করোনা সংক্রমণের চতুর্থ ঢেউয়ের ঝুঁকির মুখে পড়েছে জার্মানি। এ পরিস্থিতিতে দেশটির নাগরিকদের প্রতি করোনার টিকা নিতে আহ্বান জানিয়েছেন জার্মান স্বাস্থ্যমন্ত্রী ইয়েন্স স্পান।
জার্মানির রাজধানী বার্লিনে গতকাল সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘টিকা নিন। নইলে এবারের শীত মৌসুম শেষ হতে হতে হয় সবাই করোনায় ভুগবেন, নয়তো মরবেন।’
শুধু জার্মানি নয়, শীত মৌসুমের শুরুতেই পুরো ইউরোপে করোনা সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে। সংক্রমণ ঠেকাতে ইতিমধ্যে লকডাউনে গেছে অস্ট্রিয়া। ইউরোপজুড়ে করোনার নতুন করে বিস্তারে উদ্বেগ জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)।
সংস্থাটির আঞ্চলিক পরিচালক হ্যান্স ক্লুগ বলেছেন, ইউরোপে করোনা সংক্রমণ নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা খুব চিন্তিত। জরুরি ব্যবস্থা নেওয়া না হলে আগামী মার্চ মাস নাগাদ ইউরোপে পাঁচ লাখ মানুষের মৃত্যুর রেকর্ড হতে পারে
টিকা নিয়েও বিধ্বস্ত জার্মানি
মধ্য ইউরোপের ৮ কোটি ৩০ লাখ মানুষের দেশ জার্মানিতে গত এপ্রিল মাসে করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে পার্লামেন্টে নতুন করে সংক্রমণ সুরক্ষা আইন পাস করা হয়। সেই আইনে লকডাউন ব্যবস্থা বহাল, বেশি সংক্রমণের এলাকাগুলোতে রাতে কারফিউসহ স্কুল বন্ধ এবং মানুষের মেলামেশায় কড়াকড়িসহ কঠোর বিধিনিষেধ রাখা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, মহামারি শুরুর পর থেকে এখন জার্মানিতে সবচেয়ে বেশি করোনা রোগী শনাক্ত হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশটিতে নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে ৩০ হাজার ৬০০-এর বেশি। বর্তমানে এক দিনে বিশ্বে করোনা রোগী শনাক্তের এটাই সর্বোচ্চ সংখ্যা।
রবার্ট কখ ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, সংক্রমণের সংখ্যা গত সপ্তাহ থেকে ঊর্ধ্বমুখী। এখন পর্যন্ত জার্মানিতে করোনা সংক্রমণে মারা গেছেন ৯৯ হাজার মানুষ। শিগগিরই মৃত্যু ১ লাখ ছাড়িয়ে যাবে বলে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন।
পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, জার্মানির ১৬ রাজ্যের মধ্য যে রাজ্যগুলোতে মানুষের টিকা গ্রহণের হার বেশি, সেখানে সংক্রমণ কম। যেখানে করোনা বিধিনিষেধ বা সুরক্ষা আইনের বিরোধিতা করে মিটিং-মিছিল হয়েছে, সেখানে করোনা ভয়াবহ আকার নিয়েছে।
জার্মানির মোট জনসংখ্যার ৬৮ শতাংশ করোনার টিকার পূর্ণাঙ্গ ডোজের আওতায় এসেছে। তবে এই হার পশ্চিম ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশ কম। এর মধ্যেই সংক্রমণের চতুর্থ ঢেউয়ের ঝুঁকি জার্মান সরকারকে চিন্তায় ফেলেছে। প্রতিদিনই দেশটিতে নতুন সংক্রমণের সংখ্যা বাড়ছে। ইতিমধ্যে দেশটির অনেক হাসপাতাল করোনা রোগীতে পূর্ণ হয়ে গেছে।
তবে করোনার ডেলটা ধরন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার পরিপ্রেক্ষিতে টিকা না নেওয়া ব্যক্তিদের কিছু জায়গায় চলাফেরায় বিধিনিষেধ আরোপ করেছে জার্মানি। আসন্ন বড়দিনের আগে বেশকিছু বাজার বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে দেশটির সরকার। যদি এর পরও সংক্রমণের চতুর্থ ঢেউয়ের ঝুঁকি এড়ানো যাচ্ছে না।
সম্মেলনে জার্মান স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘সবার জন্য করোনার টিকা বাধ্যতামূলক করার পক্ষে আমি নই। তবে নৈতিক দায়িত্ববোধ থেকে সবার টিকা নেওয়া উচিত। কেননা, এর ফলে একদিকে যেমন নিজের সুরক্ষা নিশ্চিত করা যাবে, অন্যদিকে অন্য মানুষের সুরক্ষাও নিশ্চিত হবে।’
জনগণের প্রতি টিকা নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে ইয়েন্স স্পান আরও বলেন, ‘স্বাধীনতা মানে দায়িত্ববান হওয়া। করোনার টিকা নেওয়ার মাধ্যমে সমাজের প্রতি আপনার দায়িত্ব পালন করুন।’
পরিস্থিতি কতোটা জটিল হতে পারে?
এদিকে জার্মানির সংক্রামক রোগ গবেষণাকেন্দ্র রবার্ট কখ ইনস্টিটিউটের পরিচালক লোথার ভিলার বলেন, ‘জার্মানিতে যেভাবে করোনার বিস্তৃতি ঘটছে, তা বন্ধ করা না গেলে আমাদের জন্য অন্ধকারময় সময় অপেক্ষা করছে।’
লোথার ভিলার আরও বলেন, ‘সংকট মোকাবিলায় রাজনৈতিক নেতারা গুরুত্বসহকারে কোনো সিদ্ধান্ত নেননি। এ পরিস্থিতিতে বড়দিনে অন্ধকারাচ্ছন্ন সময় পার করতে হতে পারে।’
একই সাথে ইয়েন্স স্পান চতুর্থ ঢেউয়ের লাগাম টানতে দ্রুত টিকা দেওয়া, যেসব অঞ্চলে সংক্রমণ বেশি, সেখানে চলাফেরায় বিধিনিষেধ জারি করাসহ সবার জন্য করোনার টিকা বাধ্যতামূলক করতে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের দাবি জানান।
জার্মানির স্বনামধন্য ভাইরোলজিস্ট ক্রিশ্চিয়ান ড্রস্টেন বর্তমান পরিস্থিতিতে সতর্ক করে বলেন, ‘যদি এখনই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া না হয়, তাহলে জার্মানিতে আরও বেশি সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়বে এবং আরও লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু ঘটতে পারে।’
এই বিশেষজ্ঞের মতে, বর্তমানে করোনা পরিস্থিতি গত বছরের চেয়েও খারাপ। কারণ, গত বছর এই সময় দেশটিতে কঠোর লকডাউন ছিল।
তিনি আরও বলেন, জার্মানির মোট জনসংখ্যার অর্ধেককেও যদি টিকার বুস্টার ডোজের বিষয়ে উৎসাহিত করা যায়, তাহলে সংক্রমণের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসবে।
বিশেষজ্ঞরা টিকা নিতে অনীহা প্রকাশকারীদের বিষয়ে বাধ্যতামূলক টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন। এ ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর তুলনায় জার্মানিতে টিকা দেওয়ার ধীরগতির বিষয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছে, জার্মানিতে এখনও প্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে টিকা দেওয়া সম্ভব হয়নি। করোনা সংক্রমণ ছড়ানোর এটিও একটি কারণ।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪০০
আপনার মতামত জানানঃ