চলতি বছরের ১৫ আগস্ট আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল নিয়ন্ত্রণে নেয় তালিবান। এরপর তারা নতুন সরকার গঠন করলেও এখনো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলেনি। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে চরম আর্থিক সংকটে পড়েছে দেশটি। দেখা দিয়েছে চরম খাদ্য সংকট।
হাহাকার চলছে দেশটিতে। খাবারের জন্য হন্যে হয়ে ছুটছে মানুষ। তার ওপর আসছে তীব্র শীত, বাড়ছে শঙ্কা। কারণ, ইতিমধ্যে অনেক এলাকা খরার কবলে পড়েছে। ফলে ফসল উৎপাদনে ধস নামার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ ছাড়া তালিবান ক্ষমতায় আসার পর দেশটিতে আন্তর্জাতিক ত্রাণ সহায়তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সামনের দিনগুলোতে ভয়ংকর বিপর্যয়ের মুখে পড়তে যাচ্ছে আফগানেরা।
আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহার প্রক্রিয়ার মধ্যে ১৫ আগস্ট কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেয় তালিবান। যদিও এর আগে বিভিন্ন প্রদেশে লড়াই করতে হয়েছে সশস্ত্র এ গোষ্ঠীকে। এ সময় বিভিন্ন প্রদেশ থেকে বহু আফগান আত্মরক্ষার্থে পালিয়ে রাজধানী কাবুলে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তারা এখনও সেখানেই খোলা আকাশের নিচে বাস করছেন। ক্ষুধা ও নানা সমস্যায় জর্জরিত এসব আফগান যাপন করছেন মানবেতর জীবন।
আফগানিস্তানের এখন যেখানেই যাওয়া হোক না কেন শিশু শ্রমিকদের দেখতে পাওয়া যায়। গাড়ি পরিষ্কার, আবর্জনার স্তূপ থেকে কিছু সংগ্রহ, জুতো পালিশ থেকে শুরু করে নানা ধরনের কাজ করছে তারা। নিজের ও পরিবারের মুখে খাবার তুলে দিতেই বই-খাতা ছেড়ে উপার্জনের পথে নামতে তাদের এ চেষ্টা।
আফগানিস্তানের অর্থনীতি প্রায় ধসে পড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে দেশব্যাপী। দেশটির লাখ লাখ মানুষ খাদ্য সংকটে পড়েছেন। তাই বাধ্য হয়ে দেশটির শিশুরাও কাজ করছে। পরিবারের খাদ্য যোগারে তাদেরও শ্রম দিতে হচ্ছে। প্রতিনিয়ত বাড়ছে খাদ্য সংকট। আর বাড়ছে শিশুদের কাজে যোগদানের পরিমাণও। বিবিসির প্রতিবেদনে আফগান শিশুদের কঠিন পরিস্থিতির চিত্র উঠে এসেছে।
তালিবান দেশটির ক্ষমতা নেওয়ার আগ থেকেই খরায় দেশটির কৃষি শস্য নষ্ট হলে খাদ্য সংকটে পড়ে আফগানরা। তালিবান ক্ষমতা নেওয়ার পর সেই সংকট আরও তীব্র হয়। যা হাজার হাজার শিশুকে কাজ করতে বাধ্য করে।
২০২১ সালের ১৫ আগস্ট আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল দখলে নেয় তালিবান। এরপর ৩১ আগস্ট টানা ২০ বছরের যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে শেষ পর্যন্ত দেশটি থেকে সব সেনা প্রত্যাহার করে নেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্ররা। এরপর রাজনৈতিক গোলযোগ ও বিশৃঙ্খলার মধ্যে দেশ ছেড়ে অন্য দেশে আশ্রয় নেয় বহু আফগান পরিবার। কিন্তু যারা দেশ ছাড়তে পারেননি তারা পড়েছেন চরম বিপাকে।
তালিবান আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকেই একের পর এক সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে দেশটিতে। নিরাপত্তার অভাব, সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কা, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছে দেশটি। মুখ থুবড়ে পড়েছে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা।
আফগানিস্তানের এখন যেখানেই যাওয়া হোক না কেন শিশু শ্রমিকদের দেখতে পাওয়া যায়। গাড়ি পরিষ্কার, আবর্জনার স্তূপ থেকে কিছু সংগ্রহ, জুতো পালিশ থেকে শুরু করে নানা ধরনের কাজ করছে তারা। নিজের ও পরিবারের মুখে খাবার তুলে দিতেই বই-খাতা ছেড়ে উপার্জনের পথে নামতে তাদের এ চেষ্টা।
তালিবান ক্ষমতা নেওয়ার পর আন্তর্জাতিক অনুদানে ভাটা পড়ে। কারণ তালিবান ক্ষমতা দখলের পর দাতা সংস্থাগুলো তাদের অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়। তার মধ্যে দেওয়া হয় নিষেধাজ্ঞা। এতে করে দেশব্যাপী বেকার হয়ে পড়েন হাজার হাজার মানুষ। ফলে পরিবারের খাদ্য সংকট কাটাতে শিশুদেরও নামতে হয় কাজে।
দেশটির রাজধানী কাবুলে সম্প্রতি জুতা পরিষ্কারের কাজে নেমেছে এমন একদল শিশুর সঙ্গে সারাদিন কাটিয়ে ভিডিও প্রতিবেদন করেছেন বিবিসির সেকুন্ডার কেরমানি। তার অংশ বিশেষে শিশুরা বলে, তারা কেন কাজে নেমেছে এবং তাদের পরিবারের দুরাবস্থার কথা।
এক শিশু বলে, আমার বাবা কাজ হারিয়েছেন। বাড়ির আর কারও কাজ ছিল না। তাই আমি জুতা পরিষ্কারের কাজ শুরু করি।
আরেক শিশু জানায় সে গাড়ি পরিষ্কার করে। তাকে জিজ্ঞাসা করা হয় তার কাজ করতে কষ্ট হয় কি না। উত্তরে সে বলে, হ্যাঁ কষ্ট হয়। এসময় তার তিন কাজিনকে দেখিয়ে বলে তারা এক মাস আগ থেকে কাজ শুরু করেছে। সে তাদের সঙ্গে থাকে।
কাবুলের যেকোনো জায়গায় এখন শিশুদের কাজ করতে দেখা যায়। কেউ গাড়িতে ধুপের ধোঁয়া দেয়। কেউ ময়লা আবর্জনা থেকে এটা সেটা সংগ্রহ করে। শিশুরা সকালে ঘুম থেকে উঠেই কাজের খোঁজে বের হয়।
আফগানিস্তানের অর্থনীতি মূলত টিকে আছে বিদেশি সহায়তার ওপর। বিশ্বব্যাংক বলছে, সরকারি বিভিন্ন খাতের ৭৫ শতাংশ খরচই মেটে বিদেশি সহায়তা থেকে। তালিবানের হাতে কাবুলের পতনের পর থেকে এসব সহায়তার বেশির ভাগই বন্ধ রয়েছে।
কাবুলের নিয়ন্ত্রণ তালিবানের হাতে চলে যাওয়ার পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আফগানিস্তানের জমা থাকা রিজার্ভের অর্থ জব্দ করে রেখেছে মার্কিন সরকার। ফলে সেই অর্থে হাত দিতে পারছে না তালিবান। বেঁকে বসেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ)। আফগানিস্তানে সংস্থাটির পক্ষ থেকে ৪৫ কোটি মার্কিন ডলার তহবিল পৌঁছানোর কথা ছিল। তবে তা স্থগিত করে দেওয়া হয়। আর্থিক সহায়তা বন্ধ রেখেছে বিশ্বব্যাংকও। যদিও সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক সেই অর্থ ছাড়ার কথা জানিয়েছে।
এর আগে জাতিসংঘ জানায়, আফগানিস্তানের এক কোটি ৪০ লাখ মানুষ তীব্র খাদ্য সংকটে পড়েছে। সংস্থাটির এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, গত তিন বছরের মধ্যে আফগানিস্তানে দ্বিতীয়বারের মতো খরা দেখা দিয়েছে। করোনাভাইরাস সামাজিক ও অর্থনীতিকে পরিবেশকে ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে। যুদ্ধ-সংঘাতের কারণে চরম বিধ্বস্ত দেশটি। এ অবস্থায় অন্যদের আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষের সহায়তায় এগিয়ে আসার আহ্বানও জানান তিনি।
এদিকে, তালিবান সরকার গঠনের পর একের পর এক বিধিনিষেধ জারি করছে। যার ফলে দেশটির সংকট আরও তীব্র হচ্ছে।
আফগানিস্তান বরাবরই গরিব দেশ। সেখানকার ৭০ শতাংশ মানুষের দৈনিক আয় দুই ডলারের কম। অর্থনীতিবিদদের ধারণা, আগামী দিনে দেশটি আরও দরিদ্র হতে চলেছে। সেই দারিদ্রের মোকাবিলা করতে হবে তালিবান শাসকদের। তারা ইতিমধ্যেই বুঝতে পারছেন, দারিদ্রের বিরুদ্ধে লড়াই করা মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানোর চেয়ে বেশি কঠিন।
তালিবানের ক্ষমতা দখলের পর বিদেশি সহায়তার ওপর নির্ভরশীল আফগান অর্থনীতি আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, একটি দেশের মোট দেশীয় উৎপাদনের (জিডিপি) ১০ শতাংশ বা তার চেয়ে বেশি বিদেশি সাহায্য থেকে এলে তাকে সাহায্য নির্ভর দেশ বলে ধরা হয়। আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে জিডিপির প্রায় ৪০ শতাংশই ছিল আন্তর্জাতিক সাহায্য। দেশটির দারিদ্র্যের কারণে বহু দিন ধরেই প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশ অর্থ সাহায্য করেছে। কিন্তু এই অস্থির পরিস্থিতিতে কেউই আগের মতো আর্থিক সাহায্য করছে না। ফলে সেখানকার অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে। বেহাল অর্থনীতির কারণেই মানুষের দারিদ্র্য চরমসীমায় পৌঁছেছে। তাই অবিলম্বে আন্তর্জাতিক মহল ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে বাধ্য।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দীর্ঘদিন সন্ত্রাসী কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত থাকা তালিবান ভেবেছিল সরকার চালানো বোধহয় খুব সহজ। মানুষ খুন করা আর দেশ চালানো যে এক নয়, সেটা তারা বোঝেনি। দুর্নীতি আর বেহাল অর্থনীতি শুরুতেই কাঁধে চেপে বসেছে তালিবান শাসকদের। অর্থনীতি তো দূরের কথা, শান্তি ফেরাতেও হিমশিম খাচ্ছে দখলদার সরকার। ক্ষমতায় আসার আগে আন্তর্জাতিক দুনিয়াকে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তালিবান। বোঝাতে চেয়েছিল, গত দুই দশকে তাদের মানসিকতার ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু তারা যে বিন্দুমাত্র নিজেদের মানসিকতা বদলায়নি ক্ষমতায় এসেই চরম বর্বরতার পরিচয় দিয়ে তারা সেটা আন্তর্জাতিক দুনিয়াকে বুঝিয়ে দিয়েছে। তাই আন্তর্জাতিক সাহায্যের বহর কমছে।
মনে করা হয়, তালিবানকে সাহায্য করা মানেই জঙ্গিবাদ ও মাদক চোরাকারবারীদের মদদ। আত্মঘাতী বোমারুদের যেমন তারা প্রকাশ্যেই উৎসাহিত করছে, তেমনি ক্ষমতায় আসার পর ফের মাদক ব্যবসার কথাও বলছেন তালিবান মন্ত্রীরা। নারী ও সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের বহরও কমেনি। তাই বেশিরভাগ দেশই তালিবানের ওপর ক্ষুব্ধ।
এদিকে অর্থনীতিবিদরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তার ওপর নির্ভরতা থেকে বের হয়ে অর্থনৈতিক ধস ঠেকিয়ে পরিস্থিতি উন্নয়নে নজর দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
ইরাজ ফাকিরি নামের এক অর্থনীতিবিদ বলেন, কার্যকর সহায়তা অবশ্যই দিতে হবে। একই সঙ্গে সৃষ্টি করতে হবে কর্মসংস্থান। যেসব প্রদেশ থেকে বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে সেখানে দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প নিতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭২৭
আপনার মতামত জানানঃ