোক্তা প্রদান করে পরোক্ষ কর হিসেবে। কাজেই সিগারেট কোম্পানিগুলো সবচেয়ে বেশি কর দেয় এটি মোটেও সত্য নয়।
অন্যদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের বিড়িশিল্পে কর্মরত নিয়মিত-অনিয়মিত এবং চুক্তিভিক্তিক মিলিয়ে পূর্ণ সময় কাজ করার সমতুল্য শ্রমিক সংখ্যা মাত্র ৪৬ হাজার ৯১৬ জন। বিড়ি শ্রমিকদের সংখ্যা নিয়ে মালিকপক্ষ এ ধরনের অসত্য তথ্য প্রচার করে নীতিনির্ধারকদের কাছ থেকে সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করেন।
ওয়েবিনারে আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডস (সিটিএফকে) বাংলাদেশের লিড পলিসি অ্যাডভাইজর মো. মোস্তাফিজুর রহমান, ভাইটাল স্ট্রাটেজিস’র বাংলাদেশ কান্ট্রি অ্যাডভাইজার মো. শফিকুল ইসলাম, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের ইপিডেমিওলজি অ্যান্ড রিসার্চ বিভাগের অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী।
এসময় জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় তামাক কোম্পানির প্রভাবমুক্ত থেকে তামাকে বেশি কর আরোপের দাবি জানান তামাকবিরোধী নেতারা।
ওয়েবিনারে আরও জানানো হয়, কর-প্রণেতাদের প্রভাবিত করতে সংসদ সদস্যদের মাধ্যমে ডিও লেটার প্রদান, সুবিধাভোগী অর্থনীতিবিদদের দিয়ে পত্রিকায় কলাম প্রকাশ, মিডিয়া ক্যাম্পেইন, বিড়ি শ্রমিকদের ব্যবহার করে দেশব্যাপী তথাকথিত আন্দোলন, বিদেশি কূটনীতিকদের দিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি প্রেরণ এবং বিভিন্ন ব্যবসায়িক সংগঠনের মাধ্যমে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে বৈঠক প্রভৃতি কার্যক্রম করে তামাক কোম্পানিগুলো।
ওয়েবিনারে অংশ নেওয়া তামাকবিরোধী সংগঠনসমূহের নেতারা জানান, তামাক কোম্পানিগুলো নীতিনির্ধারকদের বিভ্রান্ত করতেই কর ও মূল্যবৃদ্ধির বিপক্ষে বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরে।
তামাক ব্যবহারের ফলে দেশে প্রতি বছর এক লাখ ৬১ হাজার মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। পঙ্গুত্ব বরণ করছে আরও কয়েক লাখ মানুষ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তামাক ছাড়ার সুফল অনেক। যদি কোনো ব্যক্তি টানা ১ বছর তামাকমুক্ত থাকতে পারেন তবে, তার হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি ধূমপায়ীর তুলনায় অর্ধেক কমে যায় এবং ধূমপান ছাড়ার ১০ বছরের মধ্যে ফুসফুস ক্যানসারের ঝুঁকি অর্ধেকে নেমে আসে। এছাড়া ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সের মধ্যে তামাক ছাড়লে প্রত্যাশিত আয়ু তামাক ব্যবহারকারীর তুলনায় প্রায় ১০ বছর বেড়ে যায়।
তারা আরও বলছেন, শ্বাসতন্ত্র এবং হৃদরোগের অন্যতম প্রধান কারণ তামাক। তামাক ব্যবহারে করোনারি হার্ট ডিজিজ এবং স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি ২ থেকে ৪ গুণ বেড়ে যায় এবং মুখ গহ্বর, ফুসফুস, খাদ্যনালিসহ প্রায় ২০ ধরনের ক্যানসার হয়। অধূমপায়ীর তুলনায় ফুসফুস ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে ২৫ গুণ। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদি ফুসফুস সংক্রমণে (সিওপিডি) ধূমপায়ীদের মৃত্যুঝুঁকি অধূমপায়ীদের তুলনায় ১৩ গুণ পর্যন্ত বেশি।
সাম্প্রতিক কোভিড-১৯ মহামারিতে ধূমপায়ীদের গুরুতর অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ বেশি বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস) ২০১৭ অনুযায়ী, কর্মক্ষেত্রসহ পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে ৩ কোটি ৮৪ লাখ প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছে। বাড়িতে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছে ৪ কোটি ৮ লাখ মানুষ এবং এক্ষেত্রে নারীরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে।
সাম্প্রতিক গবেষণায় ঢাকার প্রাথমিক স্কুলে পড়া ৯৫ শতাংশ শিশুর শরীরে উচ্চমাত্রার নিকোটিন পাওয়া গেছে, এর মূল কারণ পরোক্ষ ধূমপান।
গ্যাটস ফলাফলে আরও দেখা গেছে, ২০০৯ সালের তুলনায় একজন বিড়ি সেবনকারীর বিড়ি বাবদ মাসিক খরচ বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। অন্যদিকে সিগারেট কিনতে একজন ধূমপায়ীর গড় মাসিক ব্যয় হয় ১০৭৭ দশমিক ৭ টাকা। অথচ শিক্ষা ও চিকিৎসার জন্য একটি পরিবারের মাসিক গড় ব্যয় যথাক্রমে মাত্র ৮৩৫ দশমিক ৭ টাকা।
তামাকের জন্য ব্যয়িত অর্থ শিক্ষা ও চিকিৎসা দারিদ্র্য তথা মানবদারিদ্র্য মোকাবিলায় ব্যয় করা গেলে পরিবারগুলোর জীবনমানে উন্নতি ঘটানো সম্ভব।
বিশ্লেষকরা বলেন, অতি গতিশীল সমাজে চিন্তায়-চেতনায় গতি থাকতে হবে। ধূমপান শিল্পের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। শুধুমাত্র কর বাড়িয়েই ধূমপান রোধ করতে পারব কি না, এটা ভেবে দেখার সময় এসেছে। বৃদ্ধি করা করের টাকা, স্বাস্থ্যখাতে ব্যবহার করা যেতে পারে। ধূমপানে বিষপান সে বিষয়টিই কেন এখনও তরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারি না, সেটা খতিয়ে দেখা দরকার। জনমত তৈরি করা দরকার। প্রাক-বাজেটের বেশির ভাগেই কর কমানো প্রস্তাব থাকে, কেবলমাত্র প্রজ্ঞা-আত্মার পক্ষ থেকে কর বৃদ্ধি প্রস্তাব সরকার গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে পারে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৫৯
আপনার মতামত জানানঃ