আফগানিস্তানে তৎপর সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা না হলে তারা আগামী ছয় মাসের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে হামলা চালাতে পারে বলে সতর্ক করেছে পেন্টাগন। আগামী ছয় মাসের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে হামলা চালাতে পারে নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) আফগান শাখা আইএস-খোরাসান (আইএস-কে)। কংগ্রেসকে স্থানীয় সময় মঙ্গলবার এমনটাই জানান পেন্টাগনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা কলিন কাহল। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আফগানিস্তানের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
পেন্টাগনের নীতি নির্ধারণ বিষয়ক আন্ডারসেক্রেটারি কলিন কাহল বলেন, আইএস-খোরাসানের পাশাপাশি আল-কায়েদাও যুক্তরাষ্ট্রে হামলা চালাতে চায়। কিন্তু এই মুহূর্তে তাদের কারো সেই সক্ষমতা নেই।
পেন্টাগনের এই কর্মকর্তা আর বলেন, তবে আইএস-খোরাসান আগামী ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে সে সক্ষমতায় পৌঁছে যেতে পারে বলে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ধারণা করছে। তারা বলেছে, আল-কায়েদার একই সক্ষমতায় পৌঁছাতে সময় লাগবে এক থেকে দুই বছর।
আফগানিস্তানে তৎপর আইএস-খোরাসান গোষ্ঠীকে নির্মূল করার ইচ্ছা ও সক্ষমতা তালিবান সরকারের আছে কিনা তা মার্কিন গোয়েন্দারা পর্যালোচনা করে দেখছে বলেও জানান কলিন কাহল।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তায় আফগানিস্তান যে এখনও হুমকি, তা কাহলের ওই মন্তব্য ফের মনে করিয়ে দিল।
চলতি বছরের আগস্টে আফগানিস্তান থেকে নিজেদের সেনা প্রত্যাহারের মাধ্যমে দীর্ঘ ২০ বছরের যুদ্ধের ইতি টানে যুক্তরাষ্ট্র। ১৫ আগস্ট কাবুল পতনের মধ্য দিয়ে আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে তালিবান। আন্তর্জাতিক সহায়তা ও স্বীকৃতি পেতে ক্ষমতা দখলের পর দুই মাসের বেশি সময় ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে গোষ্ঠীটি। একই সঙ্গে দেশজুড়ে স্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টিরও অঙ্গীকার করে তারা।
তবে আফগানিস্তানজুড়ে আইএস-কের সাম্প্রতিক বেশ কয়েকটি হামলা তালিবানকে উদ্বেগে ফেলেছে। মূলত দেশটির সংখ্যালঘু শিয়া সম্প্রদায় আইএস-কের হামলার লক্ষ্য।
১৫ অক্টোবর জুমার নামাজের সময় আফগানিস্তানের কান্দাহার শহরে এক শিয়া মসজিদে আইএস-কের বোমা হামলায় ৬০ জনের মৃত্যু হয়।
এর আগে ৮ অক্টোবর দেশটির কুন্দুজ শহরে আরেক শিয়া মসজিদে নামাজরত মুসল্লিদের ওপর আত্মঘাতী বোমা হামলা চালায় আইএস-কে। ওই ঘটনায় অন্তত ৫০ মুসল্লির মৃত্যু ঘটে।
এমনকি আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় জালালাবাদ শহরে সম্প্রতি তালিবানের এক সদস্যকে শিরশ্ছেদও করে আইএস-কের যোদ্ধারা।
কাহল জানান, আগস্টে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা আফগানিস্তান ছাড়ার পর তালিবান কার্যকরভাবে আইএস-কের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সক্ষম কি না, এ বিষয়ে এখনও নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, ‘এটি আমাদের মূল্যায়ন, তালিবান ও আইএস-কে পরস্পরের শত্রু। আইএস-কে নির্মূলের চেষ্টা করবে তালিবান। তবে তারা সেটি করতে সফল হবে কি না, সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।’
আফগানিস্তানে আইএস-কের কয়েক হাজার যোদ্ধা রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার ওই কর্মকর্তা।
আফগানিস্তানে আইএস-কের হামলার বিষয়ে সম্প্রতি দেশটির ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি জানান, আইএস-কে যোদ্ধাদের হুমকি মোকাবিলা করা হবে। অন্য দেশে হামলা চালাতে আফগানিস্তান কোনো সশস্ত্র সংগঠনের ঘাঁটিতে পরিণত হবে না।
কাহল আরও জানান, তালিবানের সঙ্গে আল-কায়েদার ঘনিষ্ঠতা পরিস্থিতি আরও জটিল করেছে। আগামী এক বা দুই বছরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে হামলা চালানোর সক্ষমতা অর্জন করবে আল-কায়েদা।
আফগানিস্তানে কোনো সেনা না থাকায় আইএস-কে ও আল-কায়েদার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এ মুহূর্তে কঠিন বলে পেন্টাগনের কর্মকর্তারা সম্প্রতি সতর্ক করেন।
আফগানিস্তানে আইএসের উপস্থিতির সূচনা হয়েছিল ২০১৪ সালের ইসলামিক স্টেট ঘোষণার সময়েই। কিছু ছোট ছোট গোষ্ঠী আইএসের পতাকাতলে সমবেত হয়। এর মধ্যে প্রথম আইএস স্বীকৃত গোষ্ঠী ছিল তেহরিক-ই খিলাফত খোরাসান (টিকেকে)। এ ছাড়া আবদুল কাধিম রউফ প্রতিষ্ঠিত খিলাফত আফগান। কাধিম একজন সাবেক তালিবান এবং একসময় কোয়েটা শুরার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সাবেক হাক্কানি জঙ্গিদের নিয়ে গঠিত আজিজুল্লাহ হাক্কানির দল। তা ছাড়া ছিল তেহরিক-ই খিলাফত পাকিস্তান (টিকেপি)।
২০১৯ সালের দিকে দেখা গেছে যে ইরানে অত্যন্ত দুর্বলভাবে আইএস খোরাসানসংশ্লিষ্ট কয়েকটি গোষ্ঠী কাজ করছে। এদের মধ্যে ছিল হারাকাত খিলাফত বালুচি, ইরানের খোরাসান শাখা এবং পশ্চিম আজারবাইজান ইসলামিক মুভমেন্ট। মধ্য এশিয়ায় কয়েকটি গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগের কথা জানা যায়। এগুলো ইসলামিক মুভমেন্ট অব উজবেকিস্তান (আইএমইউ); তাজিকিস্তানে জামাত আনসারুল্লাহ এবং ইসলামিক মুভমেন্ট অব তুর্কমেনিস্তান (আইএমটি)। উইঘুর মুসলিমদের মধ্যে পূর্ব তুর্কিস্তান ইসলামি আন্দোলনের (ইটিআইএম/ইটিআইপি) উপস্থিতির কথা চীন বরাবর বলে এসেছে।
আফগানিস্তানের বাইরে এসব গোষ্ঠীর সঙ্গে আইএস খোরাসানের যোগাযোগ থাকলেও সংগঠনের প্রধান ভিত্তি হচ্ছে আফগানিস্তান। লক্ষণীয় যে গত কয়েক বছরে এই সংগঠনের শক্তি ধীরগতিতে হলেও বৃদ্ধি পেয়েছে।
তালিবানের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন?
তালিবান প্রায় দুই দশক ধরে অব্যাহতভাবে সহিংস উগ্রপন্থা অনুসরণ এবং যুদ্ধ করলেও তাদের লক্ষ্য সীমিত থেকেছে আফগানিস্তানের ভেতরেই। মার্কিন সৈন্যদের ওপরে হামলা পরিচালনা করেছে, কিন্তু আফগানিস্তানের বাইরে মার্কিন স্বার্থের ওপরে হামলা করেনি। যে কারণে তালিবানকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন বলে চিহ্নিত করেনি। তারা পাকিস্তানের তালিবান সমর্থকদের সাহায্য নিয়েছে এবং সহায়তা করেছে—এর বাইরে তাদের কোনো আন্তর্জাতিক উপস্থিতি থাকেনি। অন্যদিকে আইসিস খোরাসান রাজনৈতিক সীমানাকে অস্বীকার করে এবং কয়েকটি দেশে তাদের উপস্থিতি বজায় রেখেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বকে তাদের প্রধান শত্রু এবং আক্রমণের লক্ষ্যবস্ত বলে বিবেচনা করে। কৌশলগত এই পার্থক্য এবং আফগানিস্তান নিজের দখলে রাখার উদ্দেশ্যেই তালিবান আইএসের বিরোধিতা করে থাকে। তদুপরি আইএস তালিবানকে ধর্মত্যাগী বলেই বর্ণনা করে।
তালিবানের সঙ্গে আইএসের বিরোধপূর্ণ সম্পর্কের সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তালিবানের চুক্তিকে প্রবলভাবে সমালোচনা করেছে এবং একে তালিবানের জিহাদের পথ ত্যাগ বলেছে। তালিবান কাবুল দখলের পর সারা পৃথিবীর বিভিন্ন উগ্রবাদী সংগঠনের পক্ষ থেকে উল্লাস প্রকাশ করা হলেও আইএসের পক্ষ থেকে বরং উল্টোটাই দেখা গেছে। সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপের সূত্রে জানা যাচ্ছে যে কাবুল পতনের পরে আইএসের একটি মন্তব্য প্রতিবেদনে তালিবানের বিরুদ্ধে জেহাদের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ করা হয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫১১
আপনার মতামত জানানঃ