ব্লুমবার্গ বিলিয়নেয়ার ইনডেক্স অনুযায়ী, ২০২০ সালের শেষ নাগাদ এশিয়ার সেরা ২০ ধনী পরিবারের সম্পদ বেড়েছে ৩৩ বিলিয়ন ডলার। মহামারি দ্বিতীয় বছরে এসে ভয়াল রূপ নিলেও থামেনি তাদের বিত্তের স্ফীতি।
বর্তমানে তাদের সম্মিলিত সম্পদের পরিমাণ সাড়ে ৪৯ হাজার কোটি ডলার, যা কিনা সিঙ্গাপুর ও হংকংয়ের মতো ধনী অঞ্চলের জিডিপিকেও ছাড়িয়ে যায়।
টানা তিন বছর ধরে এশীয় ধনী পরিবারের মধ্যে প্রথম স্থানটির অধিকারী ভারতের আম্বানিরা। পরিবারের কর্তা মুকেশ এখন তার রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজকে প্রযুক্তি ও ই-কমার্সমুখী করছেন। অচিরেই তিনি তিন সন্তানের হাতে বিশাল ব্যবসায়ীক সাম্রাজ্যের ভার ছেড়ে দেবেন বলেও জানা গেছে।
মুকেশ বৈদ্যুতিক যান, সবুজ জ্বালানি এবং ব্যাটারি উৎপাদনেও করে চলেছেন নিত্যনতুন বিনিয়োগ।
অ্যালুমিনিয়াম প্রস্তুতকারক চায়না হংকিয়াও গ্রুপের সিংহভাগের মালিকানা রয়েছে ঝ্যাং পরিবারের। পরিবারটি প্রথম প্রজন্মের ধনী। এই প্রথমবার তারা ব্লুমবার্গের সেরা ২০ এশীয় ধনীর কাতারে নাম লিখিয়েছে।
ভারতের বিখ্যাত দুটি শিল্পগোষ্ঠী বিড়লা ও বাজাজ পরিবারও এই র্যাঙ্কিং সারণীতে রয়েছে। ভারতীয় ধনীদের এই উপস্থিতি দেশটির অর্থনৈতিক শক্তির ইঙ্গিত দিচ্ছে।
তবে চলতি বছরের তালিকায় প্রাচুর্যের বিচারে পিছিয়ে পড়েছে ক্যাসিনো জায়ান্ট এসজিএম হোল্ডিংস লিমিটেডের মালিক হোস পরিবার, থাইল্যান্ডের সেন্ট্রাল গ্রুপের মালিক চিরাথিভট এবং সিঙ্গাপুরের আবাসিক সম্পত্তি ডেভেলপার ফার ইস্ট অর্গানাইজেশন সেন্টার পিটিই’র এঞ্জিস পরিবার। তারা এখন আর শীর্ষ ২০ ধনী পরিবারের মধ্যেই নেই। মহামারিতে তাদের ব্যবসাবাণিজ্য ব্যাহত হওয়াই যার প্রধান কারণ।
এখন একজন ধনীর প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে জানা যাক। চেং ইয়ু-তুং। শূন্য থেকে শীর্ষে ওঠেননি চেং। পারিবারিক জুয়েলারি ব্যবসার থেকে তিনি উত্তরাধিকার হিসেবে লাভ করেন বিপুল সম্পদ। তবে তিনি এই ব্যবসাকে নতুন আঙ্গিক দেন আবাসন খাতে নিয়ে এসে।
তার কোম্পানির নির্মিত সবচেয়ে বিলাসবহুল স্থাপনা কে-১১ মুসেয়া। বৈশ্বিক ‘কালচারাল রিটেইল’ এই কমপ্লেক্স উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে এসেছিলেন ফরাসী ফ্যাশন আইকন শাহিন হোয়াথফোর । শ্যাম্পেনের ফোয়ারা ছোটানো আয়োজনে আমন্ত্রিত ছিলেন আরও অনেক সেলিব্রেটি।
কিন্তু এই হাসি-আনন্দের পেছনে এশিয়ার অন্যতম সেরা ধনী পরিবার চেংদের সময়টা বিশেষ ভালো যাচ্ছে না। চেং পরিবার মোট ২৩ বিলিয়ন সম্পদের অধিকারী। হংকংয়ের অন্যতম বৃহৎ আবাসন কোম্পানি- নিউ ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট কোং তাদেরই। সম্প্রতি কোম্পানির বাজারদর তিন বছর আগের তুলনায় ৪০ শতাংশ কমেছে।
২০১৯ সালে হংকংয়ে চীনের কেন্দ্রীয় সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু হলে এ অবনতি শুরু হয়। তার কিছুদিন আগে উদ্বোধন হয় কে-১১ মুসেয়া। তারপর মহামারি পরিস্থিতি গুরুতর রূপ নিলে পর্যটকদের আসাও বন্ধ হয়ে যায়। অফিস কর্মীরাও শুরু করেন বাড়ি থেকে কাজ।
হংকংয়ের সবচেয়ে অভিজাত এলাকায় আউটলেট আছে চেং পরিবারের চৌ তাই ফুক জুয়েলারি গ্রুপ লিমিটেডের। মহামারিকালের ১৮ মাসে শহরটিতে তাদের জুয়েলারি বিক্রিবাট্টার নেটওয়ার্ক ১০ শতাংশ হ্রাস পায়।
মহামারি নতুন কিছু চাপও সৃষ্টি করেছে, কমিয়েছে গ্রাহকের ক্রয়-ক্ষমতা। যেকারণে বিশ্বের অন্যতম উচ্চদরের আবাসন বাজার হংকংয়ে তুলনামূলক কম খরচের আবাসিক স্থাপনা নির্মাণের চ্যালেঞ্জ নিতে হচ্ছে স্থানীয় ডেভেলপারদের।
অধিক ঝুঁকি নেওয়ায় চীনের মূল ভূখণ্ডের ডেভেলপরাররা এখন কেন্দ্রীয় সরকারের কড়াকড়ির শিকার। ধনী-দরিদ্র্যের বৈষম্য কমাতে সরকার “সকলের জন্য সমৃদ্ধি” নীতিগ্রহণ করেছে। এসব পদক্ষেপ চেংদের মতো এশিয়ার অন্যতম চীনা ধনী পরিবারগুলোকে প্রভাবিত করবে- এমন আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে।
এই বাস্তবতায় নতুন ব্যবসায় নামার পরিকল্পনা করেন চেং ইয়ু-তুং। তিনি এখন ক্রিপ্টোকারেন্সি, জৈবপ্রযুক্তি (বায়োটেক) আর ই-কমার্স খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করছেন। তাছাড়া, ২০২৬ সাল নাগাদ কয়লার ব্যবহার সম্পূর্ণ বর্জনের অঙ্গীকারও করেছে নিউ ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট কোং।
এশিয়ার অন্য ধনী পরিবারগুলোও যোগ দিয়েছে ব্যবসার নব-দিগন্তের এই ধারায়। ডিজিটাল বিপণন, মুদ্রা ও সবুজ জ্বালানিতে রুপান্তরে বাড়ছে তাদের লগ্নী। মেটাভার্স হোক বা বায়োটেক- তারা নতুন সম্ভাবনার খাতগুলোর নেতৃত্ব চান। কিন্তু, এসব খাত এখনও বেশ অস্থিতিশীল হওয়ায় যেকোনো ভুল সিদ্ধান্তে ব্যাপক অর্থ অপচয়েরও ঝুঁকি রয়েছে।
হংকং ভিত্তিক চাইনিজ ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর ফ্যামিলি বিজনেস সেন্টারের পরিচালক কেভিন উ বলেন, “অনেক ধনকুবের লক্ষ্য করেছেন যে, তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানিগুলো তাদের প্রচলিত ব্যবসায় নানানভাবে ভাগ বসাচ্ছে। অনেকক্ষেত্রে যা ছিল তাদের ধারণাতীত। তারা এখন অনুধাবন করেছেন, সঠিক পদক্ষেপ নেওয়ার এটাই সময়। তাদেরকেও নতুন যুগের ব্যবসা খাতে আসতে হবে। নাহলে এসব উদ্যোগ তাদের বাজার দখল করে নিবে।”
এসডব্লিউ/এসএস/১২৪৫
আপনার মতামত জানানঃ