চলতি বছরের ১৫ আগস্ট আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল নিয়ন্ত্রণে নেয় তালিবান। এরপর তারা নতুন সরকার গঠন করলেও এখনো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলেনি। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে চরম আর্থিক সংকটে পড়েছে দেশটি। দেখা দিয়েছে চরম খাদ্য সংকট। এর নেতিবাচক প্রভাব থেকে রেহাই পাচ্ছে না কন্যাশিশুরাও। ফলে আফগানিস্তানে ক্রমশ বাড়ছে ‘শিশুবধূ’র সংখ্যা।
গোটা আফগানিস্তান এখন দুর্ভিক্ষের কবলে। কয়েক বছরের নজিরবিহীন খরায় সৃষ্টি হয়েছে এ দুর্ভিক্ষ। পরিবারের সদস্যদের দুবেলা দু’মুঠো খাবারের ব্যবস্থা করতে পারছে না পরিবারগুলো। খাবার কেনার জন্য নিজের সন্তান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে বাবা-মায়েরা। জাতিসংঘের মতে, তীব্র খরায় শুধু ২০১৮ সালেই ঘরবাড়ি ছেড়েছেন অন্তত ২ লাখ ৭৫ হাজার মানুষ। আফগানিস্তানের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি—অর্থাৎ ২ কোটি ২৮ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়তে যাচ্ছে।
এর মধ্যে তালিবান ক্ষমতায় আসার পর যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানের ৯৫০ কোটি ডলার জব্দ করেছে। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফসহ আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো সহায়তা বন্ধ করে দেওয়ায় ধীরে ধীরে দুর্ভিক্ষের দিকে এগোচ্ছে আফগানিস্তান।
খাদ্য সংকট কতটা চরমে পৌঁছালে একজন বাবা তার কন্যাসন্তানকে বিক্রি করতে বাধ্য হন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে একজন বাবার এছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। দেশে ভয়াবহ আর্থিক সংকট তৈরি হওয়ায় আফগানিস্তানের অনেক নাগরিককেই এখন এমন মর্মান্তিক বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
আফগানিস্তানের ছোট্ট শিশু পারওয়ানা মালিক। বয়স মাত্র ৯ বছর। ধূসর চোখ আর উজ্জ্বল চেহারার এই মেয়েটির দিন কেটে যায় বন্ধুদের সঙ্গে হেসে খেলেই। সে হয়তো বুঝতেই পারেনি কি ঘটতে চলেছে তার ভাগ্যে। খেলা ছেড়ে ঘরে ফিরতেই ঘোর অন্ধকার তার চোখেমুখে। নিমিষেই চাপা পড়ে যায় ছোট্ট মুখের হাসি। সে জানতে পারে এক বৃদ্ধের কাছে টাকার বিনিময়ে তার বাবা-মা বিয়ে ঠিক করেছে।
৯ বছরের এই শিশুটির বিয়ে হবে ৫৫ বছর বয়সী এক লোকের সঙ্গে। এমনটা ভাবাই যায় না। কিন্তু এমন ঘটনা ঘটছে বলে অভিযোগ আফগানিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বাদগিস প্রদেশের অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রের বিরুদ্ধে। এই কেন্দ্রে চার বছর ধরে বসবাস করছে পারওয়ানার পরিবার।
পারওয়ানাকে কিনে নেওয়া ওই লোকটি নিজের বয়স ৫৫ বছর দাবি করলেও শিশুটির চোখে সে ‘বুড়ো লোক’। তার চুল ও দাঁড়ি পেকে গেছে। তাকে লোকটি বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পর মারধর করবে বলেও ভয় পাচ্ছে সে। গত ২২ অক্টোবর সিএনএনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কথাগুলো বলছিল মেয়েটি।
কিন্তু পারওয়ানার বাবা-মার কাছে বিকল্প কোনো পথ নেই। কয়েক মাস আগেই তাদের ১২ বছর বয়সী আরেক কন্যাসন্তানেরও একই পরিণতি হয়েছে।
চার বছর ধরে আফগানিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বাদগিস প্রদেশে বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্য নির্মিত অস্থায়ী শিবিরে বাস করছে পারওয়ানার পরিবার। মানবিক সহায়তা ও অল্প রোজগারে নির্ভর করে বেঁচে আছে তারা। কিন্তু গত ১৫ আগস্ট তালিবান আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসার পর তাদের জীবন কঠিন হয়ে উঠেছে।
তালিবান আফগানিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে নেওয়ার পর আন্তর্জাতিক সহায়তা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে, ধসে পড়েছে দেশটির অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। এতে খাবারের মতো দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে পারছে না অনেকে। পারওয়ানা তার পরিবারে প্রথম নয়, কয়েক মাস আগে তার তিন বছরের বড় বোনকে বিক্রি করা হয়।
২৪ অক্টোবর পারওয়ানার ঘরে আসে কোরবান নামের ওই ‘বুড়ো’ লোক। ভেড়া, জমি ও অর্থ মিলিয়ে পারওয়ানার বাবাকে দুই লাখ আফগানি মুদ্রা দেন। এ অর্থ মাত্র ২ হাজার ২০০ মার্কিন ডলারের সমান। পারওয়ানার হাত ধরে দরজা পেরিয়ে চলে যায় কোরবান। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িতে বাড়ি ছেড়ে চলে যায় পারওয়ানা।
বাদগিসের পাশের ঘোর প্রদেশের ১০ বছরের শিশু মাগুল। প্রতিদিন সে কান্না করে। তার পরিবার ঋণ শোধ করতে ৭০ বছরের এক বৃদ্ধের কাছে তাকে বিক্রির কথা জানিয়েছে। পাশের গ্রামের একজনের কাছে দুই লাখ আফগানি ধার করেছিল তার পরিবার। কাজ বা সঞ্চয় না থাকায় ঋণ শোধের আর কোনো উপায় নেই।
পারওয়ানার বাবা আবদুল মালিক সিএনএকে জানান, তিনি রাতে ঘুমাতে পারেন না। লজ্জা, অপরাধবোধ আর দুশ্চিন্তায় মন ভেঙে যাচ্ছে তার। মেয়েকে বিক্রি না করার সব চেষ্টা তিনি করেছেন। অনেক জায়গায় কাজ খুঁজেও পাননি। আত্মীয়স্বজনের কাছে ধার করেছেন। তার স্ত্রী অন্যদের কাছে খাবার ভিক্ষা করেছেন।
এত কিছু করেও পরিবারের জন্য দুমুঠো খাবার জোগাতে পারছিলেন না আবদুল মালিক। পরিবারের জন্য খাবার জোগাতে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া তার আর কোনো উপায় ছিল না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের পরিবারের সদস্য আটজন। পরিবারের অন্যদের বাঁচাতে হলে (মেয়েকে) বিক্রি করতেই হতো।’
পারওয়ানার ক্রয়কে কোরবান ‘বিয়ে’ বলতে নারাজ। তিনি বলেন, ‘আমার স্ত্রী আছে। সেই পারওয়ানাকে দেখাশোনা করবে। পারওয়ানাকে সে নিজের সন্তানের মতোই দেখবে। পারওয়ানার বাবা গরিব, তার অর্থের প্রয়োজন। সে আমার বাসায় কাজ করবে। আমরা তাকে পেটাব না। সে আমাদের পরিবারের একজন হয়েই থাকবে।’
বাদগিসের পাশের ঘোর প্রদেশের ১০ বছরের শিশু মাগুল। প্রতিদিন সে কান্না করে। তার পরিবার ঋণ শোধ করতে ৭০ বছরের এক বৃদ্ধের কাছে তাকে বিক্রির কথা জানিয়েছে। পাশের গ্রামের একজনের কাছে দুই লাখ আফগানি ধার করেছিল তার পরিবার। কাজ বা সঞ্চয় না থাকায় ঋণ শোধের আর কোনো উপায় নেই।
এদিকে আফগানিস্তানের পার্বত্য হিন্দুকুশ অঞ্চলের ঘোর প্রদেশের এক বৃদ্ধা খাবার এবং দৈনন্দিন খরচ জোটাতে না পেরে দুই নাতনিকে বিক্রি করতে চেয়েছেন। রুহসানা সামিমি (৫৪) নামের এ বৃদ্ধার দুই নাতনির বয়স মাত্র চার ও ছয় বছর। জেনেত ও জিবা নামে দুই নাতনিকে বিক্রি করে ছেলের চিকিৎসা ও পরিবারের সদস্যদের জন্য খাবার জোটাতে চান সামিমি।
রুহসানা সামিমি জেনেতকে ২ লাখ আফগানি মুদ্রা (২২০০ মার্কিন ডলার) এবং জিবাকে ১ লাখ আফগানি মুদ্রায় (১১০০ মার্কিন ডলার) বিক্রি করতে চান বলে জানানো হয়েছে। সামিমি বলেন, গত দুই সপ্তাহ ধরে তাদের বিক্রির চেষ্টা করছেন তিনি; কিন্তু এখন পর্যন্ত একজন ক্রেতাও আসেনি তাদের কিনতে। তাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটি হলো সামিমির ছেলে। তিনি দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ থাকায় পরিবারটি এখন পথে এসে দাঁড়িয়েছে। এদিকে টাকার অভাবে ধুঁকে ধুঁকে বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন তিনি।
চরম হতাশা নিয়ে রুহসানা সামিমি গণমাধ্যমকে জানান, পরিবার-পরিজন নিয়ে ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন তিনি। কিন্তু আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে সরকারি লোকজন কেউ তাদের এক মুঠো চাল বা খাবার দিয়ে সাহায্য করতে আসেনি। এ অবস্থায় নিজের নাতনিদের বিক্রি করা ছাড়া কোনো উপায় নেই তার কাছে।
মানবাধিকারকর্মী মোহাম্মদ নায়েম নাজেম বলেন, আফগানিস্তানে দিনের পর দিন কন্যা শিশুসন্তান বিক্রির ঘটনা বাড়ছে। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, খাদ্য ও কাজের অভাব এবং বিভিন্ন সংকটে থাকা পরিবারগুলো এমন সিদ্ধান্তকেই সঠিক বলে মনে করছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭২২
আপনার মতামত জানানঃ