ফেসবুকের ১৮ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দৈনিক সক্রিয় গ্রাহকের সংখ্যা কমেছে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত শেষ ত্রৈমাসিকে ফেসবুকের সক্রিয় ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ১৯২ কোটি ৯০ লাখ। আগের ত্রৈমাসিকে এই সংখ্যা ছিল ১৯৩ কোটি।
ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটা প্ল্যাটফর্মসের শেয়ারের দাম গত বুধবার দিনের শেষে ২০ শতাংশের চেয়েও বেশি কমে গেছে। অ্যাপলের ডিভাইসে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার নীতিতে পরিবর্তন ও টিকটকের মতো প্রতিদ্বন্দ্বী প্ল্যাটফর্মের দিক থেকে বাড়তে থাকা প্রতিযোগিতার কথা উল্লেখ করে প্রত্যাশার চেয়ে দুর্বল পূর্বাভাষ প্রকাশ করে মেটা। এর পরই মূলত শেয়ারের দাম কমে যায়।
সম্প্রতি মার্ক জুকারবার্গ তার কোম্পানির নাম পরিবর্তন করে রেখেছেন মেটা। বুধবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এটি জানায়, গত বছরের চতুর্থ প্রান্তিকে কোম্পানিটির আয় প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম হয়েছে। কারণ এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে এটির ব্যবহারকারীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। যা শুরু থেকেই তাদের বড় বাজার হিসেবে বিবেচিত। তাছাড়া অন্যান্য অঞ্চলেও এটির ব্যবহারকারী কমেছে।
মেটা জানিয়েছে, অ্যাপলের অপারেটিং সিস্টেমে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার শর্ত পরিবর্তনের কারণে তারা সমস্যায় পড়েছে। এতে করে, বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো এখন ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে তাদের সম্ভাব্য গ্রাহকের কাছে বিজ্ঞাপন পৌঁছে দিতে ও এ সংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণে জটিলতার মুখে পড়ছে। এছাড়াও মেটা সাপ্লাই চেইনে বিঘ্নসহ অন্যান্য সামষ্টিক অর্থনীতির বিষয়ের উল্লেখ করেছে।
মেটা আরও জানায়, তারা টিকটক ও ইউটিউবের কাছ থেকে আরও বেশি প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হচ্ছে। ফেসবুক ব্যবহারকারীরা এখন ছোট ছোট ভিডিও ‘রিলের’ দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ছেন, কিন্তু সেগুলো থেকে আয়ের পরিমাণ অপেক্ষাকৃত কম। এ কারণে সার্বিকভাবে আয়ের প্রবৃদ্ধি কমে যেতে পারে বলে তারা আশঙ্কা করছেন।
ফেসবুক বছরের চতুর্থ প্রান্তিকে ২৯১ কোটি মাসিক সচল গ্রাহক দেখিয়েছে। এর আগের প্রান্তিকের সচল গ্রাহকের সংখ্যায় কোনো পরিবর্তন ছিল না। অর্থাৎ, সচল গ্রাহকের দিক দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি স্থবিরতায় ভুগছে।
গত বছরের প্রথম প্রান্তিকে কোম্পানিটির আয় ছিল দুই হাজার নয়শ কোটি ডলার যা এর আগের পূর্বাভাসকে অতিক্রম করতে সক্ষম হয়। এরপরেই মেটার শেয়ার দর ২০ শতাংশ কমে যায়। ফলে বাজার থেকে তাদের ১৭ হাজার ৫০০ কোটি ডলার হারিয়ে যায়।
মেটার প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা ডেভ ওয়েনার একটি কনফারেন্স কলে বিশ্লেষকদের জানান, অ্যাপলের গোপনীয়তা শর্ত পরিবর্তনের প্রভাব পুরো ২০২২ জুড়ে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের সমতুল্য হতে পারে।
গত বছরের চতুর্থ প্রান্তিকে কোম্পানিটির আয় প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম হয়েছে। কারণ এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে এটির ব্যবহারকারীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। যা শুরু থেকেই তাদের বড় বাজার হিসেবে বিবেচিত। তাছাড়া অন্যান্য অঞ্চলেও এটির ব্যবহারকারী কমেছে।
অ্যাপলের অপারেটিং সিস্টেমে পরিবর্তন আসার পর এখন আইফোন, আইপ্যাড ও অন্যান্য অ্যাপল ডিভাইসের ব্যবহারকারীরা অ্যাপগুলোকে তাদের অনলাইন কার্যক্রম বিশ্লেষণ থেকে বিরত রাখতে পারবেন। ভোক্তার পছন্দ ও অনলাইন কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণের জন্য ডিভাইস থেকে তথ্য সংগ্রহ করে প্রাসঙ্গিক বিজ্ঞাপন দেখায় সামাজিক মাধ্যমগুলো। অ্যাপল তার প্রাইভেসি পলিসিতে এই পরিবর্তনের কারণে বিজ্ঞাপনদাতাদের জন্য সঠিক তথ্য সংগ্রহ অনেক ঝামেলাপূর্ণ হয়ে গেছে। এটি এমন কি নতুন পণ্য তৈরি ও বাজার সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার প্রক্রিয়াকেও প্রভাবিত করতে পারে।
মেটা প্রথম প্রান্তিকের রাজস্ব পূর্বাভাষ দেখিয়েছে ২৭ বিলিয়ন থেকে ২৯ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে। তথ্য পর্যালোচনাকারী সংস্থা রিফাইনিটিভ এর দেওয়া আইবিইএস (ইনস্টিটিউশনাল ব্রোকার্স এস্টিমেট সিস্টেম) তথ্য অনুযায়ী, বিশ্লেষকরা ৩০ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলারের প্রত্যাশা করছিলেন।
বিশ্লেষক ডেব্রা আহো উইলিয়ামসন জানান, নিশ্চিতভাবেই মেটার জন্য সামনে আরও বড় বড় প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, বিশেষ করে বিজ্ঞাপন থেকে পাওয়া রাজস্বের ক্ষেত্রে।
সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, টিকটকের সঙ্গে প্রতিযোগিতা ও অ্যাপলের অপারেটিং সিস্টেমে পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে তাদেরকে উদ্যোগী হতে হবে, জানান ডেব্রা।
রিফাইনিটিভের তথ্য অনুযায়ী, মেটার রাজস্ব চতুর্থ প্রান্তিকে ৩৩ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছে, যেটি ১ বছর আগে ২৮ দশমিক শূন্য ৭ বিলিয়ন ছিল। বিশ্লেষকরা ধারণা করেছিলেন মূলত বিজ্ঞাপন থেকে আসা এই রাজস্বের পরিমাণ হবে ৩৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন।
প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মার্ক জাকারবার্গ আয়ের ঘোষণা দেওয়ার সময় বলেন, ‘আমরা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ খাতে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি, যেমন রিলস, কমার্স ও ভার্চুয়াল রিয়েলিটি, যেটি খুবই আশাব্যঞ্জক। আমরা ২০২২ এ এসব খাতে এবং অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ অব্যাহত রাখব এবং মেটাভার্স তৈরির কাজ আগাতে থাকবো।’
জাকারবার্গ বলেন, এখন অনেক বিকল্প ব্যবস্থা চালু রয়েছে। মানুষ টিকটকের মতো অ্যাপসগুলো ব্যবহার করছে। এসব অ্যাপসের দ্রুত উত্থান হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
জানা গেছে, গত বছরের শেষ প্রান্তিকে কোম্পানিটির আয় হয় তিন হাজার তিনশ কোটি ডলারের বেশি। যা বছরের তুলনায় ২০ শতাংশ বেশি। তবে এ সময়ে নেট আয় আট শতাংশ কমে দাঁড়ায় এক হাজার ৩০ কোটি ডলারে।
কোম্পানির পক্ষ থেকে জানানো হয়, প্রতিযোগিতা বাড়ায় শেষ প্রান্তিকটি ধাক্কা খেয়েছে তারা। তাছাড়া অ্যাপলের প্রাইভেসি নীতির পরিবর্তন ও নতুন বিনিয়োগ ব্যয়ও এর জন্য দায়ী বলে জানানো হয়।
মেটার প্রধান সামাজিক নেটওয়ার্ক ফেসবুকে চতুর্থ প্রান্তকে প্রায় দুইশ কোটি স্বক্রিয় গ্রাহক ছিল। যা আগের প্রান্তিকের চেয়ে ১০ লাখ কম।
ফেসবুক সব সময়ই একটি বর্ধনশীল প্ল্যাটফর্ম। এখনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। তারপরও গত কয়েক বছরে ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাড়েনি ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা। মূলত বিশ্বের অন্যান্য অংশের ব্যবহারকারীরাই এই প্ল্যাটফর্মকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
তবে তরুণ প্রজন্মের কাছে ফেসবুক আগের মতো জনপ্রিয় নেই। তরুণ প্রজন্ম ফেসবুকের চেয়ে ভিডিও শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম টিকটকের দিকে বেশি ঝুঁকছে।
তবে বিনিয়োগকারীদের ফেসবুকের প্রতি অনীহার অন্য কারণও রয়েছে। এর পেছনে রয়েছে ফেসবুকের প্যারেন্ট প্রতিষ্ঠানের নাম বদল। মূলত মেটাভার্সকে ফোকাস করতে ফেসবুকের প্যারেন্ট প্রতিষ্ঠানের নাম বদলে মেটা রাখা হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি মেটাভার্স নির্মাণের ধারেকাছেও নেই। এই মুহূর্তে মেটাভার্স একটি অবাস্তব বিষয় হিসেবেই রয়ে গেছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮২৯
আপনার মতামত জানানঃ