পৃথিবীর ইতিহাসে আমরা ষষ্ঠতম গণবিলুপ্তির পর্যায়ে রয়েছি। হিসাব-নিকাশ প্রজাতির বিলুপ্তিরই ইঙ্গিত নির্দেশ করছে। এই ষষ্ঠ গণবিলুপ্তি এড়াতে হলে আমাদের জলবায়ুগত পরিবর্তন, প্রাণীদের আবাসস্থল ধ্বংস করা রোধ করতে হবে।
কয়েক লাখ বছর ধরে সগর্বে পৃথিবীতে রাজত্ব করা মনুষ্য প্রজাতিও ভবিষ্যতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে; এমনটা শুনলে সবারই চক্ষু চড়কগাছ হওয়ার কথা! কিন্তু আদতে এটাই সত্য।
নৃতাত্ত্বিক এই বিলুপ্তির জন্য দায়ী মানুষ। জলবায়ু পরিবর্তন, বনভূমি ধ্বংস, দূষণ এবং শিল্প-সংক্রান্ত কৃষিকাজ এর অন্যতম কারণ। কয়েক দশকের মধ্যে ধ্বংসের মুখে প্রায় ১০ লাখ প্রজাতি। বিশ্বের সব প্রজাতির প্রায় তিন চতুর্থাংশ আগামী ৩০ লাখ বছরের মধ্যে বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এর আগে পৃথিবীতে প্রাণিকুলের গণবিলুপ্তি ঘটেছিল আজ থেকে ছয় কোটি ৫০ লাখ বছর আগে অতিকায় ডাইনোসরের অস্তিত্ব নিশ্চিত হওয়ার মধ্য দিয়ে।
ধারণা করা হয়, তখন অতিকায় গ্রহাণুপুঞ্জ পৃথিবীতে আঘাত হানার কারণে সৃষ্টি হয়েছিল ‘নিউক্লিয়ার উইন্টার’-এর। অর্থাৎ গ্রহাণু পৃথিবীপৃষ্ঠে সজোরে আছড়ে পড়ার কারণে পৃথিবীপৃষ্ঠের চারপাশে ঘন মেঘের সৃষ্টি হয়েছিল, যা পৃথিবীপৃষ্ঠে সূর্যের আলো পৌঁছতে বাধা দেয়। ফলে কুয়াশাচ্ছন্ন পরিবেশের কারণে খাদ্যাভাবে বিলুপ্তি ঘটে ডাইনোসরের।
সাম্প্রতিক সময়ে সায়েন্স অ্যাডভান্সেস সাময়িকীতে প্রকাশিত স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা নিবন্ধে বলা হয়েছে, মেরুদণ্ডী প্রাণীরা স্বাভাবিকের চেয়ে ১১৪ গুণ দ্রুতহারে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এই বিলীয়মান সারির প্রথমেই মনুষ্য প্রজাতি থাকতে পারে।
বিজ্ঞানীরা সতর্কবাণী করেছেন পৃথিবীর প্রাণিকুল ষষ্ঠবারের মতো গণবিলুপ্তির শিকার হতে যাচ্ছে, আর এটি ঘটবে স্বাভাবিকের চেয়ে ১০০ গুণ বেশি হারে।
মানুষ পরিবেশগতভাবে যে বিষাক্ততা ছড়িয়েছে তা প্রাণীদের বাসযোগ্যতা নষ্ট করেছে আর তাই গত দেড় হাজার বছরে ৭৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ১৪০ প্রজাতির পাখি ও ৩৪ প্রজাতির উভচর প্রাণী বিলুপ্ত হয়েছে।
স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের মতে ক্রিটাশিয়াস-টারিশিয়ারি যুগের পরে এটিই হতে চলেছে প্রজাতির বৃহত্তম গণবিলুপ্তি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পল এরিখ অনেকটা দ্বিধাহীনভাবেই দাবি করেছেন, পৃথিবীর ইতিহাসে আমরা ষষ্ঠতম গণবিলুপ্তির পর্যায়ে রয়েছি।
মেরুদণ্ডী প্রাণীদের বিলুপ্তির ঐতিহাসিক হার যাচাইয়ের জন্য বিজ্ঞানীরা জীবাশ্ম বা ফসিল থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে থাকেন। এতে দেখা যায, বিলুপ্তির বর্তমান হার স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অন্তত একশ’ গুণ বেশি।
যদিও প্রাকৃতিকভাবে প্রতি ১০০ বছরে দশ হাজারের মধ্যে মাত্র দুটি স্তন্যপায়ী প্রজাতি বিলুপ্ত হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে চিত্রটি সম্পূর্ণ উদ্বেগজনক, কারণ বর্তমানে স্বাভাবিক সীমার চেয়ে ১১৪ গুণ বেশি হারে প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
বিজ্ঞানীরা এজন্য মানুষকেই দায়ী করেছেন। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ওশেনিয়া দ্বীপপুঞ্জের প্রায় আঠারোশ’ প্রজাতির পাখি গত দু’হাজার বছরে হারিয়ে গেছে। বর্তমানে পৃথিবীর চারটি প্রজাতির স্তন্যপায়ী ও ৪১ শতাংশ উভচর বিলুপ্তির পথে রয়েছে।
আদিম মানুষরাও অস্ট্রেলিয়ায় বাস করা বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী যেমন দানবাকার ভল্লুক, থলিবিশিষ্ট সিংহ ও মাংসাশী ক্যাঙ্গারু বিলুপ্তির জন্য দায়ী ছিল।
গবেষণা নিবন্ধের প্রধান লেখক জেরার্ডো সেবালোস উল্লেখ করেন, মেরুদন্ডী প্রাণীর বিলুপ্তির বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে এ ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কয়েক লাখ বছর সময় লাগবে; কিন্তু পৃথিবীর অনেক প্রজাতিই হয়তো তার আগেই হারিয়ে যাবে।
অধ্যাপক পল এরিখ মনে করেন, বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী সুরক্ষায় রাষ্ট্রীয়ভাবে সর্বজনীন উদ্যোগ নেওয়া উচিত। গবেষকদের মতে অনালোকিত অবস্থা সত্ত্বেও এর থেকে উত্তরণের পথ বের করা সম্ভব।
সত্যিকারভাবে প্রজাতির এই ষষ্ঠ গণবিলুপ্তি এড়াতে হলে বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি সংরক্ষণের স্বার্থে আমাদের জলবায়ুগত পরিবর্তন, প্রাণীদের আবাসস্থল ধ্বংস করা রোধ করতে হবে এবং প্রাণীদের বংশবিস্তারে উদ্যোগী হতে হবে।
ষষ্ঠ গণবিলুপ্তির কারণ
গণবিলুপ্তির পথে একসময় খাদ্য সরবরাহে টান পড়বে। পরাগমিলনের উপর খাদ্য সুরক্ষা নির্ভর করছে, মত দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার ফ্লিন্ডার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোবাল ইকোলজির অধ্যাপক কোরে ব্র্যাডশর। মৌমাছি মারা গেলে ভেঙে পড়বে কৃষি ব্যবস্থা।
ক্ষতিকারক পোকামাকড়ের পরিমাণ বাড়বে। উপকূলবর্তী এলাকায় মাছ চাষে সমস্যা হবে। বন্যা এবং খরার ফলে সাহারা-সংলগ্ন আফ্রিকা এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার একাংশ চরম ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
ডব্লু ডব্লু এফ ইন্টারন্যাশনালের তরফে কোলম্যান ও ক্রায়োডেনের মত, মাটির গুণমান কমবে কারণ গণবিলুপ্তিতে উপকারী অণুজীবের মৃত্যু হবে। মাটির উর্বরতা কমে প্রভাব পড়বে কৃষিতে৷
সারা বিশ্বের শুদ্ধ পানীয় জলের অধিকাংশ আসে জলাভূমি থেকে। হিমালয়সংলগ্ন এলাকার প্রায় দুই কোটি মানুষ এই পানির উপর নির্ভরশীল। বিশ্বজুড়ে পানীয় জলেও মারাত্মক টান পড়বে।
বনভূমি ধ্বংসের ফলে বৃষ্টিপাতের ধরন বদলেছে। জাতিসংঘের মত, ২০১৫ থেকে বার্ষিক প্রায় ২.৮ কোটি একর বনভূমি ধ্বংস হয়েছে। কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বেড়েছে। স্টকহোম রিজিলেন্স সেন্টার ফর রিসার্চের পরিবেশবিজ্ঞানী কার্ল ফক বলেন, বাস্তুতন্ত্রকে সবথেকে বেশি সমস্যয় ফেলেছে মানুষ।
জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের সতর্কতা জারি করেছেন বিজ্ঞানীরা। শুধু তাই নয়, বনভূমি ধ্বংস হচ্ছে। বন্যপ্রাণী ও মানুষ কাছাকাছি চলে আসার ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশে ব্যাঘাত ঘটে মহামারির সম্ভাবনাও বেড়েছে।
গণবিলুপ্তির ইতিহাস
পৃথিবী এ পর্যন্ত পাঁচটি গণবিলুপ্তি প্রত্যক্ষ করেছে, যার মধ্যে ৪৪ কোটি ৩৯ লাখ বছর আগে প্রথমবারের মতো ওর্ডোভিসিয়ান-সিলুরিয়ান বিলুপ্তিতে সামুদ্রিক ৮৩ শতাংশ প্রাণী নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এরপর ৩৯ কোটি বছর আগে ডেভোনিয়ান বিলুপ্তিতে পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ প্রাণী বিলুপ্ত হয়।
২৪ কোটি ৮০ লাখ বছর আগে পার্মিয়ান বিলুপ্তিতে তীব্র খরায় ৯৬ শতাংশ প্রাণ বিলীন হয়ে যায়। পরবর্তীতে ২০ কোটি ৫০ লাখ বছর আগে জলবায়ু পরিবর্তন ও গ্রহাণুর আঘাতে পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক প্রাণী ধ্বংস হয়ে যায়।
সর্বশেষ পঞ্চমবারের মতো ৬ কোটি ৫০ লক্ষ বছর আগে বিলুপ্তির মধ্য দিয়ে ডাইনোসরের বিলোপ ঘটে। অধিকাংশ গবেষকই একমত পোষণ করেন যে, ডাইনোসরদের অবলুপ্তির পর বিভিন্ন প্রজাতির বিলুপ্তির হার আগে কখনও এত ব্যাপক ছিল না।
কিন্তু বিজ্ঞানীরা সন্দেহাতীতভাবেই ষষ্ঠ গণবিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে মানুষের অবস্থান নিয়ে যে সংশয় প্রকাশ করেছেন, তা কতটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে সেটা নিশ্চিত করা না গেলেও পরিবেশ সুরক্ষায় আমাদের অবস্থান ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হলে গণবিলুপ্তিকে কিছুটা শ্লথ হতে পারে বৈকি।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৩৫
আপনার মতামত জানানঃ