এখনও আফগানিস্তানে নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ইসলামিক স্টেট। চলতি বছরের ১৫ অগাস্ট আসরফ গণি সরকারকে উৎখাত করে আফগান মসনদে বসে তালিবান। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর মানবাধিকার বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও সাধারণ আফগান জনগণ ভেবেছিল এবার হয়ত লাগাতার বোমা গুলির আওয়াজ থেকে নিস্তার মিলবে। দুর্ভাগ্যবশত সেটা হয়নি।
সম্প্রতি আফগানিস্তানে নিযুক্ত জাতিসংঘের বিশেষ দূত ডেবোরাহ লিয়ন্স জানান, তালিবান দখলের পর দেশটিতে ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠীর তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে তারা দেশের ৩৪টি প্রদেশে অবস্থান করছে বলে জানান তিনি। তালিবান দখলের পর আফগানিস্তানের সার্বিক পরিস্থিতি মূল্যায়নের সময় বুধবার এ কথা বলেন লিয়ন্স।
আইএস-কে দমনে ব্যর্থ তালিবান
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে ডেবোরাহ লিয়ন্স বলেন, “ইসলামিক স্টেট-খোরাসান প্রদেশের (আইএসকে) সম্প্রসারণে তালিবানের প্রতিক্রিয়া মূলত সন্দেহভাজন আইএসকে যোদ্ধাদের ‘বিচারবহির্ভূতভাবে আটক ও হত্যার’ মধ্যেই সীমাবদ্ধ বলে মনে হচ্ছে।”
এ ব্যাপারে অন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আরও মনোযোগ দেওয়া উচিত বলেও তিনি মন্তব্য করেন। বকাবুলের শিয়া মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় আইএসআইসের দুটি বিস্ফোরণের দায় স্বীকারের কয়েক ঘণ্টা পর এসব মন্তব্য করেন তিনি। ওই বিস্ফোরণের অন্তত একজন নিহত ও ছয়জন আহত হয়েছেন।
লিয়ন্সের মতে, তালিবানরা আইএসকের তৎপরতা থামাতে পারছে না। তিনি বলেন, “কয়েকটি প্রদেশ ও রাজধানীতে সীমাবদ্ধ নয় বরং আইএসকে এখন দেশের প্রায় সব প্রদেশে ছড়িয়ে পড়েছে বলে মনে হচ্ছে; এবং তারা ক্রমবর্ধমানভাবে সক্রিয়।”
লিয়ন্স আরও জানান, ২০২০ সালে আইএসকের আক্রমণের সংখ্যা ছিল ৬০টি। অথচ এই বছর শেষ হওয়ার আগেই এখন পর্যন্ত এই গোষ্ঠী ৩৩৪ টি হামলা চালিয়েছে সারা দেশে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ২০ বছরের যুদ্ধ শেষে এ বছরের আগস্টে কাবুল দখল করে নেয় তালিবান। নিজেদেরকে তারা আফগানিস্তানের আনুষ্ঠানিক সরকার হিসেবে উপস্থাপন করছে পুরো বিশ্বের সামনে। তবে তাদের সরকার ব্যবস্থায় সমন্বিত জাতি গোষ্ঠীর অংশগ্রহণ না থাকায় ও নারীদের অধিকার খর্ব করায় আন্তর্জাতিক চাপের মুখোমুখি হচ্ছে তারা প্রতিনিয়ত।
লিয়ন্স বলেন, জাতিসংঘ মিশন নিয়মিত বাড়ি তল্লাশি এবং সাবেক নিরাপত্তা কর্মী ও কর্মকর্তাদের ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের’ খবর পাচ্ছে।
অর্থনৈতিক সংকট ও খরার কারণে ইতোমধ্যেই হাজারো সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে দেশটি। সেইসঙ্গে শীতের আগমনে নতুন আরেকটি মানবিক বিপর্যয়ের বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছেন লিয়ন্স।
তিনি বলেন, অর্থনৈতিক পতন আফগানিস্তানে অবৈধ মাদক, অস্ত্র ও মানব পাচার এবং অনিয়ন্ত্রিত অর্থ বিনিময়কে আরও দেবে; এটি কেবল সন্ত্রাসবাদ বৃদ্ধিতেই সহায়তা করতে পারে। তিনি আরও বলেন, এই ঘটনাগুলো প্রথমে আফগানিস্তানকে এবং ধীরে ধীরে এই অঞ্চলকে প্রভাবিত করবে।
আফগানিস্তানে তালিবান শাসন শুরু হলেও সন্ত্রাসের চেনা ছবিটা আসলে বদলায়নি। বরং আফগানিস্তানের বিভিন্ন জায়গায় লাগাতার হামলার ঘটনা ঘটছে। তালিবান কাবুল দখল করার কয়েকদিনের মধ্যে ঘটে যায় ভয়াবহ বিস্ফোরণ।
কাবুল বিমানবন্দরে তখন অপেক্ষা করছেন হাজার হাজার মানুষ। মার্কিন সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে আফগানদের বিমানে ওঠার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আচমকাই ভয়াবহ বিস্ফোরণে প্রাণ হারান বহু মানুষ। শতাধিক মৃত্যুর ঘটনায় নতুন করে আতঙ্ক ছড়ায় কাবুলের বুকে। একাধিক মার্কিন সেনারও মৃত্যু হয়।
আর সেই ঘটনার পরই জানা যায় যে আত্মঘাতী হামলার নেপথ্যে রয়েছে ইসলামিক স্টেট-খোরাসান। এরপর বিভিন্ন হামলার ঘটনায় ইসলামিক স্টেট জঙ্গি সংগঠনের নাম সামনে এসেছে। তাদের আক্রমণ, ক্রমশই তালিবানে অস্বস্তি বাড়িয়ে তুলছিল।
যদিও লাগাতার আইএস হামলায় সাধারণ মানুষের প্রাণ হারানোর ঘটনার মাঝেই তালিবান শাসকদের দাবি, ইসলামিক স্টেট জঙ্গিদের নিয়ে যে আশঙ্কা ছিল, সেটা কম বেশি নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে। এক সাংবাদিক সম্মলনে তালিবান মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ জানিয়েছন, আফগানিস্তানের জন্য ইসলামিক স্টেট বড় কোনও আশঙ্কার বিষয় নয়।
তিনি আরও জানিয়েছেন, অগাস্ট মাসে আফগান মসনদে বসার পর থেকে ইসলামিক স্টেট সদস্য বা তাদের সঙ্গে যুক্ত ৬০০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মুজাহিদ জানিয়েছন, যাদের আটক করা হয়েছে তাদের মধ্যে বেশ কিছু মহিলাও রয়েছেন। প্রশাসনের মহিলা সদস্যরা তাদের জেরা করবে।
কারা এই আইএস-কে?
তালিবানের মত আইএসও একটি সুন্নি মুসলিম সংগঠন হলেও তারা তালিবানের থেকে আরও বেশি আগ্রাসী। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে ‘জেহাদ’ ছড়িয়ে দিতেই তারা বেশি আগ্রহী। ২০১৪ সালে সিরিয়ায় খিলাফত ঘোষণা করার সময় এই গোষ্ঠীটি প্রথম নজরে আসে।
আফগানিস্তান, ইরান, পাকিস্তান এবং তুর্কমেনিস্তানের কিছু অংশে বিস্তৃত একটি অঞ্চল ‘খোরাসান’ সহ অনেকগুলি জঙ্গি শাখাকে অনুপ্রাণিত করেছিল ইসলামিক স্টেট। মুজাহিদ বলেন মধ্যপ্রাচ্যে এই জঙ্গি গোষ্ঠীর প্রভাব থাকলে আফগানিস্তানে এদের নিয়ে চিন্তার কোনও কারণ নেই।
২০১৫ সালের জানুয়ারিতে আইএস-কে যাত্রা শুরু করে। বিবিসি বলছে, সেই সময় আইএসের রমরমা সময় যাচ্ছিল। কারণ, এর আগে ২০১৪ সালে সিরিয়া ও ইরাকের এলাকা দখল করে তথাকথিত ‘খেলাফত’ ঘোষণা করেছিল আইএস।
ফোর্বস বলছে, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের তালিবানের সদস্যদের নিয়ে আইএস-কে গঠিত হয়েছিল। এই সদস্যরা মনে করেছিল, তালিবান যথেষ্ট পরিমাণে শক্তিশালী নয় বা তাদের সেই ‘তথাকথিত আদর্শ’ বাস্তবায়নে যথেষ্ট কঠোর নয় তালিবান।
বলা হয়ে থাকে আফগানিস্তানের নানগাহার প্রদেশে আইএস-কে-এর বিচরণ। এ ছাড়া দেশটির উত্তরাঞ্চলের বেশ কিছু এলাকায় তাদের ঘাঁটি রয়েছে। এ প্রসঙ্গে ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অব ডেমোক্রেসিসের ফেলো বিল রোজিও ফোর্বসকে বলেন, এসব এলাকায় নিয়ন্ত্রণ নিতে গিয়ে তালিবান ও যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা সামরিক বাহিনীর ব্যাপক প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়েছিল তাদের। তবে সে লড়াই চালিয়ে সফল হয়েছিল আইএস-কে।
এসব এলাকার বাইরেও তাদের বিচরণ রয়েছে। আফগানিস্তানের দক্ষিণ অঞ্চলের কিছু কিছু এলাকাতেও তাদের উপস্থিতি রয়েছে। এর আগেও আইএস-কে কাবুলে হামলা চালিয়েছে। ২০২০ সালের মে মাসে কাবুলের হাসপাতালে হামলা চালিয়েছিল তারা। এ ছাড়া চলতি বছরের মে মাসে কাবুলে মেয়েদের একটি স্কুলে হামলা চালিয়েছিল আইএস-কে। দুই হামলাতেই বেশ কয়েকজন মারা গিয়েছিল।
বিবিসি বলছে, যখন আইএস-কে-এর রমরমা অবস্থা ছিল, তখন তাদের জঙ্গির সংখ্যা ছিল ৩ হাজারের মতো। আফগানিস্তানের সরকারি বাহিনী, যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনী ও তালিবানের হামলায় তাদের অনেক সদস্য মারা গেছে। ফলে তাদের সদস্যসংখ্যা কমেছে।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের পরিচালিত স্পেশাল ইন্সপেক্টর জেনারেল ফর আফগানিস্তান রিকনস্ট্রাকশন জাতিসংঘকে গত বছরের জুনে বলেছিল, আইএস-কে শক্তি সঞ্চয়ের চেষ্টা করছে। এ জন্য তারা তালিবান ও অন্যান্য সংগঠন থেকে সদস্য সংগ্রহ করছে।
তবে এই পদক্ষেপ সফলতা পায়নি বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এএফপি বলছে, আইএস-কে নিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে একটি প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে গত মাসে। তাতে বলা হয়েছে, তাদের সদস্যসংখ্যা এখন পাঁচ শর কাছাকাছি।
কতটা ভয়ংকর এই জঙ্গি সংগঠন?
বিবিসি বলছে, আফগানিস্তানে যেসব জঙ্গিগোষ্ঠী এখন সক্রিয় রয়েছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে নৃশংস এই আইএস-কে। স্কুলগামী মেয়েশিশু, হাসপাতাল, এমনকি হাসপাতালের প্রসূতি ইউনিটে হামলা চালিয়ে অন্তঃসত্ত্বা নারীদেরও হত্যা করেছে আইএসের এই শাখার জঙ্গিরা। বার্তা সংস্থা এএফপি বলেছে, তাদের স্লিপার সেল রয়েছে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে।
এই বার্তা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে মসজিদ-মাজারে হামলা চালিয়েছে আইএস-কে। মুসলমানদের মধ্যে যারা সুন্নি নয়, তাদের লক্ষ্য করে হামলা চালায় এই সংগঠনটি।
তবে বিভিন্ন এলাকায় আইএস-কে নৃশংস হামলা চালালেও খুব বেশি এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি। এরপর নিজেদের হামলার ধরন বদলে ফেলে আইএস-এর এই শাখা।
বিভিন্ন শহর বা এর পার্শ্ববর্তী এলাকায় আইএস-কের জঙ্গিরা ঘাপটি মেরে থাকে। এরপর তারা পরিচিত ব্যক্তিদের ওপর হামলা চালিয়ে থাকে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫৪৫
আপনার মতামত জানানঃ