চীনা পণ্য নিয়ে বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ আর হাস্যরসের প্রাবল্য একসময় ছিল সাধারণ বিষয়। কিন্তু সেই অর্থনীতি ক্রমশ শক্তিশালী হয়েছে এবং কিছু ক্ষেত্রে এখন বিশ্বের প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে ভূমিকা পালন করছে। চীনা অর্থনীতির এমন বিকাশের পেছনে সে দেশের কমিউনিস্ট নামধারী পুঁজিবাদী সরকারের নীতির ভূমিকাই প্রধান। গবেষকরা বলছেন, সরকার যে জাতীয়তাবাদী উদ্দীপনা তৈরি করেছে, সেটাই চীনা ব্র্যান্ডগুলোর জন্য টনিক হিসেবে কাজ করেছে।
জাতীয়তাবাদের ক্রমবর্ধমান রূপ সারা বিশ্বেই ঘরোয়া পণ্য ব্যবহারকে উৎসাহিত করছে। কোভিড-১৯ মহামারী সেই পরিবর্তনকে আরো ত্বরান্বিত করছে। পাশাপাশি দেশী পণ্যের দামও বিদেশী পণ্যের চেয়ে কম। বিশেষত বাজেট সংকুচিত হয়ে পড়ার পর থেকে স্থানীয় পণ্য নিয়ে মানুষের আগ্রহ বেড়েছে। পাশাপাশি অনলাইনে কেনাকাটা বাড়ার হিসাবগুলোও দেখায় যে, বিতরণ ও বিপণনের দিক থেকে অনলাইন বাণিজ্যে বিদেশী পণ্যগুলো দুর্বল অবস্থানে চলে যায়।
কিয়াম ভেনচুরের পার্টনার হেলেন ওং মার্কিন সংবাদ সংস্থা ব্লুমবার্গকে বলেন, চীনা দোকানদাররা স্থানীয় ব্র্যান্ডে অধিকতর আস্থা রাখছেন। ফলে আঞ্চলিক স্টার্টআপগুলো ভালোই সহায়তা পাচ্ছে। ওং আরো বলেন, নভেল করোনাভাইরাসে ঘরে থাকার কারণে মানুষ লাইভস্ট্রিমিং দেখেছে এবং কেনাকাটা করছে। মার্কেটিং কনসালট্যান্সির তথ্য অনুসারে, বিনিয়োগকারীরা এখন ঘরোয়া কোম্পানিগুলোয় বিনিয়োগ করছে, যা বহুজাতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ফলে গত চার বছরে চীনের শীর্ষ ৫০০টি ব্র্যান্ডের মূল্যও দ্বিগুণ হয়েছে, যার মূল্য প্রায় প্রায় ৩ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন ডলার।
জামা ও জুতা প্রস্তুতকারক কোম্পানি আনটা স্পোর্টস প্রডাক্ট ২০১৮ সালে নাইকিকে টপকে চীনের ২ নম্বর স্পোর্টস ব্র্যান্ড হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাদের সামনে আছে এখন কেবল অ্যাডিডাস। সেপ্টেম্বরে হংকং ট্রেডিংয়ে অভিষিক্ত হওয়ার পর চীনের বৃহত্তম বোতলজাত পানির ব্র্যান্ড নংগফু স্প্রিংয়ের শেয়ার দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। কসমেটিক হাউজ পারফেক্ট ডায়েরির মালিক ইয়াটসেন হোল্ডিং ক্রমে হুমকি তৈরি করেছে ল’রিয়েল ও এস্টে লাউডারের মতো কোম্পানিগুলোর জন্য।
সব মিলিয়ে ১০টি কসমেটিকস ব্র্যান্ডের মাঝে সাতটিই এখন স্থানীয় ব্র্যান্ড, যেখানে ২০১৭ সালে স্থান পেয়েছিল মাত্র তিনটি। চীনে গত বছর বেশ নেমেছে ল’রিয়েলের ম্যাবিলাইন মেকআপ লাইনের শেয়ার। ২০১০ সালের ২০ শতাংশ থেকে সেটি নেমেছে ৯ দশমিক ১ শতাংশ পর্যন্ত। স্কিন কেয়ার ও লোশন ক্যাটাগরিতে ল’রিয়েল প্যারিসের শেয়ারও হ্রাস পেয়েছে। ২০১৪ সালে যা ৫ দশমিক ৬ শতাংশ ছিল, সেটি গত বছর নেমেছে ৪ দশমিক ৫ শতাংশে; যা এটিকে চালিত করেছে স্থানীয় ব্র্যান্ড পেচইনের সঙ্গে লড়াইয়ে।
বায়ান অ্যান্ড কোং-এর অংশীদার ডেরেক ডেংয়ের মতে, চীনা কসমেটিক প্রস্তুতকারকদের শক্তি তাদের শক্তিশালী অনলাইন কৌশল দ্বারা শনাক্ত করা যায়। তিনি বলেন, প্রথম দিন থেকেই বিকল্প চীনা ব্র্যান্ডগুলোর ডিজিটাল হয়ে ওঠার সম্ভাবনা বেশি। যেখানে বহুজাতিকগুলো শারীরিক স্টোরের ওপরই অধিকতর নির্ভরশীল।
২০০৮ সালে ‘মেড ইন চায়না’ ট্যাগ দেয়া বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য মেশানো প্রক্রিয়াজাত খাবার খেয়ে ছয়জন শিশু মারা যায় এবং তিন লাখ শিশু অসুস্থ হয়ে পড়ে। এর প্রতিক্রিয়ায় অনেক চীনা মা-বাবা শিশুখাদ্যের ক্ষেত্রে বিদেশী ব্র্যান্ডগুলোর দিকে ঝুঁকে পড়েন, যা ডানোনের আপটিমিলের এবং নেসলের ইলোমার মতো পণ্যগুলোকে বাজারের শীর্ষে তুলে দেয়। তার পরও গত দুই বছর ধরে চীনের একটি শীর্ষস্থানীয় ফর্মুলা ব্র্যান্ড হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে বেইজিংভিত্তিক কোম্পানি চীনা ফেইহে লিমিটেড, যারা স্থানীয় পণ্যকে সামনে নিয়ে আসার প্রতি অধিকতর গুরুত্ব দিচ্ছে। কোম্পানিটির বিজ্ঞাপনে লেখা আছে, চীনা শিশুদের জন্য অধিকতর উপযোগী।
বর্তমানে শিশুখাদ্য ও বোতলজাত পানি থেকে শুরু করে স্পোর্টসওয়্যার এবং ত্বকে লাগানোর ক্রিমসহ নানা চীনা ব্র্যান্ড বৈশ্বিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে, যারা নিজেদের প্রবৃদ্ধির জন্য মূলত দেশের ওপরই অধিকতর নির্ভরশীল।
পারফেক্ট ডায়েরি যাত্রা শুরু করেছিল ২০১৭ সালে, কিন্তু এখন এসে মাত্র অল্প কয়টা ইউরোপিয়ান ব্র্যান্ডের পেছনে অবস্থান করছে। এর বিজ্ঞাপনে বলা হয়, এটি প্রস্তুত করা হচ্ছে ডায়র, ল্যানকাম ও আরমানির মতো করে। কিন্তু বিক্রির ক্ষেত্রে খরচ কমাতে পারছে সেগুলোর চেয়ে এক-তৃতীয়াংশ।
বিদেশভিত্তিক ব্র্যান্ডগুলো অবশ্য চীনে একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। তারা হাতব্যাগ ও বিলাসবহুল গাড়িগুলোয় এখনো দাপট দেখাচ্ছে। কেএফসিও এখনো চীনে সর্ববহৎ ফুড চেইন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। তারাও এখন নিজেদের কৌশলে পরিবর্তন আনছে। আলিবাবার পার্টনার ওয়েনজিহুই এমসিএন নামে একটি এজেন্সির প্রতিষ্ঠাতা উ ওয়নমি বলেন, বড় আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোর আচরণে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। এখন তারা অনেক বেশি বিনয়ী এবং তারা কীভাবে নিজেদের কাজ করবে, তা ঠিক করতে আমাদের মতামত গ্রহণ করছে।
এসডাব্লিউ/বিবি/আরা/১৯২০
আপনার মতামত জানানঃ