পাকিস্তানের নিষিদ্ধ ইসলামি কট্টরপন্থী গোষ্ঠী তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তানের (টিটিপি) সঙ্গে অস্ত্রবিরতি চুক্তিতে যাওয়ায় প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে সমন পাঠিয়েছিল দেশটির সুপ্রিমকোর্ট। আজ বুধবার তাকে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে সমনে। এই সমন পেয়ে সুপ্রিমকোর্টে উপস্থিত হোন ইমরান খান। এসময় জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে অস্ত্রবিরতি চুক্তিতে যাওয়ায় ইমরান খানকে ভর্ৎসনা করেছেন দেশটির সুপ্রিমকোর্ট।
পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি গুলজার আহমেদ প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেন, ‘আপনি বর্তমানে ক্ষমতায় আছেন। দেশের সরকার আপনার নেতৃত্বে চলে। কিন্তু তারপরও কিছু স্বীকৃত অপরাধীকে আপনি আলোচনার টেবিলে নিয়ে এলেন। এটা আপনি কী করলেন? কীভাবে করতে পারলেন? আমরা কি আবারও তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করছি?’
গত মঙ্গলবার পাকিস্তানি তালিবান নামে পরিচিত তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তানের (টিটিপি) সঙ্গে এক মাসের অস্ত্রবিরতি চুক্তি করেছে পাকিস্তান সরকার। আপাতত এক মাসের জন্য সমঝোতায় পৌঁছেছে দুইপক্ষ। আগামী ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ চুক্তি বলবৎ থাকবে। পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী ফাওয়াদ চৌধুরি এক বিৃবতিতে জানিয়েছেন, যদি উভয়পক্ষ সম্মত থাকে, সেক্ষেত্রে চুক্তির মেয়াদ আরও বাড়বে।
এই ঘটনার জেরে বুধবার ইমরান খানকে তলব করেন সুপ্রিমকোর্ট এবং প্রশ্ন করেন— কোন যুক্তিতে তিনি একটি নিষিদ্ধ জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হলেন? এক্ষেত্রে ২০১৪ সালের পেশোয়ারে টিটিপির হামলার উদাহারণ টানেন আদালত।
২০১৪ সালে পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের রাজধানী পেশোয়ারের এপিএস ওয়ারসাক স্কুলে হামলা চালিয়ে ১৪৭ জনকে হত্যা করেছিল টিটিপি। নিহতদের ১৩২ জনই ছিল শিশু।
আদালতের প্রশ্নের জবাবে ইমরান বলেন, ২০১৪ সালের হামলা তার জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক স্মৃতি, কারণ সে সময় পেশোয়ারে তার দল ক্ষমতাসীন ছিল।
আদালতের উদ্দেশে ইমরান বলেন, কিন্তু তারপর ওই অঞ্চলে মোট ৪৮০ বার ড্রোন হামলা হয়েছে, এতে মারা গেছেন প্রায় ৮০ হাজার মানুষ। এ হামলাগুলো কে করল, কারা করল-সেটিও তো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
তার এই মন্তব্যের উত্তরে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘এই প্রশ্নগুলোর উত্তর বের করা তো আপনার কাজ। আপনি দেশের প্রধানমন্ত্রী। সরকারপ্রধান হিসেবে এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আপনার দায়িত্ব এবং আপনার কাছে উত্তর থাকা উচিত।’
‘জনাব প্রধানমন্ত্রী, আমরা কিন্তু কোনো ছোট দেশ নই। বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম সামরিক বাহিনী রয়েছে আমাদের।’
প্রধানমন্ত্রীকে ভর্ৎসনার পাশাপাশি দেশের গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিও উষ্মা প্রকাশ করেন প্রধান বিচারপতি। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘যখন নিজের দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তার প্রশ্ন আসে, তখন গোয়েন্দা সংস্থা কোথায় থাকে? পেশোয়ারের ঘটনায় সাবেক সেনা প্রধান বা সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কি কোনো মামলা করা হয়েছিল?’
জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, তদন্তকারী দল ঘটনার সঙ্গে সামরিক বাহিনীর কোনো সংশ্লিষ্টতা পায়নি।
কিন্তু তার বক্তব্যে সন্তুষ্ট না হয়ে খেদ প্রকাশ করে আদালত বলেন, ‘আমাদের একটি বিশাল গোয়েন্দা সংস্থা আছে। প্রতি মাসে কোটি কোটি রুপি এই সংস্থার পেছনে খরচ হচ্ছে। সরকার দাবি করে, আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা বিশ্বের অন্যতম সেরা সংস্থা। কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে এই গোয়েন্দা সংস্থার আউটপুট শূন্য।’
গত মঙ্গলবার পাকিস্তানি তালিবান নামে পরিচিত তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তানের (টিটিপি) সঙ্গে এক মাসের অস্ত্রবিরতি চুক্তি করেছে পাকিস্তান সরকার। আপাতত এক মাসের জন্য সমঝোতায় পৌঁছেছে দুইপক্ষ। আগামী ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ চুক্তি বলবৎ থাকবে। পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী ফাওয়াদ চৌধুরি এক বিৃবতিতে জানিয়েছেন, যদি উভয়পক্ষ সম্মত থাকে, সেক্ষেত্রে চুক্তির মেয়াদ আরও বাড়বে।
গত আগস্টে আফগানিস্তানে তালিবানরা ক্ষমতায় আসে। এরপর টিটিপির সঙ্গে পাকিস্তান সরকারের আবারও আলোচনা শুরু হয়। সীমান্তের ওপারে আফগানিস্তানে, আফগান তালিবান নেতাদের সহযোগিতায় দুই পক্ষ বৈঠকে বসে।
নোবেলজয়ী মালালা ইউসুফজাইকে হত্যাচেষ্টার মাধ্যমে পশ্চিমা বিশ্বে পরিচিতি পায় টিটিপি। সংগঠনটির একের পর এক আত্মঘাতী হামলা ও বোমা হামলায় এরই মধ্যে পাকিস্তানের কয়েক হাজার সামরিক-বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন।
২০১৪ সালে গোষ্ঠীটি আফগান সীমান্তের কাছে পেশোয়ারে সামরিক বাহিনী পরিচালিত একটি বিদ্যালয়ে হামলা চালিয়ে ১৩২ শিশুসহ ১৪৯ জনকে হত্যা করে।
সর্বশেষ গত শনিবারও তারা দেশটির উত্তর ওয়াজিরিস্তানে একটি বোমা হামলার দায় স্বীকার করে। ওই হামলায় চার সেনা নিহত ও একজন আহত হয়েছেন। টিটিপি বলছে, দুই দিন আগে তাদের চার যোদ্ধাকে হত্যার প্রতিশোধ হিসেবে এই হামলা চালিয়েছে তারা।
আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পাকিস্তানি তালিবান যারা তেহরিক-ই-তালিবান (টিটিপি) নামে পরিচিত। সশস্ত্র গোষ্ঠীটির আফগানিস্তানের তালিবান থেকে আলাদাভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করে। বেশ কয়েক বছর ধরেই তারা পাকিস্তানে সক্রিয়। তারা মূলত পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করে সেখানে ইসলামি শরিয়া আইন চালু করতে চাইছে।
এদিকে চলতি সপ্তাহে পাকিস্তানের একটি জঙ্গি সংগঠন তেহরিক-ই-লাব্বাইক পাকিস্তানের (টিএলপি) নাম নিষেধাজ্ঞার তালিকা থেকে প্রত্যাহার করে ইসলামাবাদ। এর আগে বিভিন্ন কারাগার থেকে মুক্তি পায় গোষ্ঠীটির কয়েক শ সদস্য।
চলতি বছরের শুরুর দিকে তেহরিক-ই-লবাইককে (টিএলপি) জঙ্গি তকমা দিয়েছিল পাকিস্তান সরকার। সে সময় সংগঠনের প্রধান সাদ রাজভি-সহ গ্রেপ্তার করা হয়েছিল হাজার দু’য়েক সদস্যকে।
টিএলপিকে নিষিদ্ধ করার সময় পাকিস্তান সরকার যে বিবৃতি দিয়েছিল, কেন্দ্রীয় সরকার সে সময় বলেছিল, ‘তেহরিক-ই-লাব্বিক পাকিস্তান যে সন্ত্রাসবাদে যুক্ত আছে, তার অনেক যুক্তিসংগত প্রমাণ আছে। তারা দেশের শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্ন করছে।’ মজার বিষয় হচ্ছে, সেই একই কর্তৃপক্ষ এখন রাজধানী দখল করে নেওয়ার হুমকির মুখে তাদের নির্দোষ ঘোষণা করছে। শুধু তাই নয়, নির্বাচনেও অংশগ্রহণের পথও খুলে দেয়া হচ্ছে এই সন্ত্রাসী সংগঠনটির জন্য।
সেই টিএলপি-কেই এ বার দেশটর নির্বাচনে অংশগ্রহণের টিকিট দিতে চলেছে ইমরান খানের সরকার। পাশাপাশি তুলে নেওয়া হচ্ছে তাদের জঙ্গি তকমাও। সংশিষ্টদের মন্তব্য, নামে গণতন্ত্র হলেও পাকিস্তানের ক্ষমতা আসলে রয়েছে সেনা ও মৌলবাদীদের হাতে। এবার শান্তিচুক্তির নামে জেহাদি সংগঠন ‘তেহরিক-ই-লাবাইক’-কে ভোটে লড়ার অনুমতি দিয়ে আবারও সেটা প্রমাণ করল ইসলামাবাদ।
প্রসঙ্গত, চলতি বছরের শুরুতে পাকিস্তানে নিযুক্ত ফরাসি দূতের বহিষ্কার চেয়ে সরব হয় টিএলপি। তারা অভিযোগ করে, একটি ফরাসি ব্যঙ্গচিত্র পত্রিকায় তাদের ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করা হয়েছে। সে সময় লাহৌর-ইসলামাবাদ জাতীয় সড়কে তাদের তাণ্ডবে মৃত্যু হয় সাত জন পুলিশ অফিসারের। এছাড়া আহত হন শতাধিক।
সূত্র মতে, এ নিয়ে পাক সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে টিএলপি নেতৃত্বের খুব সম্প্রতি আলোচনা হয়েছে। পঞ্জাব প্রদেশের আইনমন্ত্রী রাজা বাশারত জানিয়েছেন, ইতিমধ্যেই টিএলপি-র হাজারখানেক সদস্যসহ রাজভিকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। বাকি প্রায় ১৩০০ জনকেও মুক্তি দেওয়া হবে। শোনা যাচ্ছে, তাদের জঙ্গি আখ্যা তুলে নেয়া হলে, তারাও আর ফরাসি দূতের বহিষ্কার চাইবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে টিএলপি।
দেশটির বিশ্লেষকরা বলছেন, ইমরান খান সরকারের যে ডানপন্থী নীতি, সেটাও সমানভাবে ধর্মান্ধতাকে উসকে দিচ্ছে। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের ক্ষেত্রে টিএলপির চরমপন্থা এবং পিটিআই সরকারের নীতির মধ্যে পার্থক্য খুব সামান্য। এটা গভীর উদ্বেগের বিষয়। শুধু টিএলপির কাছে আত্মসমর্পণ নয়, ইমরান সরকার এখন বেআইনি সশস্ত্র গোষ্ঠী তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তানের (টিটিপি) সঙ্গে শান্তি স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হাজার হাজার পাকিস্তানিকে হত্যার জন্য দায়ী। সরকার এমন এক সময়ে টিটিপির সঙ্গে সন্ধির প্রস্তাব দিয়েছে, যখন তারা আদিবাসী-অধ্যুষিত এলাকায় সন্ত্রাসী হামলা বাড়িয়ে চলেছে। এসব হামলায় গত পাঁচ মাসে অসংখ্য পাকিস্তানি সেনার মৃত্যু হয়েছে। ধর্মান্ধ গোষ্ঠীকে তুষ্ট করার পাকিস্তান সরকারের এই নীতি দেশে সন্ত্রাসবাদ বৃদ্ধির হুমকি তৈরি করেছে। সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর কাছে এই আত্মসমর্পণ পাকিস্তানের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে আরও গুরুতর সংকট তৈরি করতে যাচ্ছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২২৪৪
আপনার মতামত জানানঃ