যোগী আদিত্যনাথের উত্তরপ্রদেশে স্থাপনা ও এলাকার মুসলিম নাম বদলে হিন্দু নাম রাখার ধুম পড়েছে। মোঘলসরাইয়ের নাম বদলে পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায় নগর করা হয়েছে। এলাহাবাদের নাম হয়েছে প্রয়াগরাজ। একইভাবে ফৈজাবাদ হয়েছে অযোধ্যা। সেই নামবদলের হিড়িকে এবার রাতারাতি বদলে দেওয়া হলো প্রায় দেড়শ’ বছরের পুরনো স্টেশনের নাম। সেখানে ঐতিহাসিক ফৈজাবাদ স্টেশন এখন থেকে পরিচিত হবে অযোধ্যা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন হিসেবে। উত্তর প্রদেশ সরকার সূত্রে খবর, মন্দিরের আদলে গড়ে তোলা হবে এই নয়া রেল স্টেশন।
রাম মন্দিরকে কেন্দ্র করে অযোধ্যায় পর্যটন শিল্পে জোয়ার আনতে চান মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। অযোধ্যার কাছাকাছি অবস্থিত ফৈজাবাদ রেলওয়ে জংশন। অযোধ্যার রাম মন্দিরকে কেন্দ্র করে যে পর্যটন শিল্পের বিকাশের পরিকল্পনা করা হয়েছে এই স্টেশনটিকেও তার শরিক করার চেষ্টা হচ্ছে। সেই জন্যই এই নাম বদলের সিদ্ধান্ত যোগী সরকারের।
ফৈজাবাদ নামটির সাথে জড়িয়ে রয়েছে ভারতীয় সংস্কৃতির ইতিহাস। রামায়ণে এই নামটি বহুবার উল্লেখিত হয়েছে। এছাড়াও এটি হিন্দু ধর্মের অন্যতম একটি পীঠস্থান বলা যেতে পারে। এছাড়াও এই স্থানটিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা পর্যটন কেন্দ্র এবং তীর্থক্ষেত্রে প্রতিবছর বহু মানুষের সমাগম হয়। এর সাথেই জড়িয়ে রয়েছে ভাটকুন্ডু এবং সরযূ নদীর ইতিহাস। আপাতত ফৈজাবাদ রেলস্টেশন এখন নতুন নামে পরিচিত হবে, অযোধ্যা ক্যান্টনমেন্ট নামেই চিনবে দেশবাসী।
তবে যোগী সরকারের এ সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত অনেকে। প্রশ্ন তুলছেন ইতিহাসবিদদের একাংশও। স্থানীয়রা বলছেন, মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে একটি বড় স্টেশন রয়েছে অযোধ্যা নামে। তাহলে একই নামে আরেকটি স্টেশন কেন? এতে শুধু বিভ্রান্তিই বাড়বে।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের খবর, একই নামে পাশাপাশি দুটি স্টেশন হওয়ার সমস্যা এরই মধ্যে টের পাওয়া যাচ্ছে। পর্যটকদের পাশাপাশি স্থানীয় অনেকেই অযোধ্যা স্টেশনের বদলে নেমে পড়ছেন ১০ কিলোমিটার দূরের অযোধ্যা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে।
উত্তর প্রদেশে গত সাড়ে চার বছরে একের পর এক মুসলিম এলাকা বা স্থাপনার নাম বদলে গেছে হিন্দু নামে। এলাহাবাদ, মুঘলসরাইয়ের নাম আগেই বদলানো হয়েছে। এখন রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন এগিয়ে আসছে, তার ওপর রাম মন্দির ইস্যু তো রয়েছেই। তাই ইতিহাসের অংশ ফৈজাবাদ স্টেশন পড়েছে নামবদলের যাঁতাকলে।
তবে যোগী সরকারের এ সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত অনেকে। প্রশ্ন তুলছেন ইতিহাসবিদদের একাংশও। স্থানীয়রা বলছেন, মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে একটি বড় স্টেশন রয়েছে অযোধ্যা নামে। তাহলে একই নামে আরেকটি স্টেশন কেন? এতে শুধু বিভ্রান্তিই বাড়বে।
বিরোধীদের অভিযোগ, মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে এই একটি কাজই খুব মন দিয়ে করেছেন যোগী আদিত্যনাথ। মেরুকরণের পালে হাওয়া দিতে রাজ্যে একের পর এক মুসলিম এলাকার নাম বদলাচ্ছেন তিনি।
ক্ষুব্ধ ইতিহাসবিদদের একাংশের বক্তব্য, শুধু ধর্মীর মেরুকরণে সুড়সুড়ি দিতেই নামবদলের এই উদ্যোগ। এতে জায়গাটির ইতিহাস ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু সেটি ক্ষতিকর। তাদের আশঙ্কা, এই ধারা অব্যাহত থাকলে হয়তো দ্রুতই রাজ্যের ইতিহাস বিজড়িত সব মুসলিম নামই বদলে দেওয়া হবে।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ঐতিহাসিক দলিল বা তথ্যকে উপেক্ষা করে যখন কেউ বা কারা ইতিহাস নিয়ে বুলি আওড়ান, তখন তাদের ‘বোধহীন’ অথবা ‘বিকৃতমনষ্ক’ বলে দাবি করতে হয়। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ বোধহীন নন। তিনি একজন রাজনীতিবিদ। অতীতে রাজনীতির ময়দানে তিনি বহু বিতর্কিত ঘটনা ঘটিয়েছেন। বহুবার বিতর্কের কেন্দ্রে উঠে এসেছেন এবং সেই বিতর্ক সামলেও নিয়েছেন। তিনি জানেন, রাজনীতির ময়দানে কীভাবে কোন দিকে বল বাড়িয়ে গোল করতে হয়।
তারা বলেন, তার রাজনীতি, রাজনৈতিক বোধের সঙ্গে কারো দ্বিমত থাকতেই পারে। গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোয় বিভিন্ন মতামত, বিভিন্ন কণ্ঠ থাকবে, সেই তো স্বাভাবিক। তিনি বা তার দল ইতিহাস নিয়েও আলোচনা করতে পারেন। সেই মত অনেকের সঙ্গে না-ই মিলতে পারে। কিন্তু তার ইতিহাসের ব্যাখ্যা যখন তথ্যবিকৃত হয়ে যায়, তখন তাকে প্রশ্ন করার, কাঠগড়ায় তোলার যথেষ্ট কারণ থাকে। আঙুল তুলে তাকে প্রশ্ন করতেই হয়— কেন এই মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছেন?
বিশ্লেষকরা বলেন, বলতে দ্বিধা নেই, যোগী আদিত্যনাথের ইতিহাসের যথেষ্ট জ্ঞান নেই। তা নিয়ে তিনি যে আজগুবি কথা বলছেন, তার পিছনে আবার একটি মস্ত চক্রান্ত রয়েছে। গৈরিক ঐতিহাসিকরা ভারতীয় ইতিহাস চর্চায় নতুন ব্যাখ্যার আমদানির চেষ্টা চালাচ্ছেন। তথ্যের উপর দাঁড়িয়ে সেই বিতর্ক হলে তর্ক করতে অসুবিধা নেই। কোনও কোনও ক্ষেত্রে তা হচ্ছেও। কিন্তু যোগী যে ইতিহাস বলছেন, তা বিতর্কেরও অযোগ্য। ভাবতে অবাক লাগে, তার পারিষদগণ, তার আধিকারিকরা মুখ্যমন্ত্রীকে ভুল ধরিয়ে দিতে পারেন না বা ভয় পান।
তারা বলেন, তিনি আসলে ঐতিহাসিক তথ্যকে বিকৃত করে রাজনীতি করার চেষ্টা করছেন। যোগীর রাজনীতিটা হচ্ছে হিন্দুত্বের রাজনীতি। তাই অতীতের অ-হিন্দু শাসন তার কাছে দাসত্ব ছাড়া আর কিছু নয়। সে জন্যই ইতিহাস বদলে দেয়ার চেষ্টা। এটা কট্টর মানসিকতাকে তুষ্ট করবে, তার প্রশাসনিক ব্যর্থতা থেকে নজর অন্যদিকে ঘোরাবে। হয়তো বা ভোট পেতেও ঢালাও সাহায্য করবে। তবে বলে রাখা ভালো, এক বা একাধিক ব্যক্তি শত চেষ্টা করলেও ইতিহাস বদলাবে না। ঐতিহাসিক দলিল আগুন দিয়েও পুড়িয়ে ফেলা যায়, কিন্তু সত্যকে আড়াল করা যায় না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৩৩
আপনার মতামত জানানঃ