যুদ্ধপ্রবণ এই বিশ্বে অস্ত্রের চাহিদা বরাবরই অক্ষুণ্ণ থাকে। অস্ত্র চাহিদার ওপর নির্ভর করে বিশ্বে অস্ত্রেরও বিশাল বাজার রয়েছে। সেখানে বিশ্বজুড়ে অস্ত্র বিক্রির তালিকায় আমেরিকা শীর্ষে রয়েছে। বিশ্বে যত অস্ত্র বিক্রি হয়, তার এক তৃতীয়াংশ হয় আমেরিকা থেকে।
করোনা মহামারির কারণে লকডাউন, সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়া, গ্রাহকদের মধ্যে আতঙ্কসহ বিভিন্ন নেতিবাচক প্রভাব থাকার পরেও ২০২০ সালে বিশ্বে অস্ত্র বিক্রির একশটি কোম্পানি ব্যবসায় ব্যাপক মুনাফা লাভ করেছে। অস্ত্র ব্যবসায় শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো। বিশ্বের একশটি অস্ত্র তৈরি ও বিক্রির কোম্পানির মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ৪১টি কোম্পানি ব্যবসা করেছে ৫৪ শতাংশ।
যুক্তরাষ্ট্রে অস্ত্র বিক্রির সংখ্যা আগের চেয়ে বেড়েছে। আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে খুনের সংখ্যাও বেড়েছে। প্রতিদিনই দেশটির কোনো না কোনো অঙ্গরাজ্যে বন্দুকের গুলিতে প্রাণ হারাচ্ছেন নিরীহ মানুষ। একদিকে বন্দুক হামলা, অন্যদিকে বন্দুকের গুলিতে আত্মহত্যার সংখ্যায়ও রেকর্ড করছে দেশটি।
চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক সহিংসতায় এখন পর্যন্ত ৪১ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে এক হাজার চারশোর বেশি শিশু। এক পরিসংখ্যানে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে মার্কিন কর্তৃপক্ষ। নিহতদের মধ্যে বেশ কয়েকজন চীনা নাগরিক রয়েছেন বলেও পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়।
সম্প্রতি ২০২১ সালের বন্দুক সহিংসতার চিত্র তুলে ধরেছে মার্কিন কর্তৃপক্ষ। এতে বলা হয়, ২০২১ সালে দেশটিতে যে পরিমাণে বন্দুক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে তা ২০ বছরের মধ্যে রেকর্ড। এবছর মারা গেছেন ৪১ হাজারের বেশি মানুষ। ২০২০ সালে সংখ্যাটি ছিল ৩৭ হাজার। আর ২০১৯ সালে বন্দুক সহিংসতায় মারা যান ৩৮ হাজারের বেশি।
বড়দের পাশাপাশি দেশটিতে বন্দুক সহিংসতায় প্রাণ হারাচ্ছে শিশুরাও। এবছর দেশটিতে বন্দুক হামলায় ১৭ বছরের নিচে এক হাজার চারশো ১০ জন শিশু মারা গেছে। ২০২০ সালে সংখ্যাটি ছিলো এক হাজার তিনশো ৭৫। আর ২০১৮ সালে বন্দুক হামলায় মারা গেছে নয়শো ৯১ জন শিশু।
যুক্তরাষ্ট্রে এই বন্দুক সহিংসতার ঘটনায় নিজ দেশের পাশাপাশি অন্যদেশের নাগরিকরাও প্রাণ হারাচ্ছেন। ২০২১ সালেই যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হামলায় বেশ কয়েকজন চীনা নাগরিক নিহত হয়েছেন। সরকার থেকে নানা পদক্ষেপ নেয়া হলেও দেশটিতে কমছে না এই বন্দুক হামলার ঘটনা।
১৯৯৪ সালে সেমি অটোমেটিক, উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন অস্ত্রগুলোর ওপর মার্কিন সরকার নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। কিন্তু ২০০৪ সালে তা তুলে নেওয়া হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ আইন তুলে নেওয়ায় বন্দুক হামলার নতুন যুগ শুরু হয়। এসব অস্ত্রের মাধ্যমে দ্রুত গতিতে এবং বেশি সময় ধরে অনেক মানুষকে মারতে পারছে দুষ্কৃতিকারীরা। এসব হামলার কোনোটা আবার এশীয়-আমেরিকানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষের কারণে ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আক্রমণকারীরা মানুষের ভিড় আছে এমন জায়গাগুলো বেছে নিচ্ছে। এমন ভিড় যেখানে কোথাও নির্দিষ্ট লক্ষ্য তাক করতে হয় না। এমনটাই বলছেন ইউনিভার্সিটি অব সেন্ট্রাল ফ্লোরিডার জে করজিন।
বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, করোনাকালে মানুষের মধ্যে হতাশা বেড়েছে। সে কারণেই অস্ত্র বিক্রির হার একদিকে যেমন বেড়েছে, তেমন বেড়েছে সহিংসতার হারও। কিন্তু কীভাবে এই প্রবণতাকে বদলানো সম্ভব, তা নিয়ে কোনো স্পষ্ট অভিমতে পৌঁছাতে পারেননি বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বন্দুক হামলার উদ্দেশ্য খুঁজে বের করা কঠিন এবং কঠোর নীতি প্রণয়ন করাও কঠিন। কিন্তু বন্দুক হামলার সুযোগ বন্ধ করা তেমন কঠিন নয়। শ্বেতাঙ্গদের শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার সারা দুনিয়াতেই আছে এবং আছে তাদের সহিংস ইচ্ছার বাহার। কিন্তু একজন সহিংস মানুষের হাতে রান্না করার ছুরি বা বেসবল খেলার ব্যাট হাতে যতটা না ভয়ংকর তারচেয়ে অনেক বেশি ভয়ংকর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে। কারণ চোখের পলকেই সে ১০০ রাউন্ড গুলি ছুঁড়তে সক্ষম। আর এ পদ্ধতিটি সন্দেহাতীতভাবে লোভনীয়।
তারা বলেন, কথা খুব স্পষ্ট যে, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের মালিকানা নিয়ে ক্রাইস্টচার্চ হামলার পর নিউজিল্যান্ড যে ধরণের নীতি গ্রহণ করেছে, একই রকম নীতি গ্রহণ করলে যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হামলার ঘটনা কমতে পারে। কিন্তু এভাবে সব বন্দুক হামলায় মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হবে না। যেমন সম্ভব হবে না সংবিধান সংশোধন করার মাধ্যমেও। যুক্তরাষ্ট্রের বন্দুক হামলার সমস্যা, ব্রাজিলের বন উজাড় হওয়া বা চীনের বায়ু দূষণের মতোই ভয়াবহ। মানবসৃষ্ট পরিবেশ বিপর্যয় বন্ধ করা কঠিন এবং রাতারাতি পরিবর্তন সম্ভবও নয়। তবে তাই বলে সাহসী মানুষের অভিযাত্রা থেমে থাকবে কেন?
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮২৭
আপনার মতামত জানানঃ