সৌদি আরবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে এবার গুরুত্ব বাড়ছে বিনোদন শিল্পের। সদ্যই সৌদি আরবের সংগীত উৎসব ‘সাউন্ডস্টর্ম সংগীত উৎসব’ শেষ হলো। চারদিনের সংগীত উৎসবে সাত লাখের বেশি অতিথি অংশগ্রহণ করেছে। এর রেশ যেতে না যেতেই সৌদিবাসীর জন্য ‘নিউ ইয়ার’ আসছে বাড়তি আনন্দ হয়ে। নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর জন্য বিশ্বের বিভিন্ন জনপদের মতো মহা ধুমধামে প্রস্তুতি নিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরবও। জমকালো আয়োজন আর আতশবাজির রঙিন আলোর ঝলকানিতে ২০২২ সালকে স্বাগত জানাবে সৌদিবাসী।
‘আসুন নাচুন, কথা বলুন দেহের ভাষায়’- নিউ ইয়ার উপলক্ষে এমনই আহ্বান জানিয়েছে ইউ ওয়াক শপিং সেন্টারের হোটেল কার্টাজেনা। সেখানে থাকবে রাতে নৃত্য উপভোগের সুযোগ।
বৃহস্পতিবার (৩০ ডিসেম্বর) আরব নিউজের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ৩১ ডিসেম্বর মধ্যরাতে নাচ-গান-ডিজে, আতশবাজি, খাবার ও পানীয়তে ডুববেন সৌদির অনেক নাগরিক। আনন্দ-উচ্ছ্বাসের মধ্য দিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা।
আরব নিউজ বলছে, নিউ ইয়ারে রিয়াদে হবে তিন দিনব্যাপী সংগীত উৎসব। ৩১ ডিসেম্বর মোহাম্মদ আবদুতে আরবের প্রসিদ্ধ ১৩ জন শিল্পী সুর-সংগীতে ঝড় তুলবেন। রিয়াদের বুলেভার্ড ও এর আশপাশ আলোকিত হবে আতশবাজির আলোয় ছটায়। বিভিন্ন হোটেল-রেস্টুরেন্টে পরিবার-পরিজন ও বন্ধুদের নিয়ে পার্টি করবে মানুষ।
অবশ্য এসবই করতে হবে সীমা লঙ্ঘন না করে। মানতে হবে করোনা সংক্রমণ রোধে সামাজিক দূরত্ব ও বিধিনিষেধ। করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রনের ঝুঁকি বিবেচনায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে রেস্টুরেন্টের এক টেবিলে পাঁচজনের বেশি খেতে পারবেন না।
সৌদি আরবে ইংরেজি নতুন বছর উদযাপন একটি রীতিতে পরিণত হয়েছে বলে উল্লেখ করেন আকিল নামের এক তরুণী। রিয়াদের ৩০ বছর বয়সী এই বাসিন্দা আরব নিউজকে বলেন, প্রতি বছর এই দিনে আমরা গাড়ি নিয়ে ঘুরতে বের হই। কিছু খাবার ও পানীয় নিয়ে রিয়াদের কোনো স্পটে গিয়ে বসি। তারপর নানা আয়োজনে রাতটাকে উপভোগ করি।
এ বছরও তারা এমনটা করবেন জানিয়ে আকিল বলেন, কোথাও বসে সংগীত ও আতশবাজি উপভোগ করব। তবে অবশ্যই কোলাহল থেকে খানিকটা দূরে থেকে, সেটাই আমার পছন্দ।
সৌদি আরবের অন্যান্য অঞ্চলেও রয়েছে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর নানা আয়োজন।
জেদ্দায় লোহিত সাগরের উপকূলে খোলা আকাশের নিচে বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে খাবারের পাশাপাশি উপভোগ করা যাবে লাইভ মিউজিক। এদিন কেউ কেউ ভ্রমণে বের হবেন মরুভূমিতে। বিভিন্ন ট্র্যাভেল এজেন্সিগুলো এ জন্য বিশেষ প্যাকেজ ঘোষণা করেছে।
ট্র্যাভেল এজেন্সি ‘ডিস্টিফাইন্ড’-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আব্দুর রহমান আল-সাতি আরব নিউজকে বলেন, নিউ ইয়ার ঘিরে ভ্রমণ প্যাকেজের ব্যাপক চাহিদা। ফলে অনেকেই কাঙ্ক্ষিত টিকিট না পেয়ে আরও টিকিট ছাড়ার দাবি জানিয়েছেন।
৩১ ডিসেম্বর মধ্যরাতে নাচ-গান-ডিজে, আতশবাজি, খাবার ও পানীয়তে ডুববেন সৌদির অনেক নাগরিক। আনন্দ-উচ্ছ্বাসের মধ্য দিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা।
গত শতক পর্যন্ত সৌদির ক্ষমতাসীন আল সৌদ পরিবার অনেকটা নিশ্চিন্তেই শাসনকার্য চালিয়ে গেছে। তাদের মূল ভরসা দেশটির বিপুল তেলসম্পদ। আর রক্ষণশীল ধর্মীয় নেতাদের সমর্থন। কিন্তু সময় বদলে গেছে। সৌদি আরবকে এখন একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে।
বিশ্বজুড়ে এখন তারুণ্যের জয়জয়কার। তাদের অবজ্ঞা করা কোনো শাসকের পক্ষেই সম্ভব না। তরুণদের উপেক্ষার পরিণতিতে মসনদও উল্টে যেতে পারে। সৌদি বাদশা সালমানকে দূরদর্শীই বলতে হয়। তিনি বাস্তবতা বুঝতে পেরেছেন। তারুণ্যকে গুরুত্ব দিয়ে তিনি তার ৩২ বছর বয়সী ছেলে মোহাম্মদ বিন সালমানকে ক্রাউন প্রিন্স করেছেন। সিংহাসনের এই উত্তরাধিকারী এখন সৌদির সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের প্রধান সারথি।
কদিন আগেই সৌদি আরবের সংগীত উৎসব ‘সাউন্ডস্টর্ম সংগীত উৎসব’ শেষ হলো। চারদিনের সংগীত উৎসবে সাত লাখের বেশি অতিথি অংশগ্রহণ করেছে। উৎসবের শেষ দিনে যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ে সৌদি নাগরিকরা।
উৎসবটি ২০১৯ সালে চালু হওয়ার পর থেকে বিশাল জনসমাগম হয়। যাদের বেশির ভাগই যুবক ও নারী। যারা অবাধে মিশতে এবং পশ্চিমা সংগীতের তালে নাচতে পারে।
উৎসবে যোগদানকারী এক সৌদি নারী এএফপিকে বলেন, আমরা রিয়াদে এর আগে এমন কিছু দেখিনি। ভিড়, গান, ভিআইপি রুম। সেই সঙ্গে অপ্রচলিত সাজ ও পোশাক।
সৌদি আরবের মানবাধিকার রেকর্ডের বয়কটের আহ্বান সত্ত্বেও সুপারস্টার ফরাসি ডিজে ডেভিড গুয়েটাসহ আন্তর্জাতিক বিনোদনকারীরা এবং সংগীতশিল্পীরা অনুষ্ঠানে পারফর্ম করেন।
সৌদি আরবে করোনার নতুন রূপ ওমিক্রন ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কার মাঝেই সম্প্রতি শেষ হয় এই উৎসব। সৌদি আরবে আরব উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে করোনায় সর্বাধিক (৮৮৬০ জন) মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।
উল্লেখ্য, ইলেকট্রনিক মিউজিক ফেস্টিভ্যালটি এমন সময় অনুষ্ঠিত হলো যখন সৌদি আরবের নেতারা রক্ষণশীল ভাবমূর্তি পরিবর্তন করতে চাইছে। সেই সঙ্গে এর অর্থনীতিতে চলছে বৈচিত্র্য আনার প্রচেষ্টা। অল্প ক’বছর আগে দেশটি সংগীত ও নাচের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়।
দেশটির জেনারেল এন্টারটেইনমেন্ট অথরিটির প্রধান তুর্কি আল-শেখ বলেন, ৪ দিনে ৭ লাখ ৩২ হাজার মানুষ এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন। বিশ্বের বৃহত্তম সংগীত উৎসবগুলোর একটি এটি।
সৌদি আরবের মানুষ সর্বশেষ সিনেমা দেখেছিলেন ১৯৭০ সালে। সে সময় দেশটির কট্টরপন্থী ধর্মীয় নেতাদের চাপে সিনেমা হলগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। ৩৫ বছরর ধরে সেখানে কোন সিনেমা হল ছিল না। ২০১৮ সালে সিনেমা হলের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় দেশটির রাজপরিবার।
এই দীর্ঘ বিরতির পর ২০১৮ সালের ১৮ এপ্রিল রিয়াদে চালু হয় দেশটির প্রথম সিনেমা হল। সিনেমার কদর বাড়ায় দেশটিতে বাড়ছে হলের সংখ্যাও। গত তিন বছরে ১১ প্রতিষ্ঠানকে সিনেমা হল নির্মাণ এবং চলচ্চিত্র প্রদর্শনের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। বড় শহরগুলোর পাশাপাশি সৌদির গ্রামাঞ্চলেও বেড়েছে বিদেশি সিনেমার কদর।
সে জন্য বিশ্বের সবচেয়ে বড় সিনেমা হল চেইন আমেরিকান মুভি ক্লাসিকস বা এএমসির সঙ্গে চুক্তি হয়েছে দেশটির। বিনোদনের নানা উৎসে হাজার হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগের অংশ হিসেবে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে দেশটির ১২ শহরে ৩৪টি সিনেমা হলে ৩৫ হাজার দর্শক ছবি দেখার সুযোগ পাচ্ছেন।
ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান ‘ভিশন ২০৩০’ ঘোষণা করেন ২০১৬ সালে৷ সামাজিক-অর্থনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে দেশকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে নেয়ার গতিপথ নির্ধারণের সেই ঘোষণার আওতায় চলচ্চিত্র শিল্পকেও গুরুত্ব দেয়া হয়৷ রক্ষণশীলতা থেকে উদার, আধুনিকতার পথে যাত্রার অঙ্গিকার জন্ম দেয় চলচ্চিত্র খাতকে ঘিরে অন্তত ৩০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা৷
২০১৮ সালে চলচ্চিত্রের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয় সৌদি আরবের সংস্কৃতি ও তথ্য মন্ত্রণালয়৷ সেই থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে নতুন যাত্রা শুরু করেছে চলচ্চিত্র শিল্প৷ আরব চলচ্চিত্র শিল্পের বিশেষজ্ঞ, লেবাননের তথ্যচিত্র পরিচালক এবং প্রযোজক জাইনা স্ফের ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘মহামারি শুরুর আগে প্রতি শুক্রবার শপিং মলগুলোতে থিয়েটারে মুভি দেখতে আসা মানুষদের ভিড় জমতো৷’
গত ৩৫ বছরে নিষেধাজ্ঞার কারণে হারিয়ে যেতে বসা চলচ্চিত্র শিল্প নিষেধের বেড়া সরতেই জেগে ওঠে পূর্ণ উৎসাহে৷ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার চার মাসের মধ্যেই রিয়াদে খুলে যায় প্রথম সিনেমা হলের দরজা৷ ২০১৮ সালের ১৮ এপ্রিল সেই প্রেক্ষাগৃহে দেখানো হয় ‘পিঙ্ক প্যান্থার’৷ নারী এবং পুরুষদের জন্য আলাদা বসার ব্যবস্থা ছিল, আবার একসঙ্গে বসে চলচ্চিত্র উপভোগের সুযোগও ছিল সেখানে৷ কোনো আসনই খালি ছিল না৷
২০৩০ সালের মধ্যে সারা দেশে ৩৫০টি সিনেমা হল এবং ২৫০০ মুভি স্ক্রিন তৈরির লক্ষ্য স্থির করেছে ক্রাউন প্রিন্স সালমানের সরকার৷ এ কাজ দেখভাল করবে জেনারেল কমিশন ফর অডিওভিজ্যুয়েল মিডিয়া (জিসিএএম)৷ শুধু যে চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থাই করা হচ্ছে, তা নয়৷ চলচ্চিত্রকে এক বিলিয়ন ডলারের একটা শিল্প হিসেবে গড়ে তুলতে চায় সরকার৷ এছাড়া ঘরে ঘরে চলচ্চিত্রকে পৌঁছে দিতে বিনোদন খাতে জিডিপির শতকরা তিন ভাগ ব্যয়কে ২০৩০ সালের মধ্যে বাড়িয়ে শতকরা ছয় ভাগ করতে চায় রাজতান্ত্রিক দেশটির সরকার৷
তবে সৌদি আরবের ব্রিটিশ কাউন্সিলের সাম্প্রতিক এক সমীক্ষা বলছে, নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও এখনো স্বচ্ছন্দে চলার সুযোগ পাচ্ছে না চলচ্চিত্র৷ ৪২২ জন চলচ্চিত্রপ্রেমী, চলচ্চিত্র পরিচালক, অভিনেতা-অভিনেত্রীসহ সমাজের নানা স্তরের মানুষের সঙ্গে কথা বলে তৈরি সমীক্ষায় ৪৩ ভাগ মানুষই বলেছেন বাণিজ্যিক বিনিয়োগের ঘাটতি চলচ্চিত্রের বিকাশের পথে বড় অন্তরায়৷
সমীক্ষায় অংশ নেয়া ৭৭ ভাগ মানুষ মনে করেন, অনলাইনে দেখানো হলে চলচ্চিত্রকে জাগিয়ে তোলার উদ্যোগ সফল হবে৷ এছাড়া কঠোর সেন্সরশিপকে চলচ্চিত্র শিল্পের কাঙ্খিত অগ্রগতির পথে বাধা হিসেবে উল্লেখ করেছেন অনেকে৷
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪১৮
আপনার মতামত জানানঃ