দাবানল, দাবদাহ, খরা, বন্যা, মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ও ঘূর্ণিঝড়ে বিশ্ব এখন বিপর্যস্ত। অঞ্চলভেদে বিভিন্ন দেশে এসব দুর্যোগ দেখা যাচ্ছে। চীন, ভারত ও জার্মানিতে চলতি মৌসুমে কয়েক দফা বন্যা, ঘূর্ণিঝড় হয়েছে। কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র স্মরণকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার মুখে পড়েছে। গ্রিস, তুরস্ক, ইতালিসহ দক্ষিণ ইউরোপ পুড়ছে দাবানলে। বেলজিয়ামসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশ রেকর্ড বৃষ্টিপাত দেখেছে। ব্রাজিল, মাদাগাস্কারসহ গোটা আফ্রিকা খরায় বিপর্যস্ত। জলবায়ুর এমন চরম বৈরিতার মুখে বিশ্ব।
বর্তমান বিশ্বে ব্যাপকভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীতে প্রতি বছর ত্বরিত গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে গড় তাপমাত্রার পরিমাণ। সাম্প্রতিক সময়ে অতিমাত্রা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এখন বিশ্বকে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের এই বিরূপ প্রভাবের কবলে পড়েছে ইউরোপ।
তাপপ্রবাহ, বন্যাসহ নানা বৈরী আবহাওয়ার কারণে গত ৪০ বছরে শুধু ইউরোপেই ১ লাখ ৪২ হাজার মানুষের প্রাণ গেছে বলে সম্প্রতি এক গবেষণায় উঠে এসেছে। এই সময়ে ব্যয় হয়েছে অন্তত ৫১০ বিলিয়ন ইউরো।
বৃহস্পতিবার (৩ ফেব্রুয়ারি) প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য। খবর স্ট্রেইটস টাইমস, এএফপি
ইউরোপের পরিবেশবিষয়ক সংস্থা (ইইএ) এই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ব্যক্তি ও রাষ্ট্রীয় উভয় পর্যায়ে অভিযোজন সমুন্নত রাখার আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি।
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ১৯৮০ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত আর্থিক ক্ষতির প্রায় ৬০ শতাংশের জন্য কয়েকটি বড় ঘটনাই দায়ী। মানুষের প্রাণহানির কথা বিবেচনায় নিলে দেখা যায় যে, ৯১ শতাংশ মানুষের মৃত্যুর জন্য তাপপ্রবাহ দায়ী। ২০০৩ সালে গ্রীষ্মকালীন তাপপ্রবাহে ইউরোপে অন্তত ৮০ হাজার মানুষ মারা যায়।
তবে ২০০৩ সালের পর তাপপ্রবাহজনিত মৃত্যু কমেছে বলে জানিয়েছে ইউরোপিয়ান এনভায়রনমেন্ট এজেন্সি। সংস্থাটি এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘যেহেতু বিভিন্ন দেশ ও ব্যক্তি তাপমাত্রা রোধে বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছে (যেমন এয়ারকন্ডিশন স্থাপন), ফলে তাপপ্রবাহজনিত মৃত্যু কমেছে। ইউরোপিয়ান এনভায়রনমেন্ট এজেন্সির পরিবেশ বিশেষজ্ঞ উটার ভ্যানেয়ুভ্যালি বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, ‘আবহাওয়া ও জলবায়ুর কারণে আমরা যেসব বিপদের কথা বলি, তার পেছনে জলবায়ু পরিস্থিত দায়ী।’
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার করা অনুমান বলছে, গত ৫০ বছরে আবহাওয়া-সম্পর্কিত বিপর্যয় বেড়ে গেছে। এতে বহু ক্ষয়ক্ষতি হলেও বিগত বছরগুলোতে মৃত্যু কম হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের কারণে ইউরোপে গত ৪০ বছরে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা নিরুপণ করা খুব সহজ নয়। ইইএ সংস্থাটি বলছে, গত ৪০ বছরের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বিষয়টি নিয়ে উপসংহারে পৌঁছানো যাবে না। কেননা একেক বছরের ক্ষয়ক্ষতির একেক রকম তথ্য দেয় জলবায়ু ও আবহাওয়া সম্পর্কিত তথ্য-উপাত্ত।
তাপপ্রবাহ, বন্যাসহ নানা বৈরী আবহাওয়ার কারণে গত ৪০ বছরে শুধু ইউরোপেই ১ লাখ ৪২ হাজার মানুষের প্রাণ গেছে বলে সম্প্রতি এক গবেষণায় উঠে এসেছে। এই সময়ে ব্যয় হয়েছে অন্তত ৫১০ বিলিয়ন ইউরো।
ইইএ’র বিশেষজ্ঞ ওয়াউটার ভ্যানেউভাইল বলেন, জলবায়ুর অবস্থার ওপর আবহাওয়া এবং জলবায়ু সম্পর্কিত বিপর্যয় ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণের এক্ষেত্রে প্রভাবিত করতে পারে। কিন্তু শুধু জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের কারণে যে ক্ষয়ক্ষতি হয় তা এক নয়।
তিনি বলেন, সম্প্রতি গবেষণায় আরও একটি বিষয় উঠে এসেছে যে, জলবায়ু পরিবর্তনে ইন্টারগর্ভনমেন্টাল প্যানেলের কাজ লক্ষ্য করলে যেটি পাওয় যায় তা হলো এখন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খরা ও দাবানলও বিপর্যয় ডেকে আনছে।
এছাড়া রয়েছে শিলাবৃষ্টিও। যদিও এখনও তথ্য প্রমাণের অভাব রয়েছে। ইউরোপে এখনো আকস্মিক ঝড়ের বিষয়টি অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। ফলে এর তথ্য উপাত্ত স্পষ্ট নয়।
শুধু ভূমধ্যসাগরেই নয়, ইউরোপের বেশিরভাগ অংশে জলবায়ু পূর্বাভাসের উপর ভিত্তি করে খরার মতো অবস্থা আরও তীব্র হতে পারে।
গত চার দশকে ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে জার্মানি। আবহাওয়াজনিত কারণে দেশটির ১০৭ মিলিয়ন ইউরো ক্ষতি হয়েছে এবং ভুক্তভোগীর সংখ্যা ৪২ হাজার। একই সময়ে ফ্রান্সে ক্ষতি হয়েছে ৯৯ বিলিয়ন ইউরো এবং মারা গেছে ২৬ হাজার ৭শ জন। ইতালিতে ক্ষতি হয়েছে ৯০ বিলিয়ন ইউরো এবং মারা গেছে ২১ হাজার ৬শ জন।
আর্থিক ক্ষতির ২৩ শতাংশ বিমার মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ দেওয়া সম্ভব হয়েছে। যদিও দেশভেদে বৈষম্যও প্রকট। রোমানিয়া ও লিথুনিয়ায় ১ শতাংশ ক্ষতিপূরণ পায় যেখানে নেদাল্যান্ডস ও ডেনমার্কে দেওয়া হয় ৫৫ ও ৫৬ শতাংশ।
একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রের আবহাওয়া সংস্থা এনওএএ’র তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮০ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র আবহাওয়াজনিত ৩১০টি দুর্যোগের কবলে পড়ে এবং ক্ষতি হয়েছে ২ হাজার ১৫৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এসব আবহাওয়াজনিত দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতির পরিসংখ্যানে ভূমিকম্প ও আগ্নেয়গিরি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, উন্নত দেশগুলো অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে যেভাবে প্রকৃতির সঙ্গে যথেচ্ছাচার করেছে, তাতে প্রকৃতি রুষ্ট হয়ে উঠেছে। কারণ, প্রকৃতি একটি জীবন্ত সত্তা, তাকে শুধু সম্পদ লাভের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। অথচ এ বিষয়টিকে আমলে না নিয়ে উন্নত দেশগুলো নিজেদের তথাকথিত উন্নয়নের স্বার্থে জলবায়ু তহবিল, কার্বন ট্রেড প্রভৃতি তৈরি করে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে টোপ দিয়ে যাচ্ছে।
তারা বলেন, জলবায়ু সম্মেলনগুলোর মূল সুরে সমস্যা সমাধানের কোনো ব্যাপার থাকে না। কারণ, এর মধ্য দিয়ে কার্বন নিঃসরণ কমানোর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। কিন্তু এমন একটা ভাব করা হয় যে সমস্যাটি আমলে নেওয়া হয়েছে। কথা হচ্ছে, দুনিয়ার উন্নয়নের মডেল যেন প্রকৃতির ওপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা না করে প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়, সেটাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
তারা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যাটি যেমন পরিবেশগত, তেমনি একই সঙ্গে তা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকও বটে। উন্নত দেশগুলোর কারণেই এই জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, ফলে তাদের কার্বন উদ্গিরণ হ্রাসে বাধ্য করতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন সদিচ্ছা, কার্যকর কূটনীতি ও রাজনীতি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪০১
আপনার মতামত জানানঃ