গত বছরের ১৫ আগস্ট আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল নিয়ন্ত্রণে নেয় তালিবান। এরপর তারা নতুন সরকার গঠন করলেও এখনো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলেনি। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে চরম আর্থিক সংকটে পড়েছে দেশটি। দেখা দিয়েছে চরম খাদ্য সংকট।
হাহাকার চলছে দেশটিতে। খাবারের জন্য হন্যে হয়ে ছুটছে মানুষ। তালিবান ক্ষমতায় আসার পর দেশটিতে আন্তর্জাতিক ত্রাণ সহায়তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সামনের দিনগুলোতে ভয়ংকর বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে আফগানেরা। আর এসবের চোট সবচেয়ে বেশি পড়েছে শিশুদের ওপর।
মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে আফগানিস্তানের অভুক্ত শিশুরা। তাদেরকে বাঁচানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন চিকিৎসকরা। অথচ তারাও দীর্ঘদিন ধরে কোনো বেতন পাচ্ছেন না। নিজের সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে তবু তারা আবার ছুটে যাচ্ছেন হাসপাতালে। প্রাণপ্রদীপ নিভে যাওয়ার আগে চেষ্টা করছেন মা-বাবার মুখে হাসি ফেরাতে। এমন এক মানবিক বিপর্যয়ের আফগানিস্তান। পরিস্থিতি ক্রমশ অসহনীয় হয়ে উঠছে।
আফগানিস্তানে ভয়াবহ অপুষ্টির শিকার শিশুরা। হাসপাতালগুলো শিশুদের চিৎকার আর কান্নায় ভারী হয়ে উঠছে। লস্কর গাহ শহরের প্রধান হাসপাতালের ইমার্জেন্সি রুমে কয়েক সেকেন্ড পর পরই একজন করে অসুস্থ শিশুকে নিয়ে আসা হচ্ছে। তীব্র খাদ্য সংকটে সবচেয়ে বেশি ভুগতে হচ্ছে এসব শিশুকে। খাবারের অভাবে তাদের বাঁচিয়ে রাখাটাই এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত এই নিরীহ মানুষগুলোকে দেখা কেউ নেই। সারাবিশ্বই যেন তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। খাদ্যের অভাবে মরতে বসা এসব মানুষ বিশ্বের কোনো সহায়তাই পাচ্ছে না।
হেলমান্দ প্রদেশের রাজধানী লস্কর গাহ। দেশের রাজধানী কাবুল থেকে ৪০০ মাইল (৬৪৪ কিলোমিটার) দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত এই শহর যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের ক্ষতিগ্রস্ত শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম।
আড়াই বছর বয়সী সন্তানকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন মারকাহ নামের এক নারী। বয়সের তুলনায় শিশুটি অনেক ছোট। তার শ্বাসকষ্টের সমস্যা হচ্ছিল, হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছিল। তাকে নিয়ে জরুরি বিভাগে ছুটছেন চিকিৎসকরা। সে মারাত্মকভাবে অপুষ্টিতে ভুগছে এবং যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়েছে। তাকে সুস্থ করে তুলতে চিকিৎসকরা দ্রুত কাজ করছেন।
সন্তানের এমন হাল দেখে কান্না থামাতে পারছেন না মারকাহ। তিনি বলেন, আমার সন্তান এভাবে কষ্ট পাচ্ছে আর আমি কিছুই করতে পারছি না। আমার সারাক্ষণ ভয় হচ্ছে যে, এই বুঝি আমার সন্তানের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে।
ওই হাসপাতালে আনা প্রায় সব শিশুরই একই অবস্থা। হাসপাতালের স্টাফদের একটু অবসর নেওয়ারও সময় নেই। একজন শিশুকে রেখে তাদের অন্য শিশুকে দেখতে হচ্ছে।
ক্রিটিকাল কেয়ারে ভর্তি হওয়া প্রতি পাঁচজন শিশুর মধ্যে একজন মারা যাচ্ছে। অতি সংক্রামক রোগ হামের বিস্তারের কারণে গত কয়েক সপ্তাহে হাসপাতালের পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। এই রোগের কারণে শিশুদের দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ইতোমধ্যেই অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের জন্য এই রোগ আরও ভয়াবহ বিপদ ডেকে এনেছে।
মেডিসিন্স সান্স ফ্রন্টিয়ারস দ্বারা পরিচালিত হাসপাতালটিতে রোগীর চাপ বাড়ছে। ৩শ শয্যাবিশিষ্টি হাসপাতালটিতে প্রতিদিন রোগী আসছে ৮শ জন। এর মধ্যে অধিকাংশই শিশু।
গত আগস্টে কাবুল দখলের মাধ্যমে পুরো আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেয় তালিবান। তারপর থেকে দেশটির ওপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা এবং বিদেশি সহায়তা বন্ধ থাকায় অর্থনীতিতে ভয়াবহ সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে লাখ লাখ মানুষ খাবারের তীব্র সংকটে দিন কাটাচ্ছেন, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছে।
আমার সন্তান এভাবে কষ্ট পাচ্ছে আর আমি কিছুই করতে পারছি না। আমার সারাক্ষণ ভয় হচ্ছে যে, এই বুঝি আমার সন্তানের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে।
আফগানিস্তান বরাবরই গরিব দেশ। সেখানকার ৭০ শতাংশ মানুষের দৈনিক আয় দুই ডলারের কম। অর্থনীতিবিদদের ধারণা, আগামী দিনে দেশটি আরও দরিদ্র হতে চলেছে। সেই দারিদ্রের মোকাবিলা করতে হবে তালিবান শাসকদের। তারা ইতিমধ্যেই বুঝতে পারছেন, দারিদ্রের বিরুদ্ধে লড়াই করা মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানোর চেয়ে বেশি কঠিন।
তালিবানের ক্ষমতা দখলের পর বিদেশি সহায়তার ওপর নির্ভরশীল আফগান অর্থনীতি আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, একটি দেশের মোট দেশীয় উৎপাদনের (জিডিপি) ১০ শতাংশ বা তার চেয়ে বেশি বিদেশি সাহায্য থেকে এলে তাকে সাহায্য নির্ভর দেশ বলে ধরা হয়। আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে জিডিপির প্রায় ৪০ শতাংশই ছিল আন্তর্জাতিক সাহায্য। দেশটির দারিদ্র্যের কারণে বহু দিন ধরেই প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশ অর্থ সাহায্য করেছে। কিন্তু এই অস্থির পরিস্থিতিতে কেউই আগের মতো আর্থিক সাহায্য করছে না। ফলে সেখানকার অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে। বেহাল অর্থনীতির কারণেই মানুষের দারিদ্র্য চরমসীমায় পৌঁছেছে। তাই অবিলম্বে আন্তর্জাতিক মহল ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে বাধ্য।
এদিকে আফগানিস্তানের এখন যেখানেই যাওয়া হোক না কেন শিশু শ্রমিকদের দেখতে পাওয়া যায়। গাড়ি পরিষ্কার, আবর্জনার স্তূপ থেকে কিছু সংগ্রহ, জুতো পালিশ থেকে শুরু করে নানা ধরনের কাজ করছে তারা। নিজের ও পরিবারের মুখে খাবার তুলে দিতেই বই-খাতা ছেড়ে উপার্জনের পথে নামতে তাদের এ চেষ্টা।
খাদ্য সংকট কতটা চরমে পৌঁছালে একজন বাবা তার কন্যাসন্তানকে বিক্রি করতে বাধ্য হন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে একজন বাবার এছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। দেশে ভয়াবহ আর্থিক সংকট তৈরি হওয়ায় আফগানিস্তানের অনেক নাগরিককেই এখন এমন মর্মান্তিক বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দীর্ঘদিন সন্ত্রাসী কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত থাকা তালিবান ভেবেছিল সরকার চালানো বোধহয় খুব সহজ। মানুষ খুন করা আর দেশ চালানো যে এক নয়, সেটা তারা বোঝেনি। দুর্নীতি আর বেহাল অর্থনীতি শুরুতেই কাঁধে চেপে বসেছে তালিবান শাসকদের। অর্থনীতি তো দূরের কথা, শান্তি ফেরাতেও হিমশিম খাচ্ছে দখলদার সরকার। ক্ষমতায় আসার আগে আন্তর্জাতিক দুনিয়াকে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তালিবান। বোঝাতে চেয়েছিল, গত দুই দশকে তাদের মানসিকতার ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু তারা যে বিন্দুমাত্র নিজেদের মানসিকতা বদলায়নি ক্ষমতায় এসেই চরম বর্বরতার পরিচয় দিয়ে তারা সেটা আন্তর্জাতিক দুনিয়াকে বুঝিয়ে দিয়েছে। তাই আন্তর্জাতিক সাহায্যের বহর কমছে।
মনে করা হয়, তালিবানকে সাহায্য করা মানেই জঙ্গিবাদ ও মাদক চোরাকারবারীদের মদদ। আত্মঘাতী বোমারুদের যেমন তারা প্রকাশ্যেই উৎসাহিত করছে, তেমনি ক্ষমতায় আসার পর ফের মাদক ব্যবসার কথাও বলছেন তালিবান মন্ত্রীরা। নারী ও সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের বহরও কমেনি। তাই বেশিরভাগ দেশই তালিবানের ওপর ক্ষুব্ধ।
এদিকে অর্থনীতিবিদরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তার ওপর নির্ভরতা থেকে বের হয়ে অর্থনৈতিক ধস ঠেকিয়ে পরিস্থিতি উন্নয়নে নজর দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
ইরাজ ফাকিরি নামের এক অর্থনীতিবিদ বলেন, কার্যকর সহায়তা অবশ্যই দিতে হবে। একই সঙ্গে সৃষ্টি করতে হবে কর্মসংস্থান। যেসব প্রদেশ থেকে বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে সেখানে দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প নিতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৪৫
আপনার মতামত জানানঃ