৯/১১ ট্র্যাজেডির পর থেকে উদ্বেগজনক হারে ইসলাম-ফোবিয়া বৃদ্ধি পেয়েছে। এ তালিকায় শীর্ষে রয়েছে ইউরোপ। পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে সংঘটিত বিচ্ছিন্ন, বিশেষ করে সন্ত্রাসী ঘটনার সঙ্গে ইসলামকে জড়িত থাকা যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এতেই ইসলামের প্রতি আতঙ্ক তৈরি হচ্ছে।
এবার নেদারল্যান্ডের মসজিদে ইসলাম ও মহানবী মুহাম্মদ (সা.)-এর ব্যঙ্গচিত্র সম্বলিত কিছু চিঠি পাওয়া গেছে। তবে কারা এসব চিঠি পাঠিয়েছে তা জানা যায়নি।
গত সোমবার (৩ জানুয়ারি) এক বিবৃতিতে এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে দ্য ডাচ রিলিজিয়াস ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষ।
বিবৃতিতে বলা হয়, গত সপ্তাহে ফাউন্ডেশন পরিচালিত কয়েকটি মসজিদে ঘৃণ্য চিঠি পাঠানো হয়। তাতে ইসলাম, মহানবী (সা.) ও আমাদের মূল্যাবোধকে অবমাননা করে অনেক ঘৃণ্য কথা লেখা হয়।’
তাতে আরো বলা হয়, এর আগে এ ধরনের হুমকি-ধমকি সম্বলিত চিঠি সরাসরি হামলা করতে উৎসাহ দিয়েছে।
বিবৃতিতে সব উপসনালয় ও অনুভূতির অবমাননার তীব্র নিন্দা জানানো হয়। এছাড়াও মসজিদ সংশ্লিষ্টদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করা এমন ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে বিচারের জন্য সোপর্দ করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানানো হয়।
গত ৪০ বছর যাবত নেদারল্যান্ডের ফাউন্ডেশনটি জনসেবামূলক নানা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। তাছাড়া সব মুসলিমের ধর্মীয় দায়িত্ব পালনে ব্যবস্থা করে আসছে প্রতিষ্ঠানটি।
নেদারল্যান্ডে ইসলামের বিকাশ
ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে নেদারল্যান্ডে ইসলামের অগ্রযাত্রা সূচিত হয়। ১৯৬০ থেকে ১৯৭৩ সালের মধ্যে নেদারল্যান্ডে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সূচনালগ্নে ডাচ সরকার পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ বিশেষত তুরস্ক, মরক্কো ও ইন্দোনেশিয়া থেকে ১২ লাখ ১৯ হাজার ৭৫৩ মুসলমানকে নেদারল্যান্ডে অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে আমন্ত্রণ জানায়।
মুসলমানরা মূলত আমস্টারডাম, রটেরডাম, হেগ ও আটরেস্টে বসবাস করে। ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে বসনিয়া, সুরিনাম, সোমালিয়া, ইরান, পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ইরাক থেকে বহু মুসলমান রাজনৈতিক আশ্রয়ে নেদারল্যান্ডে আসে।
তরুণ মুসলমানদের অনেকেই ডাচ মেয়েদের বিয়ে করার ফলে স্থায়ীভাবে ডাচ সমাজের সঙ্গে একীভূত হওয়ার সুযোগ পায়। ২০০৬ সাল পর্যন্ত দাওয়াত ও তাবলিগি কর্মকাণ্ডের ফলে আট হাজার ৫০০ ডাচ অধিবাসী কোরআন-সুন্নাহর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ইসলাম কবুল করে।
২০১০ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী পুরো নেদারল্যান্ডে ৫৫৩টি মসজিদ রয়েছে। এর মধ্যে ৪০০ মসজিদ তুর্কিদের অধীনে এবং ১৪০টি মসজিদ মরক্কোবাসী দ্বারা পরিচালিত। সুরিনামি মুসলমানরা ৫০টি মসজিদ পরিচালনা করে থাকে।
ইমামদের মধ্যে বেশির ভাগই মিসরীয়, সিরিয়ান, সুদানি ও সোমালিয়ান বংশোদ্ভূত। নেদারল্যান্ডে মুসলমানদের সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। বেশির ভাগ সুন্নি মুসলিম। অল্পসংখ্যক শিয়া ও কাদিয়ানি রয়েছে।
৪৫টি সরকার অনুমোদিত মাদরাসা, প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয় মুসলমানরা পরিচালনা করে থাকে। সেখানে সরকারি পাঠক্রমের পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা হয়।
রাজনীতিতে মুসলমানরা বেশ সক্রিয়। ১৫০ সদস্যবিশিষ্ট পার্লামেন্টে সব সময় মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব থাকে। ২০০৩ সালের নির্বাচনে ১০ মুসলিম পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হন।
সেপ্টেম্বর ১১, ২০০১ সাল থেকে সৃষ্ট ‘ইসলামফোবিয়া’র ঢেউ নেদারল্যান্ডেও লাগে। ফলে পারস্পরিক অবিশ্বাস, সন্দেহ, অস্থিরতার রেশও কম নয়।
মরক্কোর বংশোদ্ভূত ডাচ নাগরিক আহমদ আবু তালিব ২০০৮ সালে রটেরডামের মেয়র নির্বাচিত হন। ২০০৭ সালে গঠিত প্রধানমন্ত্রী বালকেনেন্দের মন্ত্রিসভায় দুজন মুসলিম মন্ত্রী নিযুক্ত হন। তারা হলেন যথাক্রমে বিচার ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী নেবাহাত আল বাইরাক ও আহমদ আবু তালিব।
ডাচ সরকার মুসলমানদের ধর্মীয় ঐতিহ্য, আচার-অনুষ্ঠানে হস্তক্ষেপ করে না। নাগরিক সুবিধা লাভে মুসলমানদের কোনো বৈষম্যের শিকার হতে হয় না। ভোটাধিকার, ধর্ম অনুশীলন ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংবিধান স্বীকৃত।
সংখ্যালঘু বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সংহতি প্রতিষ্ঠায় সরকার সচেষ্ট। মুসলিম মহিলারা স্কার্ফ ও বোরকা পরে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ও বাজারে চলাফেরা করতে পারেন। কিছু নিয়ম-কানুন মেনে কোরবানির পশু জবাই করা যায়। মুসলিম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরকারি অনুদানও প্রদান করা হয়।
প্রতিবছর মরক্কো ও তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশ থেকে ৫০ জন ইমাম নিয়োগ করা হয়। সরকারি সহযোগিতায় নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত ইমামদের ৬০০ ঘণ্টা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে, যাতে তারা ডাচ ভাষা ও ডাচ সমাজের নিয়ম-রীতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করতে সক্ষম হন। মসজিদ, মুসলমান ও ইসলামিক স্কুলের অবস্থিতির কারণে পুরো নেদারল্যান্ডে ইসলামী পরিবেশ বিরাজিত।
এসডব্লিউ/এসএস/১২৩০
আপনার মতামত জানানঃ