বিশ্বের নানাপ্রান্তে শরণার্থী সংকট রয়েছে। বিশ্বে সবই যেন চলছে করোনাকে ঘিরে, শরণার্থীরা পড়ে গেছেন আড়ালে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, বর্তমান বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে করুণ শরণার্থী সংকটে ভুগছে। বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে রাজনৈতিক, সামরিক, জাতিগত ও মতাদর্শের নানা সংকট মানুষের কাছ থেকে কেড়ে নিচ্ছে জাতি পরিচয়, বেঁচে থাকার অধিকার।
সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলের ইদলিব প্রদেশে মানবেতর জীবন যাপন করছেন শরণার্থীরা৷ রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সীমান্ত খোলা রাখা বিষয়ক চুক্তির মেয়াদ ১০ জানুয়ারি ফুরিয়ে আসছে৷ আর তাই বাড়ছে অনিশ্চয়তা৷ ডয়েচে ভেলের খবর
সিরিয়ার উত্তরে অবস্থিত ইদলিব প্রদেশের শরণার্থী শিবিরগুলোতে মূলত তুরস্কের রেডক্রস কর্মীরা সহায়তা প্রদান করে থাকেন৷ তুরস্কের সীমান্ত সংলগ্ন অঞ্চলটি এখনো বিদ্রোহীদের দখলে৷ দিনে দিনে এলাকাটিতে বাড়ছে শরণার্থীর সংখ্যা৷ জাতিসংঘের তথ্য মতে, এখানকার শিবিরগুলোত প্রায় ২৪ লাখ শরণার্থী অবস্থান করছেন৷
তুরস্কের সীমান্ত সংলগ্ন ইদলিবে বর্তমানে বাব আল-হাওয়া হয়েই প্রবেশ করা যায়৷ অর্থাৎ এটিই বিদ্রোহী অধ্যুষিত অঞ্চলটিতে প্রবেশের একমাত্র পথ৷ কিন্তু রাশিয়ার চাপের মুখে বন্ধ হয়ে যেতে পারে এ পথটি৷ সেক্ষেত্রে অনিশ্চয়তায় পড়বেন প্রায় ২৫ লাখ শরণার্থী৷ কেননা পথটি বন্ধ হয়ে গেলে সেখানে সহায়তা পৌঁছানোর কোনো সুযোগ খোলা থাকবে না৷
সাহায্যের আশায় লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন নারীরা৷ এখান থেকে পাওয়া সহযোগিতায় জীবন চালান তাদের অনেকে৷
সিরিয়াতে ১০ বছর ধরে যুদ্ধ চলছে৷ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ইদলিবে আসা শরণার্থীরা তাই জানেন না কবে নিজ বাড়িতে ফিরতে পারবেন৷
তুরস্ক সীমান্তের নিকটে এ ক্যাম্পগুলোতে আসলে শরণার্থীদের তেমন কিছুই করার নেই৷ পুরুষেরা অস্থায়ী মসজিদে নামাজ পড়তে যান৷ আর ঘরের কাজেই মধ্যেই সীমাবদ্ধ নারীরা৷
ইদলিবের এই ক্যামম্পগুলোতে শিশুদের পড়াশোনার করার সুযোগও খুব একটা নেই৷ তবে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তায় শিশুদের জন্য এমন কিছু অস্থায়ী স্কুল তৈরি করা হয়েছে৷
শরণার্থীদের জায়গা করে দিতে রোমান আমলের পুরোনো বাড়িতেও করা হয়েছে ক্যাম্প৷
সিরিয়াতে ১০ বছর ধরে যুদ্ধ চলছে৷ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ইদলিবে আসা শরণার্থীরা তাই জানেন না কবে নিজ বাড়িতে ফিরতে পারবেন৷
সিরিয়ার ইদলিব প্রদেশ হচ্ছে এখন বাশার আসাদ বিরোধী বিদ্রোহীদের সর্বশেষ ঘাঁটি। এই বিদ্রোহীদের মধ্যে আল-কায়েদা সমর্থক জিহাদি গোষ্ঠী যেমন আছে, তেমনি আছে তুরস্ক-সমর্থিত বিদ্রোহী, কিছু কুর্দি বাহিনীও আছে।
অন্যদিকে রাশিয়া ও ইরানের সাহায্য নিয়ে প্রেসিডেন্ট বাশার আসাদ সরকারের সেনাবাহিনী এখন সিরিয়ার প্রায় সব ভূখন্ড বিদ্রোহীদের হাত থেকে মুক্ত করে ফেলেছে।বাকি আছে শুধু এই ইদলিব।
বাশার আসাদের সংকল্প হলো, তিনি ইদলিব দখল করে পুরো সিরিয়াকে বিদ্রোহীদের হাত থেকে পুনরুদ্ধার করবেন।
এদিকে সম্ভাব্য অভিযানের প্রস্তুতিতে সিরিয়ার সরকারবিরোধী বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ইদলিব প্রদেশে সৈন্য মোতায়েন জোরদার করেছে তুরস্ক। সিরিয়ার বাশার আল-আসাদ প্রশাসন ও তার মিত্র রাশিয়া বিদ্রোহীদের দখলে থাকা একমাত্র প্রদেশটি দখলে আক্রমণ বাড়ানোয় এই পদক্ষেপ নেয় তুরস্ক।
বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে উত্তর সিরিয়ায় লড়াইরত পাঁচ সংগঠন একত্রে জোটবদ্ধ হয়ে লড়াই চালানোর ঘোষণা দেয়। উত্তর সিরিয়ার আল-বাব জেলায় এক অনুষ্ঠানে এই পাঁচ সংগঠন একত্রিত হয়ে জোট গঠনের ঘোষণা দেয়। আসাদবিরোধী লড়াইয়ের পাশাপাশি এই অঞ্চলে সন্ত্রাস প্রতিরোধে তুরস্কের সাথে একত্রে কাজের প্রত্যয় প্রকাশ করে তারা।
গত বছরের মার্চে তুরস্ক ও রাশিয়ার মধ্যে চুক্তি অনুসারে ইদলিবকে ‘যুদ্ধ-বহির্ভুত অঞ্চল’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। তথাপি সিরিয়ার সরকার বিভিন্ন সময়ই এই অঞ্চলে সামরিক আক্রমণ চালিয়ে চুক্তি লঙ্ঘন করেছে।
ইদলিবে বর্তমানে প্রায় ৩০ লাখ লোকের বসবাস রয়েছে। এর মধ্যে দুই তৃতীয়াংশই যুদ্ধের ফলে সিরিয়ার বিভিন্ন স্থান থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আসা শরণার্থী।
২০১১ সালের মার্চে আরব বসন্তের পরিপ্রেক্ষিতে সিরিয়ার একনায়ক বাশার আল আসাদের পদত্যাগের দাবিতে দেশটির বিভিন্ন শহরে রাস্তায় বিক্ষোভে নামে সাধারণ জনতা। বাশার আল-আসাদ সামরিক উপায়ে এই বিক্ষোভ দমন করতে চাইলে দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধের মুখে পড়ে দেশটি।
জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের এক তথ্য অনুসারে, যুদ্ধের ফলে ১০ বছরে তিন লাখ ৫০ হাজার দুই শ’ নয়জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে ২৬ হাজার সাত শ’ ২৭ জন নারী ও ২৭ হাজার এক শ’ ২৬ জন শিশু।
দশ বছর চলমান এই গৃহযুদ্ধে দেশটির জনসংখ্যার অর্ধেকই বাস্তুচ্যুত হয়। জাতিসঙ্ঘের তথ্যানুসারে এক কোটির বেশি লোক যুদ্ধের কারণে বাস্তুচ্যুত হয়।
এছাড়া যুদ্ধের কারণে অন্তত ৬৬ লাখ সিরিয়ান গত ১০ বছরে দেশ ছেড়েছেন। দেশ ত্যাগ করা এই সকল সিরিয়ান নাগরিক প্রতিবেশী তুরস্ক, জর্দান, লেবানন, ইরাকসহ বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছেন। এর মধ্যে শুধু তুরস্কতেই ৩৭ লাখ শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছেন।
এদিকে সিরিয়ার বড় দুই শরণার্থী শিবিরে বিপজ্জনক পরিস্থিতির মধ্যে বড় হচ্ছে শিশুরা। এতে নষ্ট হচ্ছে তাদের জীবন। সুন্দর ভবিষ্যতের বদলে অন্ধকারে ধাবিত হচ্ছে তারা। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহলকে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে আন্তর্জাতিক এনজিও সেভ দ্য চিলড্রেন।
সেভ দ্য চিলড্রেনের নতুন এক প্রতিবেদনে সিরিয়ার শরণার্থী শিবিরগুলোতে বসবাসরত শিশুদের বিপজ্জনকভাবে বেড়ে ওঠার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। দেশটির দুটি বড় শরণার্থী শিবির আল-হোল ও রোজ ক্যাম্পে শিশুদের কোনো শিক্ষার ব্যবস্থা নেই। শিশুশ্রমিকের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে আশংকাজনকহারে। সেইসঙ্গে সহিংসতা ও খুনের ঘটনা যেন নিত্যদিনের বিষয়।
সহিংসতার কারণে চলতি বছর এখন পর্যন্ত ৬২ শিশুর মৃত্যু হয়েছে আল-হোলে। শিবিরিগুলোতে শিশু-কিশোরদের বিভিন্ন দল একে ওপরের সঙ্গে সহিংসতায় লিপ্ত হয়েই থাকে। এসব ঘটনায় অনেকে গুরুতর জখম হয়ে মৃত্যুকোলে ঢোলে পড়ে। সেইসঙ্গে মাদকের ছড়াছড়ি তো আছেই।
এছাড়া আগুনের কারণেও ঘটছে অকাল মৃত্যুর ঘটনা। বিশেষ করে রান্নার চুলা থেকে সবচেয়ে বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে।
বর্তমান বিশ্বে শরণার্থী সমস্যার সবচেয়ে দুঃখজনক চিত্র এটি। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের ফলে এই শরণার্থীদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। উন্নত দেশগুলো যে অর্থ ও ত্রাণ সহায়তা করছে তা খুব সামান্য। যে কারণে সিরিয়ান শরণার্থীদের দুর্দশা চরমে পৌঁছেছে। আন্তর্জাতিকভাবেও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট তৈরি করেছে সিরিয়ান শরণার্থীরা।
সিরিয়ার শরণার্থীদের শিশু ও নারীরা পড়েছে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে। ইউরোপের কয়েকটি দেশ সিরিয়া শরণার্থীদের জন্য মানবতার হাত বাড়িয়ে দিলেও আর্থিকভাবে সচ্ছল, উন্নত ও সামরিক শক্তিধর দেশগুলো সিরিয়া শরণার্থীদের ব্যাপারে নিয়েছে কৌশলী ভূমিকা। তাদের আশ্রয় দিতে চাচ্ছে না সব সময় মানবতার বুলি আওড়ানো বেশির ভাগ দেশের রাষ্ট্রনেতারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫১২
আপনার মতামত জানানঃ