মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও এশিয়ার কিছু দেশ থেকে লাখো মানুষের স্রোত ধাঁই করেছে ইউরোপের দিকে। প্রত্যাশা একটাই—একটুখানি আশ্রয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো হিমশিম খাচ্ছে এই স্রোতের ধাক্কা সামলাতে।
প্রাণ বাঁচাতে, জীবিকা খুঁজে নিতে ছুটছে এসব মানুষ। ছুটন্ত এসব অভিবাসন-প্রত্যাশীর দেশগুলোতে চলছে সংঘাত, অস্থিরতা, নিপীড়ন, বঞ্চনা। সব মিলিয়ে দুর্বিষহ তাদের জীবন। টিকে থাকার মৌলিক চাহিদার জন্য ব্যাকুল তারা। চাই খাদ্য, নিরাপত্তা আর আশ্রয়। কিন্তু এই দায়দায়িত্বের বোঝা ইউরোপের উন্নত দেশগুলো নিতে ইচ্ছুক নয়।
ইউরোপীয় ইউনিয়নে কারো বসবাসের অনুমতি না থাকলে সেই ব্যক্তিকে ফিরিয়ে নিতে তার দেশের উপর চাপ বাড়াবে ইইউ৷ গত সপ্তাহে এক বৈঠক এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইউরোপীয় কাউন্সিল৷ এজন্য ইইউর সংশ্লিষ্ট নীতিকাঠামোর পাশাপাশি দেশগুলোর সঙ্গে উন্নয়ন, বাণিজ্য ও ভিসা সংক্রান্ত বিদ্যমান সম্পর্ককেও শর্ত হিসেবে ব্যবহার করা হবে৷ এই বিষয়ে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যে চুক্তি আছে তা নবায়নের পাশাপাশি নতুন চুক্তির উদ্যোগ নিবে ইইউ৷
এ ব্যাপারে বাংলাদেশের সঙ্গেও ইউরোপের আলোচনা চলছে দীর্ঘদিন ধরে৷ তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন শুধু কূটনৈতিক চাপ দিয়ে এক্ষেত্রে সফল হওয়া যাবে না৷
বর্তমানে ২০ টিরও বেশি দেশের সঙ্গে ইইউর এ সংক্রান্ত চুক্তি রয়েছে৷ এরমধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, টিউনিসিয়া, আফগানিস্তান, নাইজেরিয়া, গিনি, আইভোরি কোস্ট, ইথিওপিয়া, গাম্বিয়াও৷ এসব দেশের কোন নাগরিকের ইউরোপে থাকার বৈধতা না থাকলে তাদের ফেরত পাঠায় ইইউ৷ বিশেষ করে কারো আশ্রয় আবেদন চূড়ান্তভাবে বাতিল করা হলে তাকে দেশে পাঠিয়ে দেয়ার উদ্যোগ নেয় কর্তৃপক্ষ৷ স্বেচ্ছায় ফিরে যাওয়াদের ক্ষেত্রে খরচ বহনসহ নিজ দেশে পুনর্বাসন প্রক্রিয়াতে দেয়া হয় নানা ধরনের সহায়তা৷
নিজ দেশের নাগরিকদের ফেরত নিতে সহযোগিতার বিনিময়ে দেশগুলোকে ইইউর পক্ষ থেকে ভিসা, বাণিজ্য, শিক্ষা ও উন্নয়ন সংক্রান্ত কিছু প্রণোদনা দেয় হয়৷ বিপরীত কারণে এসব ক্ষেত্রে কোনো কোনো দেশের উপর কড়াকড়ি আরোপের বিধানও রয়েছে৷
তবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের এই কর্মসূচি বাস্তবায়নে অতিরিক্ত কঠোরতা অবলম্বন করছে বলে বিভিন্ন দেশের অভিযোগ রয়েছে৷ এ নিয়ে গত বছর মরক্কোর সঙ্গে ইইউর দ্বন্দ্ব তৈরি হয়৷ মরক্কোসহ আফ্রিকা থেকে আসা অভিবাসীদের একটি দলকে ফেরত নিতে ২০২০ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছিল দেশটি৷ যদিও মরক্কোর সঙ্গে তাদের এই সংক্রান্ত চুক্তি রয়েছে৷
ইউরোপের দেশগুলোতে বৈধ অভিবাসনের ভালো সুযোগ আছে। ব্রেক্সিটের পর ইংল্যান্ডে নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে। ইতালিতেও সুযোগ বাড়ছে। তবু চলছে ঝুঁকি নিয়ে অবৈধপথে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা।
একটা সময় ডিভি ভিসা দিয়ে বাংলাদেশিদের মাঝে আমেরিকা যাওয়ার ব্যাপক প্রবণতা ছিল। এখন বাড়ছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যাওয়ার প্রবণতা। শিক্ষা, উন্নত জীবন এবং ভালো আয়ের জন্যই এই প্রবণতা।
কিন্তু অনেকেই না জেনে অবৈধভাবে বা দালালদের মাধ্যমে বিকল্প পথে, বিশেষ করে তৃতীয় দেশ হয়ে সমুদ্র পথে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ঢোকার চেষ্টা করে নিজেরা বিপদে পড়ছেন, দেশের সুনামও ক্ষুণ্ন করছেন।
ইউরোপে কাজ করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘২০১৯ সালে ইউরোপে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে যেসকল বাংলাদেশি আবেদন করেছিলেন তাদের ৬ শতাংশের আবেদন গ্রহণ করা হয়েছিল। ২০২০ সালে সেটা কমে হয়েছিল ৫ শতাংশ। চলমান আফগান পরিস্থিতির কারণে এ বছর সে হার আরও কমে যাওয়ার আশংকা আছে।’
তিনি বলেন, ‘সারা বিশ্বের নজর এখন আফগানিস্তানের ওপর এবং স্বাভাবিকভাবে সেখানকার শরণার্থীরা অগ্রাধিকার পাবে।’
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার তথ্যমতে, ২০২০ সাল পর্যন্ত বিশ্বে মোট ৮২.৪ মিলিয়ন মানুষ ফোর্সড মাইগ্রেশনের শিকার হয়েছে, যার মধ্যে ৪৮ মিলিয়ন অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচুত্য এবং ২৬.৪ মিলিয়ন সরাসরি শরণার্থীতে পরিণত হয়েছে। এই সংখ্যায় উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে সিরিয়ার এবং ভেনেজুয়েলার। সিরিয়ায় শরণার্থী বৃদ্ধির কারণ হলো গৃহযুদ্ধ এবং ভেনেজুয়েলায় দারিদ্র্য। অর্থাৎ এই দুটি প্রধান কারণে মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইউরোপের দিকে ঝুঁকছে।
বর্তমানে ২০ টিরও বেশি দেশের সঙ্গে ইইউর এ সংক্রান্ত চুক্তি রয়েছে৷ এরমধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, টিউনিসিয়া, আফগানিস্তান, নাইজেরিয়া, গিনি, আইভোরি কোস্ট, ইথিওপিয়া, গাম্বিয়াও৷ এসব দেশের কোন নাগরিকের ইউরোপে থাকার বৈধতা না থাকলে তাদের ফেরত পাঠায় ইইউ৷ বিশেষ করে কারো আশ্রয় আবেদন চূড়ান্তভাবে বাতিল করা হলে তাকে দেশে পাঠিয়ে দেয়ার উদ্যোগ নেয় কর্তৃপক্ষ৷
জাতিসংঘ বলছে, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক শতাংশ শরণার্থীতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এত এত শরণার্থী যাদের অধিকাংশই ইউরোপমুখি হচ্ছে, সবাই কি ইউরোপে নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে? যে উদ্দেশ্যে তারা এত দূরের দুর্গম পথ পাড়ি দেয়ার ঝুঁকি নিলো সে উদ্দেশ্যে ঠিক কয়জন সফল হয়েছে?
আর এতসব কিছু পেরিয়ে যারা কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছতে পেরেছে তারাও যে খুব স্বাচ্ছন্দ্যে আছে বা হোস্ট রাষ্ট্র তাদের মৌলিক চাহিদাগুলো যথাযথভাবে পূরণ করতে পেরেছে ব্যাপারটি এমন নয়। শরণার্থী এবং অভিবাসীদের সন্তানেরা পড়াশোনায় অন্যদের চেয়ে যোজন যোজন পিছিয়ে। সেই সাথে কর্মক্ষম ব্যক্তিদের চাকরি দিতেও ব্যর্থ হয়েছে ইইউ ভুক্ত অনেক দেশের সরকার।
ইউরোপিয়ান কমিশনের তথ্য মতে, অভিবাসী সংকট এবং করোনা মহামারির কারণে সারা ইউরোপ জুড়েই বেড়েছে বেকারত্ব এবং হতাশা। গেলো বছর মার্চে বেকারত্বের হার ছিলো ৬.৩ শতাংশ; এবছর তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৭.৩৮ শতাংশে। গ্রিসে বর্তমানে বেকারত্বের হার ১৬.৩ শতাংশ, স্পেনে ১৫.৯৮ এবং তুরস্কে ১৩.৯ শতাংশ। তারপরেও জীবন বাজি রেখে অভিবাসীদের প্রত্যাশা “ইউরোপ”।
আশ্রয় আবেদন বাতিল হওয়া অনেক বাংলাদেশিকেও বিভিন্ন সময়ে ফেরত পাঠিয়েছে ইউরোপের দেশগুলো৷ এখনও অনেক অভিবাসী ফেরত আসার প্রক্রিয়ায় রয়েছেন৷ জার্মানিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া অক্টোবরে ইনফোমাইগ্রেন্টসকে জানান, ২০১৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ৮১৬ জনের জন্য ‘ট্রাভেল ডকুমেন্ট’ ইস্যু করতে বাংলাদেশের প্রতি জার্মানি অনুরোধ জানিয়েছে৷ তিনি বলেন, ‘এদের মধ্যে অনেকে ইতোমধ্যে জার্মানি ছেড়ে চলে গেছেন’৷
ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) বসবাসের অনুমতি নেই এমন বাংলাদেশিদের দেশে ফেরত পাঠাতে সহায়তা করতে বাংলাদেশ ও ইইউ এর মধ্যে ২০১৭ সালে ‘স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউরস (এসওপি) স্বাক্ষরিত হয়৷ এই চুক্তি অনুসরণ না করলে বাংলাদেশের উপর ইইউ ভিসা কড়াকড়ি আরোপ করতে পারে বলেও জানান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া৷
বাংলাদেশের ব্র্যাকের অভিবাসন বিভাগের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, ‘ইউরোপে অনিয়মিত বাংলাদেশি কর্মী যারা রয়েছেন তাদেরকে ফেরত পাঠাতে গত ১০ বছর ধরে আলোচনা চলছে৷ বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর উপরে এই বিষযে কূটনৈতিক চাপ আছে৷ ২০১৭ সালে এই ধরনের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত দেয়া হয়েছিল যে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া না হলে ভিসা বন্ধ করে দিবে’৷
তার মতে, এই বিষয়ে বাংলাদেশ এরিমধ্যে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে৷ কিন্তু তিনি মনে করেন অনিয়মিত অভিবাসীদের ফেরত পাঠানোর মধ্য দিয়ে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়৷ এর সঙ্গে জড়িত মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক সংকটও৷ তার মতে, কত লোককে ফেরত পাঠানো যাবে তার চেয়েও জরুরি অনিয়মিত অভিবাসন বন্ধ করা৷ এজন্য আন্তর্জাতিক মানবপাচার বন্ধের পাশাপাশি অনিয়মিতভাবে আসা অভিবাসীদের সস্তা শ্রম ব্যবহার বন্ধে ইউরোপের দেশগুলোরও একমত হওয়া প্রয়োজন৷ সেইসঙ্গে বৈধভাবে ইউরোপে যাওয়ার প্রক্রিয়াগুলোর বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে হবে৷ স্বেচ্ছায় ফিরে আসাদের যেসব সুবিধা দেয়া হচ্ছে সেগুলোও জানাতে হবে৷
বর্তমানে ইউরোপ থেকে বাংলাদেশে স্বেচ্ছায় ফেরত যাওয়াদের পুনর্বাসন সংক্রান্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের দুইটি প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ব্র্যাক৷ এর মধ্যে গত চার বছরে ‘প্রত্যাশা’ নামের একটি প্রকল্পের আওতায় দুই হাজার জন ফিরে এসেছেন বলে জানান শরিফুল হাসান৷
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ইউরোপের অভিবাসী সংকটের মূলে রয়েছে সিরিয়া, আফগানিস্তান, ইরাক ও ইয়েমেনের মত সংকটাপন্ন দেশগুলো। তাই যতদিন এইসব দেশের গৃহযুদ্ধ ও রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রশমিত না হবে ততদিন অভিবাসী সংকটের কোনো স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। এছাড়া আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলোও যথেষ্ট সংখ্যাক অভিবাসী তৈরির জন্য দায়ী।
অফ্রিকায় সম্পদের কমতি না থাকলেও রাজনৈতিক অস্থীতিশীলতা, দারিদ্র্য ও অনুন্নয়ন এ অঞ্চল থেকে উল্লেখজনক হারে শরণার্থী তৈরি করছে। তাই অভিবাসী সংকট মোকাবেলায় আফ্রিকার উন্নয়নও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সেই সাথে প্রয়োজন শরণার্থী দেশগুলোর প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের আন্তরিক মনোভাব।
সিরিয়া কিংবা ইয়েমেনের অভিবাসীরা গৃহযুদ্ধ থেকে বাঁচতে মধ্যপ্রাচ্যের অন্য ধনী দেশগুলোকে বেছে না নিয়ে দূর দুরান্তের পথ পাড়ি দিয়ে বেছে নিচ্ছে ইউরোপকে। এর কারণ পার্শ্ববর্তী ধনী দেশগুলো তাদের আশ্রয় দিচ্ছে না। আশ্রয় না দেয়ার কারণ হলো তারা জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক কনভেনশনে সাক্ষর করেনি। ফলে তারা বাধ্য নয় শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে। অথচ মধ্যপ্রাচ্যে কাতার, কুয়েত, ওমান, বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত কিংবা সৌদি আরবের মত দেশগুলো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলে এই শরণার্থীর দুর্দশা হয়ত কিছুটা হলেও লাঘব হত।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৪১
আপনার মতামত জানানঃ