রাজধানীর বনানীর রেইনট্রি হোটেলে দুই শিক্ষার্থী ধর্ষণ মামলায় আপন জুয়েলার্সের কর্ণধার দিলদার আহমেদের ছেলে সাফাত আহমেদসহ ৫ আসামির রায়ের জন্য আজ বৃহস্পতিবার দিন ধার্য ছিল। গত ২৭ অক্টোবর ঢাকার সাত নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক বেগম মোছা. কামরুন্নাহারের আদালতে রায় ঘোষণার জন্য তারিখ ধার্য ছিল। তবে ওই দিন সুপ্রিম কোর্টের প্রবীণ আইনজীবী আব্দুল বাসেত মজুমদারের মৃত্যুতে আদালতের কার্যক্রম বন্ধ রাখার কারণে রায় হয়নি। এজন্য এই মামলার রায়ের তারিখ পিছিয়ে ১১ নভেম্বর ধার্য করা হয়। আজকের রায়ে মামলায় প্রধান আসামি আপন জুয়েলার্সের কর্ণধার দিলদার আহমেদের ছেলে সাফাত আহমেদসহ পাঁচ আসামির সবাই খালাস পেয়েছেন। ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭-এর বিচারক বেগম মোছা. কামরুন্নাহার আজ এ রায় দেন।
রায় উপলক্ষে সকাল ৯টার দিকে আসামিদের আদালতে আনা হয়। প্রথমে তাদের রাখা হয় ঢাকা মুখ্য মহানগর আদালতের গারদখানায়। পরে বেলা সাড়ে ১২টার দিকে তোলা হয় এজলাসে। রায়ের ওপর পর্যবেক্ষণ আলোচনা শেষে দুপুর দেড়টার দিকে বিচার্য বিষয় পড়ে শোনান। আর ২টা ৫০ মিনিটে রায় ঘোষণা করা হয়।
আলোচিত মামলাটির রায় উপলক্ষে আদালতপাড়ায় বাড়তি নিরাপত্তার জন্য প্রায় অর্ধশত পুলিশ মোতায়েন করা হয়।
সাফাত ছাড়া বাকি ৪ আসামি হলেন— সাফাত আহমেদের বন্ধু সাদমান সাকিফ, নাঈম আশরাফ ওরফে এইচ এম হালিম, সাফাতের দেহরক্ষী রহমত আলী ও গাড়িচালক বিল্লাল হোসেন।
সংশ্লিষ্ট আদালতের বিশেষ পাবলিক প্রসিকিউটর আফরোজা ফারহানা আহমেদ অরেঞ্জ গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘আমাদের দুজন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী আদালতে এসে সাক্ষ্য দেননি। এ ছাড়া সিসিটিভি ক্যামেরা ফুটেজ জমা দেয়া হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘চিকিৎসা প্রতিবেদনে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায়নি। তবে উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত আছে, পারিপার্শ্বিক বিবেচনায় আদালত যদি মনে করে আসামিদের দণ্ড দিতে পারে।’
এর আগে গত ২৯ আগস্ট আত্মপক্ষ শুনানিতে মামলার প্রধান আসামি আপন জুয়েলার্সের কর্ণধার দিলদার আহমেদের ছেলে সাফাত আহমেদসহ পাঁচ আসামি নিজেদের নির্দোষ দাবি করে ন্যায়বিচার প্রার্থনা করেন। গত ২২ আগস্ট মামলাটিতে সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। এ মামলায় চার্জশিটভুক্ত ৪৭ জন সাক্ষীর মধ্যে ২২ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করেছে আদালত।
২০১৭ সালের ২৮ মার্চ জন্মদিনের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়ে অস্ত্রের মুখে ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই দুই ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে ৬ মে বনানী থানায় পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। এর আগে ২০১৮ সালের ১৩ জুলাই আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে আদালত। ওই বছরের গত ৭ জুন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের (ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার) পরিদর্শক ইসমত আরা এমি পাঁচজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রটি আদালতে জমা দেন।
আলোচিত এই ধর্ষণ মামলার প্রধান আসামি প্রভাবশালী হওয়ায় শুরু থেকেই নানা সমালোচনা রয়েছে। জন্মদিনের দাওয়াত দিয়ে দুই তরুণীকে হোটেল রুমে ১৩ ঘণ্টা আটকে রেখে অস্ত্রের মুখে ধর্ষণ করা হয়৷ তারা ধর্ষণের ঘটনা ভিডিও করে৷ এরপর তাদের প্রাণনাশের হুমকি এবং ভিডিও প্রকাশের হুমকি দিয়ে মামলা থেকে বিরত রাখা হয়৷ শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে তারা বনানী থানায় মামলা করতে যান৷ সেখানকার পুলিশ তাদের দুই দিন ঘুরিয়ে পরে মামলা নেয়৷
মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, ২০১৭ সালের ২৮ মার্চ রাত ৯টা থেকে পরদিন সকাল ১০টা পর্যন্ত অভিযুক্তরা মামলার বাদী, তার বান্ধবী ও বন্ধুকে আটকে রাখে। অস্ত্র দেখিয়ে ভয় প্রদর্শন ও অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করে। বাদী ও তার বান্ধবীকে জোর করে একটি কক্ষে নিয়ে যায় তারা। বাদীকে সাফাত আহমেদ ও তার বান্ধবীকে নাঈম আশরাফ একাধিকবার ধর্ষণ করে।
অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়, সাদমান সাকিফকে দুই বছর ধরে চেনেন মামলার বাদী। তার মাধ্যমেই ঘটনার ১০ থেকে ১৫ দিন আগে সাফাতের সঙ্গে দুই ছাত্রীর পরিচয় হয়। ওই দুই ছাত্রী সাফাতের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যান। সাফাতের গাড়িচালক বিল্লাল ও দেহরক্ষী তাদের বনানীর ২৭ নম্বর রোডে রেইনট্রি হোটেলে নিয়ে যায়। হোটেলে যাওয়ার আগে বাদী ও তার বান্ধবী জানতেন না যে, সেখানে পার্টি হবে। তাদের বলা হয়েছিল, এটা একটা বড় অনুষ্ঠান, অনেক লোকজন থাকবে। অনুষ্ঠান হবে হোটেলের ছাদে। সেখানে যাওয়ার পর তারা কাউকে দেখেননি। সেখানে আরও দুই তরুণী ছিল। বাদী ও তার বান্ধবী সাফাত ও নাঈমকে ওই দুই তরুণীকে ছাদ থেকে নিচে নিয়ে যেতে দেখেন। এ সময় বাদীর বন্ধু ও আরেক বান্ধবী ছাদে আসেন। পরিবেশ ভালো না লাগায় তারা চলে যেতে চান। এই সময় অভিযুক্তরা তাদের গাড়ির চাবি শাহরিয়ারের কাছ থেকে নিয়ে নেয় এবং তাকে মারধর করে। ধর্ষণের সময় সাফাত গাড়িচালককে ভিডিওচিত্র ধারণ করতে বলেন। বাদীকে নাঈম আশরাফ মারধর করে
ওই ঘটনায় ২০১৭ সালের ৬ মে পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলাটি দায়ের করা হয়। ওই বছর ৭ জুন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের (ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার) পরিদর্শক ইসমত আরা এমি আদালতে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। আসামিরা হলো, সাফাত আহমেদ, নাঈম আশরাফ, সাদমান সাকিফ, দেহরক্ষী রহমত আলী ও গাড়িচালক বিল্লাল হোসেন।
ধর্ষণের মামলাটি করার কয়েকদিনের মধ্যে সিলেট থেকে ১১ মে সাফাতকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ গ্রেপ্তার হন অন্য আসামিরাও৷ এই ধর্ষণের ঘটনায় তুমুল আলোচনার মধ্যে আপন জুয়েলার্সের বিভিন্ন শাখায় শুল্ক গোয়েন্দাদের অভিযান শুরু হয় এবং বেআইনি সোনা পাওয়ায় দিলদারের বিরুদ্ধে মামলা হয়৷
আসামি পক্ষের আইনজীবীদের মতে, ধর্ষণের মামলাটি সাফাতের সাবেক স্ত্রী ফারিয়া মাহবুব পিয়াসার ইন্ধনে হয়েছে৷ মামলা হওয়ার কয়েক মাস আগে সাফাতের সঙ্গে পিয়াসার বিচ্ছেদ হয়৷ মামলা হয় পিয়াসা এবং তার সাবেক শ্বশুর দিলদারের মধ্যেও৷
সাফাতের সাবেক স্ত্রী পিয়াসা সম্প্রতি মাদকের মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে এখন কারাগারে৷
আলোচিত এই ধর্ষণ মামলার প্রধান আসামি প্রভাবশালী হওয়ায় শুরু থেকেই নানা সমালোচনা রয়েছে। জন্মদিনের দাওয়াত দিয়ে দুই তরুণীকে হোটেল রুমে ১৩ ঘণ্টা আটকে রেখে অস্ত্রের মুখে ধর্ষণ করা হয়৷ তারা ধর্ষণের ঘটনা ভিডিও করে৷ এরপর তাদের প্রাণনাশের হুমকি এবং ভিডিও প্রকাশের হুমকি দিয়ে মামলা থেকে বিরত রাখা হয়৷ শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে তারা বনানী থানায় মামলা করতে যান৷ সেখানকার পুলিশ তাদের দুই দিন ঘুরিয়ে পরে মামলা নেয়৷
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, সাধারণত ধর্ষণের পর প্রভাশালীরা সালিশসহ নানা বাহানায় সময় পার করে৷ তারপর থানায় গেলে থানা নানাভাবে মামলা নিতে দেরি করে৷ ফলে ধর্ষণ প্রমাণ কঠিন হয়ে পড়ে৷
কুমিল্লার তনু, দিনাজপুরের পূজার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে৷ তনুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে৷ তনু ধর্ষণ এবং হত্যার ঘটনা ঘটেছে সেনানিবাসের মধ্যে৷ সেখানেও ধর্ষকরা ঢাকার ঘটনার মতো প্রভাবশালী৷
বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রভাবশালীরা কয়েকভাবে ধর্ষণ মামলাকে দুর্বল করার চেষ্টা করে৷ তারা প্রথমে চেষ্টা করে মেডিক্যাল টেস্টকে দুর্বল করতে৷ বাদি এবং সাক্ষী উভয়কে চাপ ও হুমকি দিয়ে সমঝোতা করাতে এবং আলামত নষ্ট করতে৷ আর এই কাজে প্রভাবশালীরা রাজনৈতিক প্রভাব, অর্থ এবং পুলিশকে কাজে লাগায়৷ বনানীর ধর্ষণের ঘটনায় যা স্পষ্ট হয়েছে৷
তারা বলেন, পুলিশ প্রভাবশালীদের হয়ে ধর্ষণের শিকার যারা হন, তাদের ‘চরিত্র হরণ’ করে৷ একই সঙ্গে মেডিক্যাল টেস্টের জন্য পাঠাতে দেরি করে, যাতে ঘটনা প্রমাণ করা না যায়৷
তারা মনে করেন, আদালতে ধর্ষণ মামলার বিচার প্রক্রিয়াও ত্রুটিপূর্ণ৷ ধর্ষণকে যেভাবে আদালতে প্রমাণ করতে হয়, সাক্ষ্য আইন মেনে তা অনেক জটিল এবং অবমাননাকর৷ ফলে অনেক ভিকটিম মামলা করলেও আর শেষ পর্যন্ত আদালতে যান না৷
তারা জানান, নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ ট্রাইব্যুনালে ৬ মাসের মধ্যে এসব মামলার বিচার শেষ করার বিধান আছে৷ কিন্তু নানা অজুহাতে তা শেষ হয় না৷ অর্থ ও ক্ষমতার কারণে কিছু অসৎ পুলিশও প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে মামলা নিতে গড়িমসি করে। আবার মামলা নিলেও তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে টালবাহানা করে। কখনো টাকার বিনিময়ে অপরাধীদের বাঁচিয়ে প্রতিবেদন দিতে চেষ্টা করে দুর্নীতিপরায়ণ পুলিশ। কিংবা অপরাধী প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও পুলিশ তাদের না দেখার ভান করে।
একটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটার পর পুলিশের যথাসময়ে সঠিক ধারায় মামলা গ্রহণ, ধর্ষক ও ধর্ষিতার সঠিক বয়স উল্লেখ, মামলার সুষ্ঠু তদন্ত, চিকিৎসকের নির্ভুল ময়নাতদন্ত, যথাযথ ডিএনএ পরীক্ষার ফলাফলের ওপর পুরো বিচার প্রক্রিয়া নির্ভরশীল। এর ভিন্নতা হলে ধর্ষক বিচারে আইনের ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে। কাজেই ধর্ষণের মতো স্পর্শকাতর ঘটনায় অপরাধী যাতে উপযুক্ত শাস্তি পায় এর নিশ্চয়তা বিধান মামলার বিচার সংশ্লিষ্টদের মানবিক দায়িত্ব ও কর্তব্য।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৫০
আপনার মতামত জানানঃ