পাকিস্তানে ধর্ম অবমাননার কথিত অভিযোগে শ্রীলঙ্কার এক নাগরিককে পিটিয়ে হত্যা করেছে উত্তেজিত জনতা। এরপর তার মৃতদেহে আগুন ধরিয়ে দেয়। ডিসি ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা গিয়ে উত্তেজিত জনতার কাছ থেকে লাশ উদ্ধার করে তাদের হেফাজতে নিয়েছেন।
এ ঘটনাকে পাকিস্তানের জন্য লজ্জার বলে বর্ণনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। তিনি অপরাধীদের শনাক্ত করে পূর্ণাঙ্গ আইনি ব্যবস্থায় কঠোর শাস্তি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
এ ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছেন সরকারি কর্মকর্তারা ও মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠনগুলো। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে তারা।
শুক্রবার পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের শিল্পনগরী শিয়ালকোটে ‘ভয়ংকর’ এ হত্যার ঘটনা ঘটে। সহিংস একদল জনতার পিটুনিতে নিহত ওই ব্যক্তির নাম প্রিয়ান্থা দিয়াওয়াদনা। তিনি শ্রীলঙ্কার নাগরিক। সাত বছর ধরে শিল্প প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান রাজকো ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন দিয়াওয়াদনা।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, দিয়াওয়াদনাকে মেঝেতে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। যেখানে শত শত মানুষ তার জামা-কাপড় ছিঁড়ছে। সহিংসভাবে তাকে মারধর করছে। পিটিয়ে হত্যার পর তার লাশ পোড়ানো হয়। কয়েক ডজন মানুষকে তার লাশের সঙ্গে ছবি তুলতেও দেখা যায়।
ঘটনার শুরু গুজব থেকে। গুজব উঠেছিল যে দিয়াওয়াদনা কোরআনের বাণী লেখা থাকা একটি পোস্টার নামিয়ে ফেলেছেন। এই অভিযোগ ওঠার পর শুক্রবার সকালের মধ্যে মানুষজন ওই কারখানার মূল ফটকে ভিড় করতে শুরু করে। এরপর বিকেল উন্মত্ত জনতা কারখানায় ঢুকে দিয়াওয়াদনাকে জিম্মায় নেয়।
পাকিস্তানের ডন পত্রিকায় বলা হয়, ঘটনাটি ঘটেছে শুক্রবার শিয়ালকোটের ওয়াজিরাবাদ রোডে অবস্থিত রাজকো ইন্ড্রাস্ট্রিজ নামের একটি গার্মেন্ট কারখানায়। এখানে জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে ১০ বছর ধরে দায়িত্ব পালন করছিলেন প্রিয়ান্থা। শুক্রবার এই কারখানার শ্রমিকরা কারখানায় প্রতিবাদ বিক্ষোভ করেন। তাদের অভিযোগ—ধর্ম অবমাননা করেছেন প্রিয়ান্থা। এ খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয় উগোকি পুলিশ স্টেশনের কয়েকজন পুলিশ। কিন্তু মুহূর্তে বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা গণনার বাইরে চলে যায়। এ অবস্থায় পরিস্থিতিতে দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় পুলিশ। স্থানীয় একজন সাংবাদিকের মতে, জেলা পুলিশ প্রধানকে অনেকবার মোবাইলে ফোন করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি।
এক পর্যায়ে বিক্ষোভকারীরা ওয়াজিরাবাদ রোডে গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেয়। বিক্ষোভে যোগ দেয় কারখানার সব শ্রমিক। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় বিপুল সংখ্যক স্থানীয় মানুষ। এত বিপুল পরিমাণ বিক্ষোভকারীকে দেখে ভবনের ছাদে উঠে যান প্রিয়ান্থা। কিন্তু স্লোগান দিতে দিতে বিক্ষোভকারীরা তার পিছু নেয় এবং ধরে ফেলে। তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় রাস্তায়। এরপর প্রহার করা হয়। এক পর্যায়ে ঘটনাস্থলেই নিহত হন তিনি। জনতা তার মৃতদেহে আগুন ধরিয়ে দেয়।
এ খবরে শিয়ালকোটের ডেপুটি কমিশনার (ডিসি) তাহির ফারুক এবং জেলা পুলিশ কর্মকর্তা ওমর সাঈদ মালিক ভারি পুলিশ বহর নিয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। তারা মৃতদেহ তাদের হেফাজতে নেন। রেসক্যু ১১২২ ডিস্ট্রিক্ট ইমার্জেন্সি অফিসার নাভিদ ইকবাল বলেছেন, তারা অবিলম্বে মৃতদেহ হস্তান্তর করেছেন শিয়ালকোটের আল্লামা ইকবাল টিচিং হাসপাতালে।
প্রত্যক্ষদর্শী মোহাম্মদ ইফতিখার এবং মোহাম্মদ ইলিয়াস বলেছেন, যখন বিক্ষোভ শুরু হয় এবং রোড ব্লক হয়ে যায়, তখন সেখানে উপস্থিত হন উগোকি পুলিশের মাত্র তিনজন সদস্য। যদি জেলা পুলিশ কর্মকর্তা স্পর্শকাতর এই বিষয়ে সময়মতো সাড়া দিতেন তাহলে এই হত্যা এড়ানো যেতো। এই ভয়াবহতার জন্য তারা পুলিশকে দায়ী করেন।
দিয়াওয়াদনাকে মেঝেতে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। যেখানে শত শত মানুষ তার জামা-কাপড় ছিঁড়ছে। সহিংসভাবে তাকে মারধর করছে। পিটিয়ে হত্যার পর তার লাশ পোড়ানো হয়। কয়েক ডজন মানুষকে তার লাশের সঙ্গে ছবি তুলতেও দেখা যায়।
সহকারী পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ মুর্তজা বলেন, ‘কারখানাটির ভবনের সংস্কারের কারণে দেয়াল থেকে কিছু পোস্টার তুলে ফেলা হয়েছিল। তারা সম্ভবত নবী মুহাম্মদের নামসংবলিত পোস্টারের অবমাননা করেছেন। সম্ভবত এ কারণেই ওই কারখানার ব্যবস্থাপক প্রিয়ান্থা দিয়াওয়াদনাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।’
মোহাম্মদ মুর্তজা বলেন, এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত অন্তত ৫০ জন গ্রেপ্তার হয়েছে। ভিডিও দেখে অপরাধীদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। আরও অনেকে গ্রেপ্তার হবে।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এ সহিংসতার নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি টুইট করেছেন, ‘শিয়ালকোটের কারখানায় ভয়াবহ হামলা ও শ্রীলঙ্কার ব্যবস্থাপককে হত্যা পাকিস্তানের জন্য লজ্জার দিন। আমি তদন্ত কার্যক্রমের তত্ত্বাবধান করছি। এ ঘটনায় দায়ীদের আইনের আওতায় সর্বোচ্চ শাস্তি হবে। গ্রেপ্তার প্রক্রিয়া চলছে।’
পাকিস্তানের রপ্তানিমুখী শিল্পের বেশির ভাগ কারখানা শিয়ালকোটে অবস্থিত। এ ঘটনার পর টেলিভিশন ফুটেজে নগরীর রাস্তায় হাজার হাজার মানুষকে দেখা গেছে বলে রয়টার্স লিখেছে।
রয়টার্সের এ প্রতিবেদন বলছে, হত্যাকাণ্ডের এ ঘটনার তীব্রতায় দেশটির ক্ষমতাধর সেনাবাহিনীও নিন্দা জানিয়ে এক বিবৃতি দিয়েছে। এতে এ ঘটনাকে ‘ঠাণ্ডা মাথায় খুন’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সেনাপ্রধান এ ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে বেসরকারি প্রশাসনকে পুরোদমে সহায়তার নির্দেশ দিয়েছেন।
লন্ডনভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। সংগঠনটি এক বিবৃতি দিয়ে বলেছে, ‘ধর্ম অবমাননার অভিযোগে শিয়ালকোটে শ্রীলঙ্কান এক কারখানা ব্যবস্থাপককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।’
২০১০ সালেও শিয়ালকোটে একই রকম ঘটনা ঘটেছিল। ওই সময় ডাকাত আখ্যা দিয়ে দুই ভাইকে পিটিয়ে হত্যা করেছিল স্থানীয়রা।
ইসলাম ধর্মের অবমাননার অভিযোগে পাকিস্তানে গণপিটুনি অস্বাভাবিক কিছু না। কিন্তু বিদেশিদের ওপর এমন হামলার ঘটনা বিরল। দেশটিতে ধর্ম অবমাননার সাজা মৃত্যুদণ্ড। আন্তর্জাতিক ও দেশীয় মানবাধিকার গোষ্ঠী বলে আসছে, প্রায়ই ধর্ম অবমাননার অভিযোগ ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও ব্যক্তিগত প্রতিশোধ নিতে কাজে লাগানো হয়।
ইসলাম ধর্মের মহানবীকে অপমান করলে পাকিস্তানে বাধ্যতামূলকভাবে মুত্যুর সাজা হয়৷ প্রায় ৯৫ শতাংশ মুসলমানের এই দেশে কঠোর ব্লাসফেমি আইন কার্যকর রয়েছে৷ পাকিস্তানে ব্লাসফেমির জন্য যতটা না ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে তারচেয়ে অনেক বেশি এই আইনের বলে সংঘবদ্ধ জনতাকে হত্যা করা হয়েছে৷
পাকিস্তানে এই আইনের সূচনা হয় সাবেক সামরিক শাসক জিয়াউল হকের অধীনে ১৯৮০ এর দশকে৷ এই আইন অনুযায়ী ইসলামের নবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) কে অবমাননা করলে তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড৷ এছাড়া ইসলাম ধর্ম, পবিত্র কোরআনসহ নির্দিষ্ট ধর্মীয় ব্যক্তিদের নিন্দা বা অবমাননায় কারাদণ্ডসহ কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে৷
গতবছরের সেপ্টেম্বরে ব্লাসফেমি বা ধর্মনিন্দার অভিযোগে এক খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে পাকিস্তানের আদালত৷ ৩৭ বছরের ঐ ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ, ইসলাম নিয়ে ‘অন্যায়’ এবং ‘অবমাননাকর’ মন্তব্য করেছেন তিনি৷ যদিও তার আইনজীবীর দাবি, ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে না চাওয়ায় তার বিরুদ্ধে ধর্মনিন্দার অভিযোগ করা হয়৷ প্রায় সাত বছর ধরে বিচার চলার পরে নিম্ন আদালত তাকে ফাঁসির সাজা দেয়৷
এছাড়াও গতবছরের জুলাই মাসের শেষের দিকে পাকিস্তানের পেশোয়ারে তাহির নামিস নামে একজনকে বিচার চলাকালে আদালতকক্ষের ভিতরেই গুলি করে হত্যা করা হয়৷ তার বিরুদ্ধে ব্লাসফেমির অভিযোগ আনা হয়েছিল৷ ঐ ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হওয়ায় বিবৃতি দিয়ে নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়৷ হত্যাকারীকে ‘ধর্ম যোদ্ধা’ অ্যাখ্যা দিয়ে তার মুক্তির দাবিতে তখন মিছিলও করে কয়েক হাজার কট্টর সমর্থক৷
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, ধর্মবিরোধী এই ব্লাসফেমি আইনটি সাধারণত ধর্মীয় কট্টরপন্থিদের পাশাপাশি সাধারণ বহু পাকিস্তানদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়৷
তারা বলছে, সংখ্যালঘুদের দমনে এই আইনের অপব্যবহার করা হচ্ছে৷ অনেক ক্ষেত্রে এমনকি মুসলিমরাও ব্যক্তিগত শত্রুতার জেরে একজন আরেকজনকে ব্লাসফেমি মামলায় ফাঁসিয়ে দিচ্ছেন৷
আন্তর্জাতিক মানবাধিকারকর্মীরা বলেন, ব্লাসফেমির অভিযোগ খুবই উদ্বেগজনক৷ কেননা, অভিযুক্ত ব্যক্তি সহিংসতার ঝুঁকিতে পড়ছেন৷ ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে ব্লাসফেমি আইনের প্রয়োগ বাড়ছে উল্লেখ করে সংখ্যালঘুদের উপর হামলার উস্কানিমূলক ঘটনা বন্ধে দেশটির নেতৃত্বের প্রতি আহবান জানিয়েছেন তারা৷
তারা বলেন, পাকিস্তানের ইসলাম ধর্মাবলম্বী সংখ্যাগরিষ্ঠদের ধর্মীয় সংবেদনশীলতা রক্ষার লক্ষ্যে অস্পষ্টভাবে প্রণীত ব্লাসফেমি আইনগুলোর পুলিশ এবং বিচার বিভাগ নির্বিচারে প্রয়োগ করছে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অনেক দেশেই ‘ব্লাসফেমি’, ‘ধর্মীয় অবমাননা’ এবং ‘ধর্মত্যাগ’ শাস্তিযোগ্য অপরাধ৷ বাস্তবে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক শত্রুতা, জমি নিয়ে বিরোধের ক্ষেত্রেও হাতিয়ার করা হয় এসব আইনকে৷
আরও বলেন, পাকিস্তানের সংখ্যালঘুরা প্রতিনিয়ত অবরোধের মধ্যে জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়। সংবিধান অনুযায়ী সব নাগরিকের সমান অধিকার থাকলেও তা কেবল কাগজে কলমে। হিন্দু, খ্রিস্টান, শিখ, বৌদ্ধ, আহমদি এমনকি শিয়ারাও দেশটিতে অ-নাগরিক হিসাবে বিবেচিত হয়। তাদের কথা বলার অধিকার নেই। আইনের সুরক্ষার অধিকার থেকেও তারা বঞ্চিত।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪০৩
আপনার মতামত জানানঃ