ডিজেল ও কেরোসিন তেলের দাম বেড়েছে ২৩ শতাংশ, আর পরিবহন ভাড়া বেড়েছে ২৭ শতাংশ। এর ফলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) এবং প্রভাবশালী পরিবহনমালিকদের মুনাফা বাড়ল কয়েকগুণ। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে সাম্প্রতিক ধর্মঘট, মানুষের ভোগান্তি মূলত সরকার এবং পরিবহনমালিক ও ব্যবসায়ীদের ভাড়া বৃদ্ধিকে মেনে নিতে জনগণকে একপ্রকার বাধ্য করার উপায় মাত্র।
তবে গণপরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধির সিদ্ধান্তে তীব্র প্রতিক্রিয়া ও অসন্তোষ দেখা দিয়েছে যাত্রীদের মধ্যে। আজ সকালে সংবাদ সম্মেলন করে ‘যাত্রীবান্ধব ভাড়া’ পুনঃনির্ধারণের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। সংগঠনটির মহাসচিব মোঃ মোজাম্মেল হক চৌধুরী বর্ধিত ভাড়া প্রত্যাখ্যান করে একে ‘মালিকদের স্বার্থরক্ষার জন্য নির্ধারিত’ বলে অভিযোগ করেছেন।
ডিজেলে চলে মাত্র ৫ শতাংশ বাস
ঢাকা সিটির সবগুলো রুটেই ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। ভাড়া বাড়ানোয় যাত্রীদের মধ্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। যাত্রীরা বলছেন, তাদের আয় বাড়েনি, কিন্তু ভাড়া বেড়েছে, অন্যান্য খরচ বেড়েছে। এটি তাদের ওপর একটি বিশাল চাপ তৈরি করেছে।
সরকার বলেছে, সিএনজিচালিত পরিবহনের ভাড়া বাড়ানো হবে না। এখন যাত্রীরা বলছেন, কোন বাস ডিজেলচালিত না সিএনজিচালিত সেটি বাইরে থেকে দেখে প্রমাণ সম্ভব হয় না।
ফলে সরকারের উচিত এটি নিশ্চিত করে বাসে মার্ক করে দেয়া বা স্পষ্ট উল্লেখ করে দেয়া। অন্যদিকে বর্ধিত ভাড়ার কোন চার্টও এখনো বাসে বা টার্মিনালে দেয়া হয়নি, এটিও যাত্রীদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করেছে।
জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিতে, বেড়েছে বাস ভাড়া; সে কারণে ভাড়া বৃদ্ধির আওতায় সিএনজিচালিত বাস পড়বে না এটা স্বাভাবিক। তবে সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষের এমন নির্দেশনার পর মালিকরা বলছেন গ্যাসচালিত বাস এখন নেই৷ যদিও বিআরটিএ’র হিসাব অনুযায়ী, ঢাকায় ৯৫ শতাংশ বাসই সিএনজিচালিত৷
অবস্থার পরিপেক্ষিতে ভাড়া বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত শুধু ডিজেলচালিত যানের ক্ষেত্রেই কার্যকর হওয়া উচিত৷ গ্যাসচালিত (সিএনজি) বাসের ক্ষেত্রে আগের ভাড়াই বহাল থাকবে৷ অথচ এটা নিশ্চিত করার কোনো পদ্ধতি বা কৌশল নেয়ানি সরকার। এভাবেই অপরিকল্পিত সিদ্ধান্ত বারবার চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে সাধারণ মানুষের উপর।
পরিবহণ বিশ্লেষকরা বলছেন, মালিকরা সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে সরকারকে চাপে ফেলে বাস ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত আদায় করে নিয়েছে৷ এখন তারা ডিজেল আর গ্যাসচালিত দেখবে না৷ বরং সব বাসেই ভাড়া বাড়িয়ে দিবে৷ এ কারণেই তারা ডিজেল ও গ্যাসচালিত বাসে আলাদা স্টিকার লাগাতে রাজি না৷
বিআরটিএ’র হিসাব অনুযায়ী, ঢাকার ভেতরে মোট বাস ১২ হাজার ৫২৬টি৷ তার মধ্যে গ্যাসে চলে ১১ হজার ৯০০টি৷ ডিজেলে চলে ৬২৬টি৷
ঢাকা থেকে দূরপাল্লার বাস মোট ১৬ হাজার৷ তার মধ্যে গ্যাসে চলে ১১ হাজার ২০০৷ ডিজেলে চলে চার হাজার ৮০০৷ সারাদেশে মোট বাস ৭৮ হাজার৷ তার মধ্যে গ্যাসে চলে ৪৬ হাজার ৮০০টি৷ ডিজেলে চলে ৩১ হাজার ২০০টি৷
তবে পণ্যবাহী ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান সারাদেশে তিন লাখ ৫১ হাজার ৭৩টি; যার প্রায় সবই ডিজেলে চলে৷
এই হিসাব অনুযায়ী, ঢাকা শহরে ৯৫ শতাংশ বাসই গ্যাসে বা সিএনজিতে চলে৷ আর দূরপাল্লার বাসও গড়ে ৭০ ভাগের বেশি গ্যাসে চলে৷ তাই ভাড়া বাড়ানোর ঘোষণায় ঢাকা শহরে বাসের ভাড়া বাড়ার কথা না৷ আর দূরপাল্লায়ও অর্ধেকের বেশি বাসের ভাড়া বাড়ার কথা না৷ তবে বাস্তবে কি ঘটবে সেটা সবার জানা।
অর্থনৈতিক শোষণের পথ প্রশস্ত হলো
যখন বিশ্ববাজারে জ্বালানী তেলের দাম বেড়ে যায়, তখন সামান্য লাভ বা কিছুটা লোকসান হয়, এমন একটা দর সবসময় সরকার নির্ধারণ করে এসেছে। ব্যবসায়ীরা খুব একটা প্রতিবাদ করেন না।
কারণ, যখন বিশ্ববাজারে দাম কমে যায়, তখন সরকার উচ্চ দাম নির্ধারণ করে দেয়। ফলে ব্যবসায়ীরা আগের লোকসান কাটিয়ে ঠিকই বড় অঙ্কের লাভ করেন। এই নীতি চলে আসছে বছরের পর বছর ধরে।
কিন্তু এবার হঠাৎ সরকার ডিজেল আর কেরোসিন তেলের দাম লিটারপ্রতি ১৫ টাকা বাড়িয়ে দিল! জ্বালানি তেলের দর লিটারে ১৫ টাকা বাড়ানোর ইতিহাস আর নেই।
যেখানে গত সাত বছরে সরকার জ্বালানি তেল আমদানি করে ৪৩ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা লাভ করেছে। এই সাত বছরে বেশির ভাগ সময় প্রতি ব্যারেল জ্বালানি তেলের দাম ছিল ৫০ ডলারের নিচে। এর মধ্যে আবার এক বছর আগে তা শূন্যেও নেমে এসেছিল।
ফলে বিপিসির লাভ লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। কেননা এ সময় সরকার জ্বালানি তেলের দাম তেমন কমায়নি। শুধুমাত্র ২০১৬ সালে সামান্য কমানো হয়েছিল। যেমন ডিজেল ও কেরোসিনে দাম কমেছিল লিটারে মাত্র ৩ টাকা আর অকটেন ও পেট্রলে ১০ টাকা।
এখন আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে। রপ্তানিকারক দেশগুলো আগের লোকসান কাটাতে তেল উত্তোলনও কমিয়ে দিয়েছে। এ নিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচনার মধ্যেই জ্বালানি মন্ত্রণালয় হুট করে এক লাফে ১৫ টাকা করে দর বাড়িয়ে দিল। এতে কিন্তু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বিপিসির লাভ ঠিকই থাকবে, এক টাকাও লোকসান হবে না। পকেট উজাড় হবে শুধু সাধারণ মানুষের।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬৫৮
আপনার মতামত জানানঃ