হলি আর্টিজানে হামলার পর জঙ্গিবাদ নির্মূলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) গঠন করে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট নামে এ বিশেষায়িত পুলিশ ইউনিট। এরপর থেকে শুধু ঢাকাই নয়, ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন জেলায় জঙ্গি আস্তনাসহ বিভিন্ন অভিযান চালিয়ে আসছে সিটিটিসি।
পাশাপাশি দেশব্যাপী সেমিনারসহ নানান অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জঙ্গিবাদবিরোধী সামাজিক কার্যক্রমও চালাচ্ছে এ ইউনিট। এছাড়াও উগ্রবাদ ও সন্ত্রাস প্রতিরোধে গঠিত পুলিশের এন্টি টেররিজম ইউনিটও (এটিইউ) জঙ্গিদের আইনের আওতায় আনতে কাজ করে যাচ্ছে।
অন্যদিকে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) জঙ্গিদের শুধু আইনের আওতায়ই আনছে তা নয়, তারা জঙ্গিদের পুনর্বাসনে ডিরেডিকালাইজেশনেরও কাজ করছে।
শুধু সিটিটিসিই নয়, অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পাশাপাশি জেলা ও মেট্রো ইউনিটগুলো মামলা নিষ্পত্তিতে দেখিয়েছে মুনশিয়ানা।
বর্তমানে জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশ পুলিশের বড় সাফল্য এসেছে। পুলিশের তৎপরতায় জঙ্গিদের নেটওয়ার্ক ভেঙে দিয়ে জঙ্গিবাদকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রেখেছে পুলিশ। বাংলাদেশ পুলিশের এই সাফল্য আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃত হয়েছে।
রোববার (২৩ জানুয়ারি) পুলিশ সদরদপ্তরের এক পরিসংখ্যান সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
পুলিশের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের আগস্ট পর্যন্ত দেড় বছরে ৩১৭ জনকে জঙ্গিবাদে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সিটিটিসি, র্যাব, এটিইউ সিআইডি ও পিবিআইয়ের পাশাপাশি জেলা ও মেট্রো ইউনিটগুলো মামলা নিষ্পত্তিতে দেখিয়েছে মুনশিয়ানা। এসব মামলার তদন্ত পুলিশ সক্ষমতা ও দক্ষতা উন্নয়নের পরিচয় দিয়েছে বলে জানায় পুলিশ।
বিগত বছরগুলোর মতো সশস্ত্র জঙ্গি হামলার চিত্র ছিল না ২০২১ সালে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, অনলাইন প্লাটফর্ম ব্যবহার করে জঙ্গি ও উগ্রবাদী তৎপরতা বেড়েছে। এ কারণে অনলাইন প্লাটফর্মের ওপর গুরুত্ব দিয়ে সেখানে নজরদারিও বাড়ানো হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, বিগত দুই/তিন বছরে জঙ্গি তৎপরতা কমে এসেছে। এরপরও আত্মতৃপ্তিতে ভোগার সুযোগ নেই। যারা জামিনে আছেন, তাদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। অন্যদিকে, জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া বিপথগামীদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে কয়েক স্তরের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
র্যাব সদর দপ্তর সূত্রে জানা যায়, গেল বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে ২৭৩ জঙ্গিকে গ্রেপ্তার, নয় জঙ্গি ‘আত্মসমর্পণ’ এবং বিপুল পরিমাণ দেশি-বিদেশি অস্ত্র, গোলাবারুদ, বিভিন্ন ধরনের উগ্রবাদী বই ও লিফলেট উদ্ধার করে র্যাব।
র্যাব সদর দপ্তরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে র্যাব জঙ্গিবাদবিরোধী অভিযান পরিচালনা করে আসছে। এখন পর্যন্ত পূর্ববর্তী ধারা সমুন্নত রেখে র্যাব বহুমুখী কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে জঙ্গিবাদ দমন অব্যাহত রেখেছে। শুধুমাত্র অভিযান নয়, জঙ্গিবাদবিরোধী জনমত গড়তে এবং জনসম্পৃক্ততা অর্জনে র্যাব ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে। অন্যদিকে, গ্রেফতারের পাশাপাশি জঙ্গিদের অর্থের উৎস এবং অস্ত্র ও বিস্ফোরকপ্রাপ্তি বন্ধে র্যাবের কার্যক্রমও চলমান রয়েছে।
‘এছাড়া র্যাব জঙ্গি আত্মসমর্পণে বিশেষ উদ্যোগ ‘র্যাব ডি-র্যাডিকালাইজেশন ও রিহ্যাবিলিটেশন’ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ২০১৬ সালে হলি আর্টিজান হামলার মাধ্যমে পুনরায় জঙ্গিরা তাদের সংগঠনের অস্তিত্বের জানান দেয়। হলি আর্টিজান ঘটনা-পরবর্তী র্যাব জঙ্গিদের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের গ্রেফতারে সক্রিয় হয়। জঙ্গি সংগঠনের আমিরসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে সাফল্যও পায়।’
বিগত দুই/তিন বছরে জঙ্গি তৎপরতা কমে এসেছে। এরপরও আত্মতৃপ্তিতে ভোগার সুযোগ নেই। যারা জামিনে আছেন, তাদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। অন্যদিকে, জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া বিপথগামীদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে কয়েক স্তরের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
র্যাবের অভিযানে কেন্দ্রীয় দাওয়াতি শাখাপ্রধান, শুরা ও শরিয়া বোর্ড সদস্য, মহিলা শাখার নেতৃবৃন্দ এবং বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) বিশেষজ্ঞ গ্রেপ্তার হয়। এর মাধ্যমে জঙ্গি সংগঠনকে দুর্বল করে দেয় র্যাব— বলেন কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
হলি আর্টিজান হামলার পর র্যাবের তৎপরতায় ১৫৫৮ জঙ্গি সদস্য আটক হয়। এর মধ্যে ৮৩১ জন জেএমবি সদস্য। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের দুই হাজার ৬৮৫ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। এর মধ্যে জেএমবি সদস্য ছিলেন ১৩৯৬ জন— জানায় র্যাব।
২০২১ সালে উগ্র ও জঙ্গিবাদে জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশের অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ) ৩৫টি অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানে মোট ৫৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের মধ্যে জেএমবি সদস্য সাতজন, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের ২১ জন, আল্লাহর দলের পাঁচজন, হিযবুত তাহরীরের তিনজন, আনসার-আল ইসলামের ১০ জন, অনলাইন প্রতারক পাঁচজন এবং হেফাজতে ইসলামের চার সদস্য রয়েছেন।
এটিইউ’র পুলিশ সুপার (মিডিয়া অ্যান্ড অ্যাওয়ারনেস) মোহাম্মদ আসলাম খান বলেন, ‘ভুল বুঝে কিংবা ভুল পথে পা বাড়িয়ে জঙ্গি-উগ্রবাদে জড়ানো তরুণ-যুবকদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজের অংশ। কাজটা এটিইউ সুষ্ঠুভাবে করছে। তবে সরকারিভাবে অর্থায়ন না থাকায় যেভাবে করা দরকার সেভাবে সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি। মনিটরিং, অভিযান, গ্রেফতারসহ নানা আইনি পদক্ষেপ বাড়ানো হয়েছে।’
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আফগানিস্তানে তালিবানরা ক্ষমতায় আসায় জঙ্গি নিয়ে হুমকির মুখে পড়তে চলেছে গোটা পৃথিবী। গোটা বিশ্বের আনাচে কানাচে লুকিয়ে থাকা জঙ্গিরা তালিবানদের ভরসায় আবারও সক্রিয় হয়ে উঠছে। এতে করে আবারও বোমা হামলাসহ শত শত মানুষের প্রাণহানিসহ ভয়ংকর ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তালিবানের উত্থান বাংলাদেশের উগ্র মৌলবাদীদেরও তাদের আদর্শগত অবস্থানকে সুসংহত করতে উদ্বুদ্ধ করছে। পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের কেন্দ্র করেও ইতিমধ্যেই সক্রিয় হয়ে উঠেছে একটি গোষ্ঠী। তারা ওই অঞ্চলে রীতিমত ত্রাস সৃষ্টি করেছে এর মধ্যেই।
বাংলাদেশে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার উপস্থিতিকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপী যে নেতিবাচক ধারণার জন্ম হয়েছে তার একটি হচ্ছে এ অঞ্চলকে ঘিরে জঙ্গি নেটওয়ার্ক বিস্তার। সিরিয়া-ইরাকে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) কার্যক্রম সীমিত হয়ে আসছে। আইএস নিয়ন্ত্রিত অনেক শহর এখন সিরিয়া তথা ইরাকের বাহিনীর দখলে। ওই সব এলাকায় যেসব জিহাদি ছিল, তারা এখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, বিশেষ করে ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া কিংবা মালয়েশিয়ায় পালিয়ে গেছে বলে পূর্ব থেকে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে অনেকে। সেই আশঙ্কা নতুন করে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে তালিবানের আফগানিস্তান দখলকে কেন্দ্র করে।
সম্প্রতি মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ছয়টি দেশে আত্মঘাতী হামলার সতর্কতা জারি করেছে জাপান। এজন্য ওই ছয় দেশে অবস্থান করা জাপানিদের জনসমাগম থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছে টোকিও।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে লড়াই করে আফগানিস্তানকে দখল করার ঘটনা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের সন্ত্রাসবাদী ও জঙ্গি দলগুলোর জন্য প্রেরণা হিসেবে কাজ করছে বলে বিশ্লেষকদের উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছে এএফপি।
নিউ ইয়র্কভিত্তিক সুফেন সেন্টার থিংকট্যাংকের গবেষণা প্রধান কলিন ক্লার্ক এএফপিকে বলেন, ‘তালিবানের এই জয় বিশ্বের অন্য জিহাদি দলগুলোর জন্য প্রেরণা হয়ে দেখা দেবে। এটা তাদের বিশ্বাস করতে সহায়তা করবে যে, বিদেশি শক্তিকে চাইলে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা যায়, এমনকি সেটা যুক্তরাষ্ট্রের মতো ক্ষমতাধর রাষ্ট্র হলেও। আমি মনে করি ৯/১১’র ঘটনার ২০ বছর পূর্তিতে উল্লেখযোগ্য প্রোপাগান্ডা দেখতে পাব। এতে উত্তর আফ্রিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জিহাদিদের নৈতিক শক্তি বৃদ্ধি করবে।’
ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির প্রোগ্রাম অন এক্সট্রিমিজমের ফেলো আয়মন জাওয়াদ আল তামিমির মতে, ‘তালিবানদের ধৈর্যের এই উদাহরণ বিশ্বের অন্য অঞ্চলের জিহাদি যারা লড়াই করছে তাদের উদ্বুদ্ধ করবে। যদিও আফগানিস্তানের উগ্রবাদীদের সঙ্গে ইসলামিক স্টেটের মতো দলের মতাদর্শিক দ্বন্দ্ব রয়েছে। ইসলামিক স্টেটের নেতৃত্ব আফগানিস্তানে তালিবানদের উত্থানে খুশি হোক বা না হোক, অন্য জিহাদিরা একে মাইলফলক হিসেবে নেবে। অন্য দলগুলো যখন তালিবানদের আনন্দ উদযাপন করতে দেখছে, এতে তারা মনে করছে যে, তারাও যদি ধৈর্য ধরে লড়াই চালিয়ে যেতে পারে তাহলে হয়তো পশ্চিম আফ্রিকা অথবা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ওই উদযাপন তারাও করতে পারবে।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৩৫
আপনার মতামত জানানঃ