রাজধানী ঢাকা থেকে কক্সবাজারে বেড়াতে গিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক নারী। সুরক্ষিত লাবনী পয়েন্টে স্বামী ও ৮ মাসের সন্তানসহ বেড়াতে গিয়েছিলেন তিনি। সুরক্ষিত সৈকতে এই ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয়েছে।
সেখান থেকেই তাকে তুলে নিয়ে একটি চায়ের দোকানের পেছনের ঝোপে নিয়ে ধর্ষণ করে তিনজন। এরপর স্বামী ও সন্তানকে জিম্মি রেখে একটি গেস্ট হাউজে নিয়ে ওই নারীকে ধর্ষণ করা হয়।
পর্যটন কেন্দ্রগুলো বেশি নিরাপদ থাকার কথা থাকলেও বাংলাদেশে তার উল্টো৷ ধর্ষণ ছাড়াও পর্যটন কেন্দ্রগুলো মাদকসহ নানা অপরাধের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে৷ আর অপরাধীদের সাথে এক শ্রেণির পুলিশের সমঝোতা থাকায় তারা বলতে গেলে বেপরোয়া৷
কক্সবাজার ছাড়াও বাংলাদেশের আরো একটি সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটায়ও এর আগে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে৷ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে রাঙামাটিতেও৷ ২০১৯ সালে কক্সবাজারে এক অস্ট্রেলীয় নারী ধর্ষণের শিকার হন৷ এরপর বিষয়টি আলোচনায় এলেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি৷ তার আগে ২০০৫ সালে আরো এক বিদেশি নারী ধর্ষণের শিকার হন৷ স্থানীয় সূত্র জানায়, ওই দুইটি ঘটনায় আসামিরা গ্রেপ্তার হলেও পরে জামিনে ছাড়া পেয়ে যান৷
গত ১৩ জানুয়ারি কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত সংলগ্ন একটি হোটেলে এক তরুণী সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন৷ তিনি বন্ধুদের সাথে সমুদ্র সৈকতে ঘুরতে গিয়েছিলেন৷ সমুদ্র সৈকত থেকে তুলে নিয়ে হোটেলে সংঘবন্ধ ধর্ষণ মামলার মূল আসামিরা এখনো গ্রেপ্তার হয়নি৷ মোট সাত জনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা হয়েছে৷ অভিযোগ রয়েছে ওই নারী পুলিশের সহায়তা চেয়েও পাননি৷ পরে র্যাব গিয়ে তাকে উদ্ধার করে৷ কিন্তু পর্যটন কেন্দ্রের মূল দায়িত্বে থাকা টুরিস্ট পুলিশ এখনো নির্বিকার৷
পর্যটন এলাকায় ধর্ষণ যেন নিত্যদিনের ঘটনা
এর আগে ২০২০ সালের আগস্টে এক স্কুল ছাত্রী কুয়াকাটার আরেকটি হোটেলে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন৷ তিনিও সমুদ্র সৈকতে ঘুরতে গিয়েছিলেন৷ ২০১৯ সালের মার্চে বান্দরবানে মেঘলা পর্যটন মোটেলে ঘুরতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হন এক নারী৷ ওই ঘটনার আসামিরা সবাই গ্রেপ্তার হয়েছেন৷ ২০০৫ সালেও একবার ইরানি এক নারী কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন৷
এর বাইরেও বিনোদন ও পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে আরো ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে৷ গত ১ এপ্রিল বরগুনার তালতলী এলাকায় ইকোপার্কে ঘুরতে গিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন এক নারী৷ গত ২ সেপ্টেম্বর হবিগঞ্জের হাওরে স্বামীসহ ঘুরতে গিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন এক নববধূ৷ দুর্বৃত্তরা স্বামীকে বেঁধে রেখে ধর্ষণের ঘটনা মোবাইল ফোনে ভিডিও করে৷ প্রকাশ করলে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল করার হুমকি দেয়া হয়৷
গত ৬ অক্টোবর সীতাকুণ্ডের পাহাড়ে ঘুরতে গিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন এক মাদ্রাসা ছাত্রী৷ এখানেও ধর্ষকরা ভিডিও ধারণ করে৷ এরকম আরো অনেক ঘটনা আছে৷
পুলিশের দায়সারা দায়িত্ব পালন
লাখ লাখ পর্যটকের নিরাপত্তায় আছেন মাত্র ২১১ জন ট্যুরিস্ট পুলিশ। হিমছড়ি, রামু, সোনাদিয়া, সাবরাং, টেকনাফসহ বহু স্থানে পর্যটকের নিরাপত্তায় কেউ নেই। পর্যটকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে ট্যুরিস্ট পুলিশের জনবল বৃদ্ধির পাশাপাশি সন্ত্রাসী, ছিনতাইকারী ও বখাটেদের নজরদারিতে রাখতে হবে।
জানা যায়, পর্যটন কেন্দ্র ও পর্যটকদের নিরাপত্তার প্রধান দায়িত্ব বাংলাদেশ টুরিস্ট পুলিশের৷ তাদের এক হাজার ৩০০ সদস্য আছে৷ দেশের মোট ১০৪টি পর্যটন কেন্দ্রে নিরপত্তার দায়িত্বে আছেন তারা৷ সারা দেশে স্টেশন আছে ৭১টি৷
টুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি মাহবুব হাকিম বলেন, কক্সবাজারের ঘটনায় টুরিস্ট পুলিশ তৎপর না হলেও পুলিশই তো তৎপর হয়েছে৷ র্যাব বা থানা পুলিশও তো পুলিশ৷
তিনি বলেন, আমাদের হ্যালো টুরিস্ট নামে একটি অ্যাপ আছে, ফেসবুক পেজ আছে৷ সেখানে অভিযোগ জনাতে পারেন টুরিস্টরা৷ স্থানীয় টুরিস্ট পুলিশ অফিসের ফোন নাম্বারও দেয়া থাকে৷ আমরা অনেক সাড়া পাই৷ আর ৯৯৯ তো আছেই৷ সেখানে অভিযোগ করলেও আমরা সাড়া দেই৷
তিনি আরো জানান, পর্যটকের জীবন ও সম্পত্তির কোনো ক্ষতি হলে তা দেখা তাদের দায়িত্ব৷
১১ মাসে ধর্ষণের শিকার এক হাজার ২৪৭ জন নারী
বাংলাদেশে নারীরা পর্যটন কেন্দ্র, পার্ক বা বিনোদন কেন্দ্র কোথাও নিরপদ নন৷ আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে এক হাজার ২৪৭ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷ ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছেন ২৮৬ জন৷ ৪৬ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে৷ আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন নয়জন৷
গত বছর ১২ মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক হাজার ৬২৭ জন৷ ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছেন ৩২৭ জন৷ ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৫৩ জনকে৷ আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ১৪ জন৷
বাংলাদেশ মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, কক্সবাজারের মতো এলাকা যেখানে পুলিশ, শত শত মানুষ তার মধ্যেই যদি নারীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করা হয় তাহলে পুরো বাংলাদেশের পরিস্থিতি কী তা সহজেই বুঝা যায়৷
দুই-একটি ঘটনা যা সংবাদমাধ্যমে আসে তা নিয়ে আমরা কথা বলি৷ বাকি ঘটনাগুলো চাপা পড়ে যায়৷ প্রভাবশালীরা পার পেয়ে যায়৷ কক্সবাজারে যারা জড়িত তারাও প্রভাবশালী বলে জেনেছি৷ তাদের যদি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হয় তাহলে এই ঘটনা বার বার ঘটতেই থাকবে৷
এই ঘটনাকে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের জন্য অশনি সংকেত বলে মনে করেন প্যাসিফিক এশিয়া ট্রাভেল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব তৌফিক রহমান৷ তিনি বলেন, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর দায় দায়িত্ব আছে৷ কিন্তু পর্যটনের জন্য স্থানীয় পর্যায়ে কমিউনিটি সাপোর্ট আমরা পাচ্ছি না৷ কক্সবাজারের ঘটনায়ও তাই দেখলাম৷
এর আগে বিজয় দিবসের বন্ধে হাজার হাজার পর্যটক যান কক্সবাজারে, তখন তারা সব কিছুর দাম অবিশ্বাস্যভাবে বাড়িয়ে দেন৷ এটার যদি অবসান না হয় তাহলে বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটবে না৷
এসডব্লিউ/এসএস/১৪৩৫
আপনার মতামত জানানঃ