যুদ্ধপ্রবণ এই বিশ্বে অস্ত্রের চাহিদা বরাবরই অক্ষুণ্ণ থাকে। অস্ত্র চাহিদার ওপর নির্ভর করে বিশ্বে অস্ত্রেরও বিশাল বাজার রয়েছে। করোনা মহামারির কারণে লকডাউন, সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়া, গ্রাহকদের মধ্যে আতঙ্কসহ বিভিন্ন নেতিবাচক প্রভাব থাকার পরেও বিশ্বে অস্ত্র বিক্রি থেমে থাকেনি।
অস্ত্র চাহিদার ওপর নির্ভর করে বিশ্বে অস্ত্রেরও বিশাল বাজার রয়েছে। সেখানে বিশ্বজুড়ে অস্ত্র বিক্রির তালিকায় আমেরিকা শীর্ষে রয়েছে। বিশ্বে যত অস্ত্র বিক্রি হয়, তার এক তৃতীয়াংশ হয় আমেরিকা থেকে। তবে এবার আমেরিকার অস্ত্রের বাজারে এক রকম ধসই নেমেছে।
চলতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম রফতানি কমেছে ২১ শতাংশ। ফলে, অন্যান্য বছরের তুলনায় সদ্য শেষ হওয়া অর্থবছরে বৈশ্বিক অস্ত্র বাণিজ্যে ১৩৮ বিলিয়ন ডলারের লোকসান গুণেছে দেশটি।
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থবছরের হিসেব শুরু হয় সেপ্টেম্বর থেকে। সদ্য শেষ হওয়া ২০২০-২১ অর্থবছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অস্ত্র ও সামরিক উপকরণ বিক্রির বিবরণী প্রকাশ করেছে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তার বরাত দিয়েই বৃহস্পতিবার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা রয়টার্স।
সৌদি আরবের নেতৃত্বে সুন্নি অধ্যুষিত আটটি দেশ ইয়েমেনে নিজেদের পছন্দের সরকার রক্ষায় দেশটিতে হামলায় লিপ্ত। ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের লক্ষ্য করে সৌদি জোটের বিমান হামলায় হাজার হাজার নিরীহ নাগরিক নিহত হয়েছে বলে জাতিসংঘের পক্ষ থেকেই বলা হয়েছে। ইয়েমেনে সৌদি হামলায় প্রতিদিন নিরীহ মানুষ মরছে এবং এতে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘিত হচ্ছে বলে দাবি করে বেশ আগে থেকেই সৌদির কাছে অস্ত্র বিক্রি না করার আহ্বান জানিয়ে আসছে বিভিন্ন যুদ্ধবিরোধী ও মানবাধিকার সংগঠন। ইয়েমেনে হামলার সময় সৌদি কর্তৃপক্ষ যুদ্ধাপরাধ করেছে, এমন অভিযোগ ওঠার পর থেকে অস্ত্র বিক্রির জন্য সমালোচনা হচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে।
যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জামের অন্যতম বড় ক্রেতা সৌদি আরব। তবে জো বাইডেন দেশটির প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর সৌদি আরবে অস্ত্র বিক্রির চুক্তি স্থগিত ঘোষণা করেন। ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের আগ্রাসনের কারণে দেশটিতে যে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে, তার জের ধরেই এই ঘোষণা দেন বাইডেন।
ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের খবর বলছে, মধ্যপ্রাচ্যের ওই দুই দেশে কোটি কোটি ডলারের অর্থ বিক্রি সাময়িক স্থগিত করে দিয়েছে বাইডেন প্রশাসন, যার মধ্যে সৌদির কাছে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে হামলার অস্ত্র প্রিসিজন-গাইডেড মিউনেশন ও আমিরাতের কাছে এফ-৩৫ বিমান বিক্রিও রয়েছে।
চলতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম রফতানি কমেছে ২১ শতাংশ। ফলে, অন্যান্য বছরের তুলনায় সদ্য শেষ হওয়া অর্থবছরে বৈশ্বিক অস্ত্র বাণিজ্যে ১৩৮ বিলিয়ন ডলারের লোকসান গুণেছে দেশটি।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাইডেনের শপথ নেয়ার এক সপ্তাহ পরে এমন সিদ্ধান্ত এসেছে। নির্বাচনী প্রচারে সৌদির সঙ্গে সম্পর্ক পুর্নমূল্যায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি।
প্রতিবেদনে রয়টার্স বলেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মোট ১৭৫ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এই সময়কালে যেসব দেশে অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জামের বড় চালান পাঠানো হয়েছে, সেসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ইসরায়েল।
২৩ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে জাপানের কাছে ৬৩ টি যুদ্ধবিমান বিক্রি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এই বিমানগুলো তৈরি করেছে বিখ্যাত মার্কিন অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম প্রস্তুতকারী কোম্পানি লকহিড মার্টিন।
এছাড়া সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলারে অস্ট্রেলিয়ার কাছে এএইচ-৬৪ই অ্যাপাচি অ্যাটাক হেলিকপ্টার ও ৩ দশমিক ৪ ডলারের বিনিময়ে ইসরায়েলের কাছে সিএইচ-৫৩কে হেলিকপ্টার বিক্রি করা হয়েছে।
নিয়ম অনুযায়ী, কোনো দেশ যদি যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অস্ত্র-সামরিক সরঞ্জাম কিনতে চায়- তাহলে দু’টি পন্থা অবলম্বন করতে পারে। প্রথমত, ক্রেতা দেশের সরকারের প্রতিনিধি সরাসরি কোনো মার্কিন কোম্পানির সঙ্গে ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি করতে পারে। এটিকে বলা হয় সরাসরি চুক্তি। দ্বিতীয়ত, ক্রেতা দেশের সরকারের প্রতিনিধি ওই দেশের মার্কিন দূতাবাসের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে মন্ত্রণালয়ের মধ্যস্থতায় অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম কিনতে পারে। তবে উভয় ক্ষেত্রে মার্কিন সরকারের অনুমোদন আবশ্যক।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক বিবরণীতে বলা হয়েছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরের তুলনায় ২০২০-২১ অর্থবছরে সরাসরি চুক্তির মাধ্যমে অস্ত্র-সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি কমেছে ১৭ শতাংশ। একই সময়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যস্থতায় সরঞ্জাম বিক্রির হার কমেছে ৩১ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বিশ্ব নেতারা হাজির হয়ে শান্তির কথা বলেন৷ অস্ত্র নয়, মানুষের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার কথা বলেন৷ কিন্তু তাদের কথায় এবং কাজে বিস্তর ফারাক। কেবল পশ্চিম দুনিয়া নয়, পাল্লা দিয়ে সামরিক শক্তি বাড়িয়ে চলেছে উপমহাদেশের দেশগুলি৷ গত কয়েক বছরে সামরিক খাতে তাদের বরাদ্দও বেড়েছে চোখে পড়ার মতো৷ বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, এভাবে অস্ত্র ব্যবসা বাড়তে থাকলে ভবিষ্যতে আরও বড় অশান্তির সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না৷
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৩০
আপনার মতামত জানানঃ