দাবানল, দাবদাহ, খরা, বন্যা, মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ও ঘূর্ণিঝড়ে বিশ্ব এখন বিপর্যস্ত। অঞ্চলভেদে বিভিন্ন দেশে এসব দুর্যোগ দেখা যাচ্ছে। চীন, ভারত ও জার্মানিতে চলতি মৌসুমে কয়েক দফা বন্যা, ঘূর্ণিঝড় হয়েছে। কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র স্মরণকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার মুখে পড়েছে। গ্রিস, তুরস্ক, ইতালিসহ দক্ষিণ ইউরোপ পুড়ছে দাবানলে। বেলজিয়ামসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশ রেকর্ড বৃষ্টিপাত দেখেছে। ব্রাজিল, মাদাগাস্কারসহ গোটা আফ্রিকা খরায় বিপর্যস্ত। জলবায়ুর এমন চরম বৈরিতার মুখে বিশ্ব।
বর্তমান বিশ্বে ব্যাপকভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীতে প্রতি বছর ত্বরিত গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে গড় তাপমাত্রার পরিমাণ। সাম্প্রতিক সময়ে অতিমাত্রা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এখন বিশ্বকে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের এই বিরূপ প্রভাবের কবলে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
সম্প্রতি, প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা ধরে ৪০০ কিমি বেগে টর্নেডো বয়ে গিয়েছে আরকানসাস থেকে কেন্টাকি অবধি। মিসৌরি ও ইলিওনিসও রক্ষা পায়নি।
এবার আমেরিকার কলোরাডোয় ভয়াবহ দাবানলের সৃষ্টি হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন, পুড়ছে বাড়ি এবং ব্যবসার জায়গা। এখনো পর্যন্ত আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। খবর ডয়েচে ভেলে
সংবাদমাধ্যমকে কলোরাডোর মেয়র জানিয়েছেন, ভয়াবহ আগুন এখনো পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। দমকলকর্মীরা দিনরাত কাজ করছেন। প্রায় ১৬০ কিলোমিটার জুড়ে আগুন লেগেছে। যার ফলে ওই অঞ্চলের দুই এলাকার মানুষকে সরিয়ে নিতে হয়েছে। তাদের আপাতত নিরাপদ স্থানে রাখা হয়েছে।
মেয়রের বয়ান অনুযায়ী অন্তত কয়েক হাজার মানুষ গৃহহীন। বাড়িঘর ছেড়ে তারা চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন। অন্তত পাঁচশ বাড়ি আগুনে জ্বলে গেছে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে সংখ্যাটি কয়েকগুণ বাড়তে পারে বলে তিনি জানিয়েছেন।
কলোরাডো বরাবরই শুকনো অঞ্চল। এ বছর সেখানে বৃষ্টি হয়নি বললেই চলে। ফলে আরো বেশি শুকনো হয়ে গেছে। খরার মতো পরিস্থিতি। তার উপর আগুন লাগায় বহু মানুষ অসহায় পড়েছেন। তারা শুধু ঘর হারাননি, কাজও হারিয়েছেন। বহু ব্যবসার প্রতিষ্ঠান আগুনে ভস্মিভূত হয়ে গেছে বলে জানা গেছে।
প্রশাসন অবশ্য আশ্বাস দিয়েছে, আশ্রয়হীন মানুষদের পাশে দাঁড়ানো হবে। তারা যাতে ঘুরে দাঁড়াতে পারেন, তা দেখা হবে।
ভয়াবহ আগুন এখনো পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। দমকলকর্মীরা দিনরাত কাজ করছেন। প্রায় ১৬০ কিলোমিটার জুড়ে আগুন লেগেছে। যার ফলে ওই অঞ্চলের দুই এলাকার মানুষকে সরিয়ে নিতে হয়েছে।
চলতি বছর ক্যালিফোর্নিয়ায় দাবানলে ৩২ লাখ একর বন পুড়ে গেছে। এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জানিয়েছেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগে এ বছর দেশটিতে ১০ হাজার কোটি ডলার ক্ষয়-ক্ষতির আশঙ্কা করছেন তিনি।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে তাপমাত্রা বেড়ে চলা ও খরা পরিস্থিতির কারণে পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হচ্ছে দেশটিতে। প্রতি বছরই আগের চেয়ে বেশি শুষ্ক ও গরম আবহাওয়া দেখা যাচ্ছে সেখানে, যার ফলে বাড়ছে দাবানলের সংখ্যাও।
ওরেগন, ওয়াশিংটন আর ক্যালিফোর্নিয়া— আমেরিকার পশ্চিম অংশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলই এখন ভয়াবহ দাবানলের কবলে। গত কয়েক মাস থেকে পুড়ে খাক হয়ে গেছে প্রচুর সম্পত্তি। প্রায় অর্ধ কোটি একর এলাকা পুড়ে যাবার পাশাপাশি ১৫ সেপ্টেমবর পর্যন্ত দাবানলের শিকার হয়ে মারা গেছেন মোট ৩৬ জন। সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর খবর এসেছে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে। ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে সেখানে। ওয়াশিংটনে মারা গেছেন একজন। বাকি সব মৃত্যুই ওরেগনের। বাড়ি থেকে শেষ মুহূর্তে বেরোতে না পেরেই পুড়ে মারা গিয়েছেন অনেকে। কিন্তু মৃত্যুর থেকেও প্রশাসনকে এখন বেশি ভাবাচ্ছে নিখোঁজের সংখ্যা। ওরেগনেই এখনও পর্যন্ত খোঁজ নেই বহু বাসিন্দার। ফলে মৃতের সংখ্যা হু হু করে বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, উন্নত দেশগুলো অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে যেভাবে প্রকৃতির সঙ্গে যথেচ্ছাচার করেছে, তাতে প্রকৃতি রুষ্ট হয়ে উঠেছে। কারণ, প্রকৃতি একটি জীবন্ত সত্তা, তাকে শুধু সম্পদ লাভের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। অথচ এ বিষয়টিকে আমলে না নিয়ে উন্নত দেশগুলো নিজেদের তথাকথিত উন্নয়নের স্বার্থে জলবায়ু তহবিল, কার্বন ট্রেড প্রভৃতি তৈরি করে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে টোপ দিয়ে যাচ্ছে।
তারা বলেন, জলবায়ু সম্মেলনগুলোর মূল সুরে সমস্যা সমাধানের কোনো ব্যাপার থাকে না। কারণ, এর মধ্য দিয়ে কার্বন নিঃসরণ কমানোর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। কিন্তু এমন একটা ভাব করা হয় যে সমস্যাটি আমলে নেওয়া হয়েছে। কথা হচ্ছে, দুনিয়ার উন্নয়নের মডেল যেন প্রকৃতির ওপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা না করে প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়, সেটাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
তারা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যাটি যেমন পরিবেশগত, তেমনি একই সঙ্গে তা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকও বটে। উন্নত দেশগুলোর কারণেই এই জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, ফলে তাদের কার্বন উদ্গিরণ হ্রাসে বাধ্য করতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন সদিচ্ছা, কার্যকর কূটনীতি ও রাজনীতি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭১১
আপনার মতামত জানানঃ