যুদ্ধপ্রবণ এই বিশ্বে অস্ত্রের চাহিদা বরাবরই অক্ষুণ্ণ থাকে। অস্ত্র চাহিদার ওপর নির্ভর করে বিশ্বে অস্ত্রেরও বিশাল বাজার রয়েছে। সেখানে বিশ্বজুড়ে অস্ত্র বিক্রির তালিকায় আমেরিকা শীর্ষে রয়েছে। বিশ্বে যত অস্ত্র বিক্রি হয়, তার এক তৃতীয়াংশ হয় আমেরিকা থেকে।
যুক্তরাষ্ট্রে অস্ত্র বিক্রির সংখ্যা আগের চেয়ে বেড়েছে। আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে খুনের সংখ্যাও বেড়েছে। প্রতিদিনই দেশটির কোনো না কোনো অঙ্গরাজ্যে বন্দুকের গুলিতে প্রাণ হারাচ্ছেন নিরীহ মানুষ। একদিকে বন্দুক হামলা, অন্যদিকে বন্দুকের গুলিতে আত্মহত্যার সংখ্যায়ও রেকর্ড করছে দেশটি।
মানবাধিকার নিয়ে বুলি আওড়ানো যুক্তরাষ্ট্রেই দিন দিন ভয়াবহ হচ্ছে বন্দুক হামলা। করোনা মহামারিতে যুক্তরাষ্ট্রের স্কুলগুলোতে সুনামির মতো বেড়েছে বন্দুক হামলা। স্কুল-কলেজের পাশাপাশি শপিংমলগুলোতেও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে এ নির্মম ঘটনা। প্রতিনিয়তই অকালে প্রাণ হারাচ্ছেন মার্কিনিরা। দেশটিতে এটি স্বাভাবিক ঘটনা হলেও মহামারিতে অস্বাভাবিক আকার ধারণ করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রে ২০২০ সালে গাড়ি দুর্ঘটনার চেয়েও আগ্নেয়াস্ত্রের মাধ্যমে শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের নিহতের ঘটনা বেশি বলে এক গবেষণায় উঠে এসেছে।
গতকাল শুক্রবার বিবিসির প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
এতে বলা হয়, সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) থেকে পাওয়া তথ্যানুসারে, ২০২০ সালে ৪ হাজার ৩ শতাধিক মার্কিন তরুণ আগ্নেয়াস্ত্র সংশ্লিষ্ট আঘাতের কারণে নিহত হয়েছে।
দেশটিতে আগ্নেয়াস্ত্র সংশ্লিষ্ট প্রাণহানির ঘটনাগুলোর মধ্যে আত্মহত্যাও উল্লেখযোগ্য। ২০২০ সালের হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যা ৩২৯ দশমিক ৫ মিলিয়ন। আর বর্তমানে দেশটির বেসামরিক নাগরিকদের হাতে ৩৯০ মিলিয়নেরও বেশি আগ্নেয়াস্ত্র আছে।
এই গবেষণা প্রতিবেদনটি চলতি সপ্তাহে নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল মেডিসিনে প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণা অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্রে ১ থেকে ১৯ বছর বয়সীদের মধ্যে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বেড়েছে ৩৩ দশমিক ৪ শতাংশ।
গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, নরহত্যা মার্কিন তরুণদের অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে প্রভাবিত করে। একই সময়ে দেশটিতে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে আত্মহত্যার হার বেড়েছে ১ দশমিক ১ শতাংশ।
এ ছাড়া, শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে সার্বিক প্রাণহানির ঘটনার (আত্মহত্যা, হত্যা, অনিচ্ছাকৃত এবং অনির্ধারিত) হার ২৯ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়েছে।
বুধবার জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, ‘আমরা আমাদের যুবকদের মৃত্যুর প্রতিরোধযোগ্য কারণ থেকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছি।’
জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে বলা হয়, প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুর হাত থেকে শিশু-কিশোরদের রক্ষায় ব্যর্থ হচ্ছে ব্যবস্থাপনা। ২০২০ সালেই ৪৫ হাজারের বেশি মার্কিনির মৃত্যু হয়েছে অস্ত্রের আঘাতে। ৫ বছরে ২৫ শতাংশ ও ২০১০ সাল থেকে ৪৩ শতাংশ বেড়েছে। ২০১৯ থেকে ২০২০ এ প্রতি লাখে অস্ত্র সংক্রান্ত মৃত্যু নারী-পুরুষ সব ক্ষেত্রেই বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিনিদের মধ্যে।
২০২০ সালের হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যা ৩২৯ দশমিক ৫ মিলিয়ন। আর বর্তমানে দেশটির বেসামরিক নাগরিকদের হাতে ৩৯০ মিলিয়নেরও বেশি আগ্নেয়াস্ত্র আছে।
অস্ত্র সহিংসতা মহামারির মধ্যে বেড়েছে। ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত অপর এক গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রাপ্তবয়স্কদের ৭৫ লাখ প্রথমবার অস্ত্রের লাইসেন্স পেয়েছে মহামারিতে।
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ১০০ জনের কাছে ১২০টি বন্দুক আছে। বিশ্বের অন্য কোনো দেশের নাগরিকদের কাছে এত বেসামরিক বন্দুক নেই।
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক ছোট অস্ত্র সমীক্ষার (এসএএস) ফলাফলে এ তথ্য উঠে এসেছে।
খবর বলছে, অনিবন্ধিত অস্ত্র, অবৈধ বাণিজ্য ও বৈশ্বিক সংঘাতের কারণে বেসামরিক মালিকানাধীন আগ্নেয়াস্ত্রের সঠিক সংখ্যার হিসাব রাখা কঠিন। তবে এসএএস এর গবেষকদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের প্রায় ৮৫ কোটি ৭০ লাখ বেসামরিক অস্ত্রের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা ৩৯ কোটি ৩০ লাখ অস্ত্রের মালিক।
অর্থাৎ, বিশ্বের বেসামরিক বন্দুকের প্রায় ৪৬ শতাংশের মালিক যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্যালাপের ২০২০ সালের অক্টোবরের একটি সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৪৪ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্কদের বাড়িতে অন্তত একটি বন্দুক আছে এবং প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ব্যক্তিগতভাবে একটি বন্দুকের মালিক।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে এক বন্দুকধারীর হামলায় চারজন আহত হয়েছেন। পরে হামলাকারী নিজেও আত্মঘাতী হন বলে জানিয়েছে দেশটির পুলিশ। একটি স্কুলের সামনে স্থানীয় সময় শুক্রবার (২২ এপ্রিল) এ হামলার ঘটনা ঘটে।
হামলার খবরে দ্রুত হাজির হন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। ঘিরে ফেলে পুরো এলাকা। লকডাউন করে রাখা হয় ইউনিভার্সিটি অব ডিস্ট্রিক্ট অব কলাম্বিয়ার আশপাশের এলাকা। হামলাকারীর সন্ধানে বাড়ি বাড়ি চালানো হয় তল্লাশি। বেশ কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত জারি ছিল সতর্কতাও।
ওয়াশিংটন পুলিশ জানিয়েছে, ভিডিও ফুটেজ দেখে একজনকে চিহ্নিত করা গেছে। প্রাথমিকভাবে সন্দেহভাজন ওই ব্যক্তির নাম র্যামন্ড স্পেনসার এবং তার বয়স ২৩। হামলাকারীর মোটিভ ছিল সম্প্রদায়ের লোকজনদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটানো। তবে এখনো তদন্ত চলছে বলেও জানিয়েছে তারা। হামলাকারী একজনই ছিলেন বলেও ধারণা তাদের।
খবর অনুযায়ী, প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্য অনুযায়ী তল্লাশি শুরু করে পুলিশ। এরপর একটি পাশের অ্যাপার্টমেন্টে অভিযান চালিয়ে হামলাকারীর অবস্থান শনাক্ত করে তারা। পুলিশের দাবি সেখানেই ওই হামলাকারী আত্মঘাতী হন। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ আগ্নেয়াস্ত্রসহ রাইফেল উদ্ধার করে যেটি স্নাইপার টাইপ সেটআপ করা ছিল।
সম্প্রতি ২০২১ সালের বন্দুক সহিংসতার চিত্র তুলে ধরেছে মার্কিন কর্তৃপক্ষ। এতে বলা হয়, ২০২১ সালে দেশটিতে যে পরিমাণে বন্দুক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে তা ২০ বছরের মধ্যে রেকর্ড। এবছর মারা গেছেন ৪১ হাজারের বেশি মানুষ। ২০২০ সালে সংখ্যাটি ছিল ৩৭ হাজার। আর ২০১৯ সালে বন্দুক সহিংসতায় মারা যান ৩৮ হাজারের বেশি।
বড়দের পাশাপাশি দেশটিতে বন্দুক সহিংসতায় প্রাণ হারাচ্ছে শিশুরাও। গত বছর দেশটিতে বন্দুক হামলায় ১৭ বছরের নিচে এক হাজার চারশো ১০ জন শিশু মারা গেছে। ২০২০ সালে সংখ্যাটি ছিলো এক হাজার তিনশো ৭৫। আর ২০১৮ সালে বন্দুক হামলায় মারা গেছে নয়শো ৯১ জন শিশু।
যুক্তরাষ্ট্রে এই বন্দুক সহিংসতার ঘটনায় নিজ দেশের পাশাপাশি অন্যদেশের নাগরিকরাও প্রাণ হারাচ্ছেন। ২০২১ সালেই যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হামলায় বেশ কয়েকজন চীনা নাগরিক নিহত হয়েছেন। সরকার থেকে নানা পদক্ষেপ নেয়া হলেও দেশটিতে কমছে না এই বন্দুক হামলার ঘটনা।
১৯৯৪ সালে সেমি অটোমেটিক, উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন অস্ত্রগুলোর ওপর মার্কিন সরকার নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। কিন্তু ২০০৪ সালে তা তুলে নেওয়া হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ আইন তুলে নেওয়ায় বন্দুক হামলার নতুন যুগ শুরু হয়। এসব অস্ত্রের মাধ্যমে দ্রুত গতিতে এবং বেশি সময় ধরে অনেক মানুষকে মারতে পারছে দুষ্কৃতিকারীরা। এসব হামলার কোনোটা আবার এশীয়-আমেরিকানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষের কারণে ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আক্রমণকারীরা মানুষের ভিড় আছে এমন জায়গাগুলো বেছে নিচ্ছে। এমন ভিড় যেখানে কোথাও নির্দিষ্ট লক্ষ্য তাক করতে হয় না। এমনটাই বলছেন ইউনিভার্সিটি অব সেন্ট্রাল ফ্লোরিডার জে করজিন।
বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, করোনাকালে মানুষের মধ্যে হতাশা বেড়েছে। সে কারণেই অস্ত্র বিক্রির হার একদিকে যেমন বেড়েছে, তেমন বেড়েছে সহিংসতার হারও। কিন্তু কীভাবে এই প্রবণতাকে বদলানো সম্ভব, তা নিয়ে কোনো স্পষ্ট অভিমতে পৌঁছাতে পারেননি বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বন্দুক হামলার উদ্দেশ্য খুঁজে বের করা কঠিন এবং কঠোর নীতি প্রণয়ন করাও কঠিন। কিন্তু বন্দুক হামলার সুযোগ বন্ধ করা তেমন কঠিন নয়। শ্বেতাঙ্গদের শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার সারা দুনিয়াতেই আছে এবং আছে তাদের সহিংস ইচ্ছার বাহার। কিন্তু একজন সহিংস মানুষের হাতে রান্না করার ছুরি বা বেসবল খেলার ব্যাট হাতে যতটা না ভয়ংকর তারচেয়ে অনেক বেশি ভয়ংকর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে। কারণ চোখের পলকেই সে ১০০ রাউন্ড গুলি ছুঁড়তে সক্ষম। আর এ পদ্ধতিটি সন্দেহাতীতভাবে লোভনীয়।
তারা বলেন, কথা খুব স্পষ্ট যে, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের মালিকানা নিয়ে ক্রাইস্টচার্চ হামলার পর নিউজিল্যান্ড যে ধরণের নীতি গ্রহণ করেছে, একই রকম নীতি গ্রহণ করলে যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হামলার ঘটনা কমতে পারে। কিন্তু এভাবে সব বন্দুক হামলায় মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হবে না। যেমন সম্ভব হবে না সংবিধান সংশোধন করার মাধ্যমেও। যুক্তরাষ্ট্রের বন্দুক হামলার সমস্যা, ব্রাজিলের বন উজাড় হওয়া বা চীনের বায়ু দূষণের মতোই ভয়াবহ। মানবসৃষ্ট পরিবেশ বিপর্যয় বন্ধ করা কঠিন এবং রাতারাতি পরিবর্তন সম্ভবও নয়। তবে তাই বলে সাহসী মানুষের অভিযাত্রা থেমে থাকবে কেন?
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৩৩
আপনার মতামত জানানঃ