সৌদি আরবের রাস্তায় তিন বিদেশি আফ্রিকান নারী ব্রাজিলের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে সাম্বা নৃত্য পরিবেশন করেছেন। এর একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। এ নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক।
সূত্র মতে, সম্প্রতি দক্ষিণ সৌদির জাজান প্রদেশে শীতকালীন উৎসবে তিন বিদেশি নারী সংক্ষিপ্ত পোশাক পরে রাস্তায় সাম্বা নৃত্য পরিবেশন করেন।
এই নৃত্যের ভিডিও গত সপ্তাহ থেকে সৌদির সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক ভাইরাল হয়েছে। স্বল্প বসন পরে রক্ষণশীল সৌদিতে এমন নাচ করায় সমালোচনা ঝড় উঠেছে।
সৌদি আরবের মোট জনসংখ্যার দুই তৃতীয়াংশের বয়স ৩০ এর নিচে। ডিফ্যাক্টো নেতা মোহাম্মদ বিন সালমান দেশটিতে বিভিন্ন ধরনের সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন।
সৌদি আরব তাদের বিনোদন জগত বৈচিত্রপূর্ণ করার উদ্যোগ নিয়েছে। এর অংশ হিসেবে সারা বছরজুড়ে সৌদি আরবে বিভিন্ন উৎসব ও খেলাধূলা অনুষ্ঠিত হয়।
খবরে বলা হয়েছে, সাম্বা নৃত্য পরিবেশনকারী নারীরা ব্রাজিলের ঐতিহ্যবাহী পালকের রঙ আকৃতির পোশাক পরেন। এই পোশাকে দুই পা, বাহু এবং পেট অনাবৃত থাকে।
সৌদির রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন আল আখবারিয়া টিভি এই অনুষ্ঠানের ফুটেজ প্রচার করে। কিন্তু এতে ওই নারীদের ছবি ঝাঁপসা করে দেওয়া হয়।
সৌদিতে সাম্বা নৃত্যের প্রতিক্রিয়ায় জাজানের বাসিন্দা বাজবি বলেন, উৎসব বিনোদনের জন্য, কিন্তু এটা ধর্ম ও সামাজিক নৈতিকতাকে আক্রমণের জন্য হওয়া উচিত নয়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই ঘটনার জন্য দায়ীদের বিচারের মুখোমুখি করার দাবি উঠেছে।
সমালোচনার মুখে জাজানের গভর্নর মোহাম্মদ বিন নাসের শনিবার ঘটনার তদন্ত এবং উৎসবের নামে এমন ধরনের অপব্যবহার বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া কথা বলেছেন।
সৌদিতে সিনেমার দিন বদল
সৌদি আরবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে এবার গুরুত্ব বাড়ছে বিনোদন শিল্পের। সদ্যই সৌদি আরবের সংগীত উৎসব ‘সাউন্ডস্টর্ম সংগীত উৎসব’ শেষ হলো। চারদিনের সংগীত উৎসবে সাত লাখের বেশি অতিথি অংশগ্রহণ করে। এর রেশ যেতে না যেতেই সৌদিবাসীর জন্য ‘নিউ ইয়ার’ এসেছিল বাড়তি আনন্দ হয়ে।
বিশ্বের বিভিন্ন জনপদের মতো মহা ধুমধামে নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরবও। জমকালো আয়োজন আর আতশবাজির রঙিন আলোর ঝলকানিতে ২০২২ সালকে স্বাগত জানিয়েছে সৌদিবাসী।
সৌদি আরবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে এবার গুরুত্ব বাড়ছে চলচ্চিত্র শিল্পের। সৌদি আরবে সিনেমা মুক্তিতে ৩৫ বছরের নিষেধাজ্ঞা উঠেছে মাত্র ৪ বছর হলো।
তবে সংবেদনশীল ধর্মীয় বা রাজনৈতিক বিষয়, যৌনতা ও সমকামিতা স্পর্শ করে এমন সিনেমা দেশটিতে এখনো নিষিদ্ধ। পশ্চিম এশিয়ার সিনেমাগুলো সবচেয়ে বেশি মুক্তি পায় সেদেশে। বর্তমানে সৌদি আরবে ১৫৪টি সিনেমা হল চালু আছে।
এমন অবস্থায় সৌদি আরবের সিনেমাবাজার নিয়ে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ভ্যারাইটি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পশ্চিম এশিয়ার শীর্ষ সিনেমার বাজারে পরিণত হতে যাচ্ছে সৌদি আরব। ২০২০ সালে সৌদি আরবের সিনেমার বাজার থেকে আয় হয় ১৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
এক বছরের ব্যবধানে সেই আয় বেড়েছে তিনগুণ। ২০২১ সালে সিনেমার বাজার থেকে সৌদি আরবের আয় ৪৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩ হাজার ৮৫০ কোটি টাকার বেশি।
প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়, সিনেমা পরিবেশক সংস্থা ভক্স ৩ বছর আগে সৌদি আরবে প্রবেশ করে। যারা এই ৩ বছরে দেশটির ছয়টি শহরে নতুন ১৫টি সিনেমা হল খুলেছে। বর্তমানে দেশটিতে ১৫৪টি সিনেমা হল চালু আছে, যাতে ৫০০ স্ক্রিনে সিনেমা প্রদর্শিত হয়।
সৌদি নারীদের জীবন বদল
সৌদি আরবে গত কয়েকবছর ধরে নারী অধিকারসহ নানা বিষয়ে সংস্কারকাজ চলছে৷ ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মেদ বিন সালমানের সংস্কার কর্মসূচি ‘ভিশন ২০৩০’ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে সৌদি নারীরা বিভিন্ন সুবিধা পাচ্ছেন৷
গাড়ি চালানো থেকে শুরু করে সৌদি নারীরা পুরুষ সঙ্গীর অনুমতি ছাড়াই ব্যবসা শুরু করতে পারছেন৷ কর্মক্ষেত্রে সৌদি নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানোরও পরিকল্পনা করা হয়েছে৷
২০৩০ সালের মধ্যে মোট জনশক্তির এক তৃতীয়াংশ নারী করতে চায় দেশটি৷ এ সব ছাড়াও সম্প্রতি প্রথম নারী রেস্তোরাঁ মালিক, প্রথম নারী পশু চিকিৎসক, প্রথম নারী ট্যুর গাইড পেয়েছে সৌদি আরব৷
২০১৭ সালের পর সৌদির পরিস্থিতি কিছুটা বদলেছে। যুবরাজ সালমান দেশটির সামাজিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনায় আগের চেয়ে স্বাধীনভাবে চলতে ফিরতে পারছেন নারীরা। ২০১৭ সালের আগে সৌদিতে নারীদের সাইকেল চালানোর কথা যেখানে ভাবাই যেতো না।
২০১৮ সালে নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতি দেয় দেশটি। ফলে গাড়ি চালাতে সৌদি নারীদের আর কোনো পুরুষ অভিভাবকের অনুমতি নিতে হবে না। এছাড়া গাড়ি চালানোর লাইসেন্স পাচ্ছেন তারা।
ওজন ও উচ্চতার শর্ত পূরণ করে নারীরা সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে পারবে। তবে অন্তত উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা শেষ করা লাগবে তাদের।
২০২০ সালে সৌদি আইন মন্ত্রণালয় ১০০ নারীকে পাবলিক নোটারি হিসেবে নিয়োগ দেয়। চলতি বছর জানুয়ারিতে ঘোষণা দেওয়া হয়, শিগগিরই আদালতে নারী বিচারকও নিয়োগ দেওয়া হবে।
২০২০ সালের ডিসেম্বরে প্রথমবারের মতো নারী বিমানবালা নিয়োগ দেয় সৌদি অ্যারাবিয়ান এয়ারলাইনস। দেশটিতে নারী যাত্রীদের সেবার জন্য ৫০ জন বিমানবালা নিয়োগ করা হয়।
সৌদি আরবকে আরও আধুনিক, উদার এবং ব্যবসা ও পর্যটনবান্ধব করতে ২০১৬ সালে ‘ভিশন ২০৩০’ ঘোষণা করেছিলেন ক্রাউন প্রিন্স মোহামেদ বিন সালমান৷ এরপর বেশ কিছু আইনে পরিবর্তন করা হয়৷ ফলে সেদেশের নারীরা এখন গাড়ি চালানো, একা সিনেমা হলে যাওয়া, ঘুরতে যাওয়াসহ নানান কাজ করতে পারছেন৷
সাম্প্রতিক পরিবর্তনগুলোও ভিশন ২০৩০ এর অংশ বলে বিবেচনা করা যেতে পারে৷ এমনও কথা শোনা যাচ্ছে, সেখানে অ্যালকোহল পান বিষয়ে সীমিত পরিসরে হলেও অনুমোদন দেয়া হতে পারে৷
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কট্টর রক্ষণশীল দেশ হিসেবে পরিচিত সৌদি আরব দেরি হলেও নিজেদের বুঝতে পারার চেষ্টা করছে। উবার চালানো, সাইকেল চালানো সৌদি নারীদের জন্য যুগান্তকারী এক ব্যাপার বটে। বিশ্বের অন্যান্য স্বাধীন নারীদের মতো সৌদি আরবের নারীরাও নিজেদের স্বাধীনতা ফিরে পাবেন এমন প্রত্যাশা লক্ষণীয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩১৫
আপনার মতামত জানানঃ