গোটা বিশ্ব যখন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছে, সেই মুহূর্তে ইউরোপে বাড়ছে করোনার সংক্রমণ ও প্রাণহানি। এই বৃদ্ধির হার এতোটাই বেশি যে আগামী চার মাসে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সেখানে অন্তত আরও পাঁচ লাখ মানুষের প্রাণহানি হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ইউরোপীয় অঞ্চলের পরিচালক হ্যান্স ক্লুগে।
ক্লুগের মতে, অধিকাংশ দেশে সংক্রমণ ও মৃত্যু কমলেও, ইউরোপীয় অঞ্চলের ৫৩ দেশে এখনও কোভিডের সংক্রমণ অব্যাহত রয়েছে। ফেব্রুয়ারির মধ্যে করোনাভাইরাসের প্রকোপ আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফলে বাড়বে প্রাণহানির সংখ্যাও।
এমন পরিস্থিতিতে বৃহস্পতিবার (৪ নভেম্বর) এক সংবাদ সম্মেলনে ইউরোপে কোভিডের সংক্রমণ আশঙ্কাজনকভাবে বাড়তে থাকায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন ডব্লিউএইচও’র এই পরিচালক। তিনি করোনার ক্রমবর্ধমান পরিস্থিতি ‘গুরুতর’ ও ‘উদ্বেগজনক’ জানান।
প্রসঙ্গত, ডব্লিউএইচও তাদের এই বিপদজনক তালিকায় ইউরোপের ৫৩টি দেশের পাশাপাশি মধ্য এশিয়ার কয়েকটি দেশকেও রেখেছে। ওই সম্মেলনে হ্যান্স ক্লুগে বলেন, আগামী সপ্তাহগুলোতে করোনাভাইরাস মহামারি পুনরুত্থানের প্রকৃত হুমকিতে আছে ইউরোপের ৫৩টি দেশ এবং মধ্য এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলো। দেশগুলো ইতোমধ্যে সংক্রমণের নতুন ঢেউয়ের সম্মুখীন হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, ইউরোপের পরিস্থিতি নিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ। সংক্রমণের যে গতি, তাতে ধারণা করা হচ্ছে, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির মধ্যেই প্রাণহানির সংখ্যা আরও ৫ লাখ বাড়বে।
উল্লেখ্য, এর আগে চলতি বছরের এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ইউরোপে করোনা সংক্রমণে মৃত্যুর সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়েছিল। এই তথ্যের উপর বিত্তি করে বলা যায়, সম্প্রতি ইউরোপের ৫৩টি দেশে সংক্রমণ যে গতিতে বাড়তে শুরু করেছে, তা না কমলে ফের বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী।
এই পরিস্থিতিতে ডব্লিউএইচও’র পরামর্শ কী? সূত্র মতে, হু-য়ের মতে টিকা প্রয়োগের গতির কথা না ভেবে সংক্রমক রোগের ক্ষেত্রে যা যা করা উচিত, সেই অনুযায়ী করোনাবিধি তৈরি করার প্রয়োজন। ক্লগে বলেন, ‘যেসব দেশে টিকা দেওয়ার হার কম, সেখানে হাসপাতালে ভর্তির হার বেশি। পরীক্ষা, শনাক্ত, শারীরিক দূরত্ব এবং মাস্ক ব্যবহারের মতো পদক্ষেপগুলো এখনও ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অংশ।’
বার্তাসংস্থা এপি জানিয়েছে, উদ্বেগের পারদ চড়িয়ে গত ৬ সপ্তাহ ধরে ইউরোপের দেশগুলোতে প্রতিদিন করোনায় নতুন সংক্রমণের সংখ্যা বাড়ছে এবং ধারাবাহিকভাবে গত ৭ সপ্তাহ ধরে প্রতিদিনই বেড়েই চলেছে প্রাণহানির সংখ্যা।
পর্যাপ্ত টিকাকরণের ব্যর্থতা
যদিও মহামারি করোনার ধাক্কা সামলাতে চলে এসেছে টিকা। ভাবা হয়েছিল, টিকাকরণের ফলে করোনা বিদায় নেবে পৃথিবী থেকে। তবে এখনও বিশ্বের প্রায় সব দেশেই কমবেশি মৃত্যু হচ্ছে। করোনার নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্টের কাছে বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো এখনো বিপর্যস্ত।
পৃথিবীজুড়ে টিকা কার্যক্রম চললেও সংক্রমণ ও মৃত্যু থামছেই না। করোনায় এ পর্যন্ত বিশ্বে ৫০ লাখের বেশি মানুষ মারা গেছেন। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান থেকে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হয়। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশসহ বিশ্বের ২২৩টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে কোভিড-১৯।
এর মধ্যেই সম্প্রতি মাসগুলোতে ইউরোপ মহাদেশে করোনা প্রতিরোধী টিক নেওয়া বা দেওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ঠ ধীর গতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। স্পেনের প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ দুই ডোজ টিকা সম্পন্ন করেছে। তবে ফ্রান্স ও জার্মানিতে এই সংখ্যা যথাক্রমে ৬৮ এবং ৬৬ শতাংশ।
এছাড়া পূর্ব ইউরোপ এবং মধ্য ইউরোপের কিছু দেশে এই সংখ্যা আরও কম। এদিকে বিশ্ব পরাশক্তি রাশিয়া ২০২১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত নিজেদের মাত্র ৩২ শতাংশ নাগরিককে টিকার আওতায় আনতে সক্ষম হয়েছে।
হ্যান্স ক্লুগে অভিযোগ করে বলেন, জনস্বাস্থ্য নিয়ে এক ধরনের শিথিলতা ইউরোপ জুড়ে দেখা যাচ্ছে। এর ফলে ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ার ৫৩টি দেশ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এখন পর্যন্ত এই অঞ্চলে ডব্লিউএইচও ১৪ লাখ মানুষের মৃত্যু নথিভুক্ত করেছে।
সংস্থাটির কোভিড-১৯ বিষয়ক প্রধান মারিয়া ভ্যান কেরখোভ বলেন, ‘টিকা এবং সরঞ্জামের প্রচুর সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও গত চার সপ্তাহে ইউরোপজুড়ে করোনা সংক্রমণের হার ৫৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।’
ক্লুগে জানান, বিশ্ববাসী ফের মহামারি শুরু হওয়ার পয়েন্টে রয়েছে। এক বছর আগের মতো ইউরোপ আবারও মহামারির উৎসকেন্দ্রে পরিণত হতে চলেছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এই পরিস্থিতির জন্য তিনি যথেষ্ট পরিমাণ টিকা না থাকাকে দোষারোপ করেন।
ডব্লিউএইচও’র এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ইউরোপীয় দেশগুলোর স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ ভাইরাস সম্পর্কে আরও বেশি জানেন এবং এটি মোকাবিলা করার জন্য ভালো সরঞ্জামও রয়েছে। তবে কিছু এলাকায় প্রতিরোধ ব্যবস্থা শিথিল ও টিকা প্রয়োগের হার কম হওয়ায় উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে।
তার ভাষায়, গত সপ্তাহে করোনার নতুন সংক্রমণে ৫৩টি দেশে হাসপাতালে ভর্তির হার দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ক্লুজের আশঙ্কা, এভাবে যদি চলতেই থাকে তবে আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে ইউরোপ আরও ৫ লাখ মৃত্যু দেখতে পাবে।
বিধিনিষেধ উঠিয়ে দেওয়া
ডাব্লিউএইচও-র বক্তব্য, একদিকে টিকাকরণের গতি মন্থর, অন্যদিকে দেশগুলি জীবনযাপন কার্যত স্বাভাবিক করে দিয়েছে। দুইয়ের ফল চতুর্থ ঢেউ। মোট ৫৩টি দেশ নিয়ে ডাব্লিউএইচও-র ইউরোপীয় জোন। এর মধ্যে কয়েকটি মধ্য এশিয়ার দেশও আছে। সেখানেও পরিস্থিতি ভয়াবহ বলে জানানো হয়েছে। ডাব্লিউএইচও-র আশঙ্কা, পরিস্থিতি এভাবে চলতে থাকলে ফেব্রুয়ারির মধ্যে ৫ লাখ মানুষের মৃত্যু হতে পারে।
জার্মানিতে গত কয়েকদিনে কোভিড সংক্রমণ চোখে পড়ার মতো বেড়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় সেখানে আক্রান্ত হয়েছেন ৩৪ হাজার মানুষ। যুক্তরাজ্যে সংখ্যাটি ৩৭ হাজার। গত কিছুদিনে রাশিয়ায় আট হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ইউক্রেনে মারা গেছেন প্রায় দেড় হাজার মানুষ। ইউক্রেনে গত ২৪ ঘণ্টায় সংক্রমিত হয়েছেন ২৭ হাজার ৩৭৭ জন।
ডাব্লিউএইচও জানিয়েছে গোটা ইউরোপেই সংক্রমণের সংখ্যা ঊর্ধ্বমুখী। গত কয়েক সপ্তাহে সব মিলিয়ে ৫৫ শতাংশ সংক্রমণ বেড়েছে। এই পরিস্থিতিতে ফের লকডাউন হতে পারে বলেও মনে করছেন কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ। ডাব্লিউএইচও অবশ্য টিকাকরণে আরো গতি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১২৪২
আপনার মতামত জানানঃ