সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত ও গৃহবন্দি মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থি নেত্রী অং সান সু চিকে চার বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন দেশটির একটি আদালত। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে উসকানি দিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি এবং কোভিড-১৯ প্রোটোকল লঙ্ঘনের মাধ্যমে জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন ভাঙার দায়ে সু চিকে এই কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। মিয়ানমারের আইন অনুযায়ী এই অভিযোগে অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তিকে যথাক্রমে সর্বোচ্চ দুই ও তিন বছরের কারাদণ্ড দেওয়ার বিধান রয়েছে।
তার বিরুদ্ধে ১১টি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। এসব মামলা বর্তমানে আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। সোমবার (৬ ডিসেম্বর) তার প্রথম মামলার রায় ঘোষণা করা হলো। তার বিরুদ্ধে আনা সব মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলে তাকে যাবজ্জীবন কারাভোগ করতে হতে পারে। খবর বিবিসির।
ফেব্রুয়ারিতে সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে বন্দি সু চির বিরুদ্ধে দুর্নীতি, সরকারি গোপনীয়তা আইন লঙ্ঘনসহ প্রায় এক ডজন মামলা হয়েছে। সবগুলোতে দোষী সাব্যস্ত হলে নোবেলজয়ী এ নেত্রীর সর্বোচ্চ ১০০ বছরের বেশি কারাদণ্ড হতে পারে।
জানা গেছে, সে দেশের আইনের ৫০৫(বি) ধারায় দুই বছরের কারাদণ্ড এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয় আইনে আরো দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। জান্তা সরকারের মুখপাত্র জাও মিন তুন এ তথ্য জানিয়েছেন।
মিয়ানমারের জান্তা সরকারের একজন মুখপাত্র সংবাদ সংস্থা এএফপিকে বলেছেন, সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ভিন্নমত উসকে দেওয়া এবং কোভিড নিয়ম লঙ্ঘনের জন্য সোমবার মিয়ানমারের একটি আদালত ক্ষমতাচ্যুত বেসামরিক নেতা অং সান সু চিকে চার বছরের জেল দিয়েছে।
তিনি আরো জানান, সাবেক প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টকেও একই অভিযোগে চার বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তবে তাদের এখনো কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়নি।
রাজধানী নেপিদোতে তারা এখন যেখানে অবস্থান করছেন, সেখান থেকে তারা অন্যান্য অভিযোগের মুখোমুখি হবেন বলেও জানিয়েছেন তিনি।
এর আগে গত ৩০ নভেম্বর এই রায় ঘোষণার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে তা স্থগিত করা হয়। সেদিন সু চির বিরুদ্ধে মামলার রায় ঘোষণার কথা থাকলেও বাড়তি আরেক ব্যক্তির সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য নির্ধারিত সময়ের কিছু আগে তা স্থগিত ঘোষণা করা হয়।
ফেব্রুয়ারিতে সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে বন্দি সু চির বিরুদ্ধে দুর্নীতি, সরকারি গোপনীয়তা আইন লঙ্ঘনসহ প্রায় এক ডজন মামলা হয়েছে। সবগুলোতে দোষী সাব্যস্ত হলে নোবেলজয়ী এ নেত্রীর সর্বোচ্চ ১০০ বছরের বেশি কারাদণ্ড হতে পারে।
গত বছরের নভেম্বরের নির্বাচনে জয়ী হয় ৭৬ বছর বয়সী নেত্রী অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন এনএলডি পার্টি। ভূমিধস জয়ের পর তারা সরকার গঠন করে। কিন্ত চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনে বেসামরিক সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে সামরিক বাহিনী।
সে সময় সু চি সহ অন্যান্য নেতাদের আটক করা হয়। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত গৃহবন্দি রয়েছেন সু চি। এরপরেই একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ, গোপনীয়তা লঙ্ঘন জনসাধারণকে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে উসকানির অভিযোগ আনা হয় সু চির বিরুদ্ধে।
গৃহবন্দির পর থেকেই সু চিকে খুব একটা দেখা যায়নি। যদিও জান্তা সরকার দাবি করেছে যে, সু চি সুস্থ আছেন এবং এরই মধ্যে তাকে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিনও দেওয়া হয়েছে।
ক্ষমতা দখলের পরপরই গৃহবন্দি করা হয় অং সান সু চিকে। গ্রেপ্তার হন তার দল এনএলডির বিভিন্ন স্তরের হাজার হাজার নেতা-কর্মী-সমর্থক।
সামরিক অভ্যুত্থানের পরপরই সু চি ও তার দল এনএলডির গ্রেপ্তার সদস্যদের মুক্তির দাবিতে মিয়ানমারজুড়ে শুরু হয় ব্যাপক আন্দোলন; এবং কঠোর হাতে সেই আন্দোলন দমনে তৎপর হয় জান্তা।
মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে এখন পর্যন্ত জান্তাবিরোধী বিক্ষোভ দমনে সেনা-পুলিশের অভিযানে এক হাজারের বেশি বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। কারাবন্দি রয়েছেন কয়েক হাজার।
তবে মিয়ানমারের পরিস্থিতি তাতে শান্ত হয়নি। এখনও দেশটিতে আন্দোলন চলছে এবং সামরিক সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন জাতিগত সশস্ত্র রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর সমন্বয়ে ইতোমধ্যে একটি ছায়া সরকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন জান্তাবিরোধীরা।
এদিকে অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী গাড়ি চালিয়ে দেওয়ায় অন্তত ৫ জন নিহত হয়েছেন। এছাড়া এই ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও কয়েক ডজন। রোববার সকালের দিকে ইয়াঙ্গুনে অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভে সামরিক জান্তা নিয়ন্ত্রিত বাহিনী গাড়ি চালিয়ে দেওয়ায় হতাহতের এই ঘটনা ঘটেছে।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যম মিয়ানমার নাও বলেছে, বিক্ষোভের স্থান থেকে আরও কমপক্ষে ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী।
প্রত্যক্ষদর্শীরা রয়টার্সকে বলেছেন, নিরাপত্তা বাহিনীর গাড়ি চাপায় আরও কয়েক ডজন বিক্ষোভকারী আহত হয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ছবি এবং ভিডিওতে দেখা যায়, বিক্ষোভকারীদের ওপর একটি গাড়ি চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এ সময় কয়েক জনের মরদেহ রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা যায়।
সকালের এই সহিংসতার পরও রোববার দুপুরের দিকে ইয়াঙ্গুনের অপর একটি স্থানে অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে।
নিরাপত্তার ভয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিক্ষোভকারী টেলিফোনে রয়টার্সকে বলেন, আমি ধাক্কা খাই এবং একটি ট্রাকের সামনে পড়ে যাই। একজন সৈন্য রাইফেল দিয়ে আমাকে পেটান। কিন্তু আমি সেটি ঠেকিয়ে দিয়েছি এবং তার পেছনে ধাক্কা মেরেছি। সঙ্গে সঙ্গে তিনি আমাকে লক্ষ্য করে গুলি চালান। আমি আঁকাবাঁকাভাবে দৌড়ে পালিয়ে যাই। ভাগ্যবশত আমি পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছি।
সামরিক বাহিনীর রক্তাক্ত অভিযান সত্ত্বেও অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভ করে আসছেন দেশটির গণতন্ত্রকামী বিক্ষোভকারীরা। বিরোধীদের ছায়া সরকার বলেছে, শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের গাড়ি চাপা দিয়ে ও গুলি চালিয়ে হত্যার দৃশ্য দেখে তাদের হৃদয় ভাঙছে।
রোববারের হামলার পর দেশটির বিরোধীদের জাতীয় ঐক্যের সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আমরা সন্ত্রাসবাদী সামরিক বাহিনীকে কড়া জবাব দেবো; যারা নিরস্ত্র শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের নৃশংসভাবে, অমানবিকভাবে হত্যা করেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, মিয়ানমারের বৃহত্তম শহর ইয়াঙ্গুনে ‘ফ্ল্যাশ মব’ বিক্ষোভ শুরু হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই তাণ্ডব চালায় নিরাপত্তা বাহিনী। এ বিষয়ে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের মুখপাত্রের মন্তব্য জানতে টেলিফোন করা হলেও তাতে সাড়া পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে রয়টার্স।
এদিকে মিয়ানমারে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর দমন-পীড়ন না চালাতে জান্তা সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ। দেশটিতে সেনা অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভে পাঁচজন নিহত হওয়ার পর এ আহ্বান জানায় সংস্থাটি।
মিয়ানমারে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক রামানাথান বালাকৃষ্ণান বলেন, যারা সাধারণের ওপর এই দমন–পীড়ন চালিয়েছে, তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে।
মিয়ানমারে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস বলেছে, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছেন। তাদের ওপর গাড়ি উঠিয়ে দিয়েছেন এবং বেশ কয়েকজনকে হত্যা করেছেন। এটা ভয়ংকর ঘটনা।
নিজ দেশের জনগণের ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার করে দমনপীড়নের জন্য বিশ্বজুড়ে সমালোচিত হয়েছেন জান্তাপ্রধান হ্লাইং। পশ্চিমা দেশগুলো মিয়ানমারের সেনাসদস্য ও সেনাসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এরপরও কমেনি জান্তার দমনপীড়ন। পাল্টা-আক্রমণের পথ বেছে নিয়েছেন সেনাশাসনের বিরোধীরা। দেশটিতে প্রায় প্রতিদিনই দুই পক্ষের সংঘর্ষ চলছে। এর মধ্য দিয়ে মিয়ানমার দীর্ঘমেয়াদি গৃহযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা বিশ্লেষকদের।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩০৬
আপনার মতামত জানানঃ