মিয়ানমারে আটক মার্কিন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ‘সন্ত্রাসবাদ’ ও সরকার উৎখাত চেষ্টায় ভিন্নমত উসকে দেওয়ার অভিযোগ এনেছে দেশটির জান্তা সরকার। অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা দেওয়া হতে পারে।
গত মে মাসে মিয়ানমার ছাড়ার সময় গ্রেপ্তার হন ড্যানি ফেনস্টার নামের ওই সাংবাদিক। বুধবার তার আইনজীবী থ্যান জো অং জানান, তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইন ও মিয়ানমার প্যানেল কোডে নতুন দুটি অভিযোগ আনা হয়েছে। বিশেষ করে ‘সন্ত্রাসী’দের ক্ষেত্রে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে অভিযোগ আনা হয়। নতুন এ দুটি অভিযোগ ফেনস্টারকে মুক্ত করতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টায় বড় ধরনের ধাক্কা দিল।
৩৭ বছর বয়সি ফেনস্টার ছিলেন ফ্রন্টিয়ার মিয়ানমারের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক। এ বছরের মে মাসে মিয়ানমার ছাড়ার ফ্লাইটে উঠতে গিয়ে ইয়াঙ্গুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে আটক হন তিনি।
দোষী সাব্যস্ত হলে সন্ত্রাসবাদ আইনে তার সর্বোচ্চ ২০ এবং সরকার উৎখাত চেষ্টার দায়ে আরও ২০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে।
এই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ আনা হলো, জাতিসংঘের সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত বিল রিচার্ডসনের জান্তা সরকারের প্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের সঙ্গে নাইপিদোতে বৈঠকের পর।
গতকাল মঙ্গলবার ফেনস্টারের বিরুদ্ধে নতুন করে অভিযোগগুলো আনা হয়েছে। ১৬ নভেম্বর এ নিয়ে বিচারকাজ শুরু হবে। তার বিরুদ্ধে আগে থেকেই সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধাচরণে উৎসাহ দেওয়া, আইনের বাইরে গিয়ে বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ এবং অভিবাসন আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। আইনজীবী জ অং বলেন, নতুনভাবে অভিযোগ আনায় ফেনস্টার হতাশ হয়েছেন।
ফেনস্টারের আইনজীবী থান জ অং রয়টার্সকে বলেন, কেন তার বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ আনা হচ্ছে তা বুঝতে পারছি না আমরা; তবে নতুন অভিযোগ যোগ করা মোটেই ভালো কিছু নয়। এসব অভিযোগ দেওয়ায় ড্যানি ফেনস্টারও খুব হতাশ হয়েছে, দুঃখ পেয়েছে।
মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি গণমাধ্যমকর্মীসহ সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারী কয়েকশ বন্দিকে মুক্তি দিলেও সেই তালিকায় ফেনস্টারের নাম ছিল না।
চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী একাধিক গণমাধ্যমের নিবন্ধন বাতিল করেছে, ইন্টারনেট ও স্যাটেলাইট সম্প্রচারে বিধিনিষেধ দিয়েছে, কয়েক ডজন সাংবাদিককে আটক করেছে। এসবের মাধ্যমে সামরিক জান্তা সত্যকে চেপে রাখতে চাইছে বলে অভিযোগ মানবাধিকার সংস্থাগুলোর।
দোষী সাব্যস্ত হলে সন্ত্রাসবাদ আইনে তার সর্বোচ্চ ২০ এবং সরকার উৎখাত চেষ্টার দায়ে আরও ২০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে।
রয়টার্সকে পাঠানো এক লিখিত বার্তায় ফেনস্টারে ভাই ব্রায়ান বলেন, নতুন অভিযোগগুলো আমাদের হৃদয় ভেঙে দিয়েছে, যেমনটা ড্যানির বিরুদ্ধে আনা আগের অভিযোগগুলোর সময়ও হয়েছিল।
আটক মার্কিন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে নতুন দুই অভিযোগের বিষয়ে মন্তব্য জানতে মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন সামরিক পরিষদের এক মুখপাত্রকে ফোন দেওয়া হলেও তিনি তা ধরেননি বলে জানিয়েছে রয়টার্স।
তাৎক্ষণিকভাবে ইয়াঙ্গুনে মার্কিন দূতাবাসের কাছ থেকেও কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
এদিকে দুর্নীতির অভিযোগে স্থানীয় সময় গতকাল মঙ্গলবার মিয়ানমারের ক্ষমতাচ্যুত ও বন্দী নেত্রী অং সান সু চির দলের দুই সদস্যকে ৯০ ও ৭৫ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন দেশটির একটি আদালত। দণ্ডিত ওই নেতাদের আইনজীবী এসব তথ্য জানিয়েছেন।
গতকাল দেশটির কাইন প্রদেশের সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী থান নাইংকে দুর্নীতির ছয়টি অভিযোগে অভিযুক্ত করে প্রাদেশিক একটি আদালত তাকে ৯০ বছর সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দেন। তার আইনজীবী জাও মিন হ্ল্যাইং জানিয়েছেন, ৬টি অভিযোগের প্রতিটিতে ১৫ বছর করে মোট ৯০ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়।
হ্ল্যাইং বলেছেন, একই দিনে কাইন প্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ৬৭ বছর বয়সী নান খিন হতে মিইন্তকে মোট পাঁচটি অভিযোগে অভিযুক্ত করেন আদালত। প্রতিটি অভিযোগে ১৫ বছর করে তাকে মোট ৭৫ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। নান খিন হতে মিইন্ত অং সান সু চির দল এনএলডির শীর্ষস্থানীয় একজন নেতা।
চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারির সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকেই অরাজক পরিস্থিতি চলছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মিয়ানমারে।
মিয়ানমার সেনাবাহিনী ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর গণতন্ত্রের দাবিতে আন্দোলনে নামে দেশটির সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। এর পর থেকেই সহিংস ঘটনা ঘটছে দেশটিতে। দেশটির নিরাপত্তাবাহিনীর হাতে এখন পর্যন্ত প্রাণ গেছে অন্তত ১২শ জনের। আহত হয়েছেন আরও অনেকে। আটক করা হয়েছে বহু আন্দোলনকারীকে। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ধরপাকড়ের শিকার হয়েছেন সাংবাদিকরাও। রিপোর্টিং আসিয়ান নামের একটি পর্যবেক্ষণ সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে মিয়ানমারে অন্তত ৩৪ জন গণমাধ্যমকর্মী আটক আছেন।
এর প্রেক্ষিতে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে নিন্দার ঝড় বইতে থাকে। চাপ আসতে থাকে। সামরিক সরকারের নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অবরোধ দেয় যুক্তরাষ্ট্র। তার সঙ্গে সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে আসিয়ানের অবস্থান। তারা কার্যত আসিয়ান সম্মেলনে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার কোনো প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ না জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারণ, গত এপ্রিলে মিয়ানমার আসিয়ানে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সহিংসতা বন্ধে পদক্ষেপ নেয়া। মানবিক সহায়তা দেয়ার পথ উন্মুক্ত করা এবং বিরোধীদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করা। এর মধ্যে কোনোটিই বাস্তবায়ন করেনি সামরিক জান্তা।
এদিকে মিয়ানমারের মানবিক পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে বলে সতর্ক করেছেন জাতিসংঘের সাহায্যবিষয়ক প্রধান মার্টিন গ্রিফিথস। গত সোমবার সতর্ক করে গ্রিফিথস বলেন, মিয়ানমারে ক্রমবর্ধমান সংঘাত এবং পতনের মুখে থাকা অর্থনীতির কারণে ৩০ লাখ মানুষের জীবন রক্ষাকারী সহায়তার প্রয়োজন।
গ্রিফিথস বলেন, মানবাধিকারকর্মী ও প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসামরিক জনগণ ও অবকাঠামোর ওপর হামলা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে নিষিদ্ধ। এ ধরনের হামলা বন্ধ করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০৪০
আপনার মতামত জানানঃ