জলবায়ু পরিবর্তনে দায়ি বিশ্বের ধনীদেশগুলোর মধ্যে চীন শীর্ষস্থানে। চীন প্রতিবছর যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ করে থাকে, এতে সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে। এদিকে চীনের বিরুদ্ধে উইঘুর মুসলিম নির্যাতনসহ নানা প্রকারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। এবার তাই চীনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে বিশ্বের অধিকারকর্মীরা। তাদের দাবি, জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় চীনের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার বিনিময়ে বেইজিংয়ের মানবাধিকারবিরোধী কর্মকাণ্ডকে যেন ক্ষমা না করা হয়। দ্য গার্ডিয়ানের খবর
আগামী সপ্তাহে ইতালির রোমে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে জি-২০ সম্মেলন। সম্মেলনে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই-এর যোগ দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে রোমে জড়ো হয়েছেন বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আসা আইনপ্রণেতারা।
জিনজিয়াংয়ে চীন সরকারের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কর্মসূচি পরিচালনা করায় এসব আইনপ্রণেতা ও অধিকারকর্মীদের অনেককেই চীন ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে তাইওয়ানের উপর নিজেদের প্রভাব জোরদার করার সবরকম হুঁশিয়ারি দিয়েছে চীন। এই মুহূর্তে ইউরোপ সফরে আছেন তাইওয়ানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোসেফ উ। ২০১৯ সালের পর এটিই তার প্রথম ইউরোপ সফর। ধারণা করা হয়েছিল, জি-২০ সম্মেলনেও উপস্থিত থাকবেন তিনি। কিন্তু চলমান উত্তেজনাময় পরিস্থিতিতে রোম তাকে ভিসা দিতে রাজি হবে না মনে করে তার সফরের ইতালি-অংশ বাতিল করা হয়।
এদিকে জি-২০ সম্মেলনে সরাসরি উপস্থিত থাকবেন না চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। তবে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ভিডিও কলের মাধ্যমে ভার্চুয়ালি এই সম্মেলনে যোগ দেবেন তিনি।
সম্প্রতি চীন-তাইওয়ান পুনরেকত্রীকরণের অঙ্গীকার করেছেন জিনপিং। তাইওয়ানের সীমানা ঘেঁষে সামরিক তৎপরতাও বৃদ্ধি করেছে বেইজিং।
চীন আক্রমণ করলে তাইওয়ানকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। কিন্তু আসন্ন কপ-২৬ জলবায়ু সম্মেলনে চীনের সহযোগিতা পেতে চাইলে সমালোচনার লাগাম কতদূর টেনে ধরতে হবে, তা নিয়ে দোটানায় রয়েছে পশ্চিমা দেশগুলো।
চীনা কূটনীতিকদের ভাষ্যে, চীনের মানবাধিকার-বিষয়ক কার্যক্রমের দিকে আঙুল তোলা হলে তা জলবায়ু সংকট নিরসনে দেশটির সিদ্ধান্তের ওপর প্রভাব ফেলবে।
জি-২০ সম্মেলন উপলক্ষে বিভিন্ন দেশের ২০০ জন সংসদ সদস্যকে নিয়ে রোমে উপস্থিত হয়েছে চীন-সম্পর্কিত আন্তঃসংসদীয় জোট (আইপ্যাক), যা নিঃসন্দেহে চীনকে ক্ষিপ্ত করার মতোই ঘটনা। তিব্বতের কেন্দ্রীয় প্রশাসনের সিকিয়ং পেনপা সারিং, হংকংয়ের অ্যাক্টিভিস্ট ও সাবেক রাজনীতিবিদ নাথান ল এবং উইঘুর শিল্পী ও অধিকারকর্মী রহিমা মাহমুতের সেখানে বক্তব্য রাখার কথা রয়েছে।
২০২০ সালে লিথুয়ানিয়ার সংসদ সদস্য দোভিলে সাকালিয়েনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে চীন। তিনি বলেন, ‘আমরা এখানে এসেছি গণপ্রজাতন্ত্রী চীন যেন জি-২০ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে। চীনকে এখানে অন্তর্ভুক্ত করা এবং একইসাথে উইঘুরদের ওপর গণহত্যা, হংকং ও তাইওয়ান ইস্যুকে তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করে ফায়দা লাভের চেষ্টা করাটা কত বড় ঝুঁকি, তা সম্মেলনের নেতৃবৃন্দের অবশ্যই বোঝা উচিত। যে রাষ্ট্র মানবাধিকার কর্মীদের ওপর নানা রকম নিষেধাজ্ঞা ও শাস্তি আরোপ করতে পারে এবং কঠোরতম জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি আরোপ করে, জলবায়ু সংকট নিরসনে তাদের ওপর ভরসা করাটা হবে বোকামি।’
‘আমরা এখানে এসেছি গণপ্রজাতন্ত্রী চীন যেন জি-২০ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে। চীনকে এখানে অন্তর্ভুক্ত করা এবং একইসাথে উইঘুরদের ওপর গণহত্যা, হংকং ও তাইওয়ান ইস্যুকে তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করে ফায়দা লাভের চেষ্টা করাটা কত বড় ঝুঁকি, তা সম্মেলনের নেতৃবৃন্দের অবশ্যই বোঝা উচিত।
সাবেক কনজারভেটিভ নেতা ইয়াইন ডানকান স্মিথ বলেন, “জি-২০-এর অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর কাছে আমাদের দাবি থাকবে, চীনের আগ্রাসনকে যেন তারা খোলামেলাভাবে সবার সামনে তুলে ধরে। অর্থনৈতিক প্রক্রিয়াকে বিনষ্ট করা, বৈশ্বিক বাণিজ্যনীতি উপেক্ষা করা, উইঘুরদের ওপর গণহত্যা চালানো, হংকং সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক চুক্তি লঙ্ঘন কিংবা তাইওয়ানে অনুপ্রবেশের চেষ্টা—চীনের এই সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সময় এসেছে।’
চীনের বিরুদ্ধে মানবাধিকারলঙ্ঘনের অভিযোগ নতুন নয়৷ মানবাধিকার রক্ষা তো করছেই না বরং তা নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যাতে কোনও হইচই না হয়, তারও ব্যবস্থা করছে চীন। ব্যবহার করছে তাদের আর্থিক শক্তি৷
মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলেছে, চীনে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে এবং সেই খবর নিয়ে আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় যাতে হইচই না হয়, সেটা নিজেদের আর্থিক ও কূটনৈতিক শক্তির সাহায্যে বন্ধও করছে বেজিং৷
তারা বিভিন্ন সময়ে জানিয়েছেন,’চীন অতি উচ্চ প্রযুক্তির দেশ এবং তাদের হাতে অত্যাধুনিক ইন্টারনেট নজরদারি ব্যবস্থা রয়েছে৷ এর সাহায্যেই তারা দেশের ভিতর যাবতীয় সমালোচনা বন্ধ করে দিচ্ছে। কোনও সমালোচনা হলেই সঙ্গে সঙ্গে তারা ধরে ফেলে ব্যবস্থা নিচ্ছে৷ দেশে ক্ষোভ যাতে না ছড়ায় তার ব্যবস্থা করা হচ্ছে৷ তারপর আন্তর্জাতিক সমালোচনাও বন্ধ করছে চীন, নিজের আর্থিক ও কূটনৈতিক শক্তির সাহায্যে৷’
উইঘুর মুসলিমদের চীন যেভাবে দমন করছে, তারপরই সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে যথেষ্ট হইচই হয়েছে৷ তার আগে ছাত্রদের বিক্ষোভ দমন করা নিয়েও একই অভিযোগ উঠেছে৷ কিন্তু এনজিওদের রিপোর্ট বলছে, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এর নেতৃত্বাধীন সরকার মানবাধিকার নিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে নিজেদের অস্তিত্বের সঙ্কট হিসাবে দেখে৷ কিন্তু তারা যেভাবে মানবাধিকারকে দমন করছে এবং আন্তর্জাতিক স্তরে সেই খবর আসতে দিচ্ছে না, তাতে দুনিয়া জুড়ে মানবাধিকার আন্দোলন সঙ্কটের মুখে পড়বেI
মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, ‘পরিস্থিতি এমন জায়গায় চলে যাচ্ছে, ভবিষ্যতে কেউই চীনে কী হচ্ছে, তার প্রকৃত রিপোর্ট পাবে না৷ ফলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মানবাধিকার রক্ষার ব্যবস্থাও আর কোনও ভাবে সরকারি দমনমূলক নীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করতে পারবে না৷ দেশের সমালোচকদের তারা স্তব্ধ করে দিয়েছে৷ এ বার বাকি দুনিয়াতেও তারা সেনসরশিপ চালু করতে চাইছে৷’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৪৬
আপনার মতামত জানানঃ