দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হামলার রেশ কাটিয়ে ওঠার আগেই রোববার রাত ১০টার দিকে রংপুরের পীরগঞ্জে অন্তত ৩টি গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের ঘর-বাড়িতে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। হিন্দু ধর্মাবলম্বী এক তরুণ ফেসবুকে একটি পোস্টে ‘ইসলাম বিদ্বেষী’ কমেন্ট করার কথিত অভিযোগে ২০টির অধিক ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ। এই ঘটনার পেছনে সরকার ও প্রশাসনের ব্যর্থতাকেই বড় করে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
স্থানীয়রা জানায়, রোববার দুপুরের দিকে মাঝিপাড়ার এক তরুণের নামে ফেসবুকে একটি আইডি থেকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ ওঠে। এরপর বিকেলে মাঝিপাড়ায় হামলা করে একদল দুর্বৃত্ত। হামলাকারীরা একটি মন্দিরসহ ৬৫টি বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। পরে রাতে তারা অন্তত ২০টি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুন নেভাতে পীরগঞ্জ ও মিঠাপুর ফায়ার ব্রিগেডের দুটি ইউনিট কাজ করে।
পীরগঞ্জ থানার ডিউটি অফিসার এএসআই মো. খাজিম রাত সোয়া একটার দিকে সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘ধর্ম অবমাননার অভিযোগে মাঝিপাড়ায় হামলা ও আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। আমরা ওই ফেসবুক আইডির বিষয়ে খতিয়ে দেখব। তবে পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে আছে।’
জেলার সহকারী পুলিশ সুপার মোঃ কামরুজ্জামান জানিয়েছেন, “ভালবাসার প্রস্তাব নামে একটি ফেসবুক আইডির প্রোফাইল ফটোতে কাবা শরীফের ছবি ছিল। সেখানে ওই কমেন্ট করা হয়। তবে এটা ফেক আইডি হবে বলে আমরা ধারণা করছি— নামেই বোঝা যায়। কিন্তু উত্তেজিত জনতা কিছু ঘরবাড়িতে আগুন দিয়েছে।”
সেখানে পুলিশ, বিজিবি ও র্যাবের সদস্য মোতায়েন রয়েছে। পরিস্থিতি এখন শান্ত রয়েছে বলে সকাল আটটার দিকে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন তিনি।
মাঝিপাড়ার এক বাসিন্দা বলেন, ‘আমার বাড়ির সব জিনিসপত্র লুট হয়ে গেছে। আমার তিনটি গরু মারা গেছে আগুনে। পুলিশ এসেছে কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।’
আজ সোমবার সকাল সাড়ে ১১টায় একটি সরকারি সংস্থার কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এ ঘটনায় মোট ৬৬টি পরিবার আক্রান্ত হয়েছে। ৭টি টিনের বাড়ি, ৯টি ইটের তৈরি বাড়ি, ৪টি মাটির ঘর, ২টি দোকানসহ প্রায় ২৫টি বাড়ি ও দোকান আগুনে পুড়েছে।
১৩ই অক্টোবর দুর্গাপূজার অষ্টমীর দিন কুমিল্লা শহরে একটি পূজা মণ্ডপে কোরআন পাওয়ার পর সেখানে পূজা মণ্ডপে হামলা হয়। এরপর টানা তিনদিন নোয়াখালী, ঢাকা, কিশোরগঞ্জ, চাঁদপুর, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পূজা মণ্ডপ ও মন্দিরে হামলার ঘটনা ঘটে। পীরগঞ্জের আগে সর্বশেষ শনিবার ফেনীতে সংঘর্ষ হয়েছে। তিনদিনে অন্তত ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে।
বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তিনদিনে ৭০টি পূজামণ্ডপে হামলা-ভাঙচুর-লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।
আজ সোমবার সকাল সাড়ে ১১টায় একটি সরকারি সংস্থার কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এ ঘটনায় মোট ৬৬টি পরিবার আক্রান্ত হয়েছে। ৭টি টিনের বাড়ি, ৯টি ইটের তৈরি বাড়ি, ৪টি মাটির ঘর, ২টি দোকানসহ প্রায় ২৫টি বাড়ি ও দোকান আগুনে পুড়েছে।
১০ জেলায় ২৮ মামলায় আসামি সাড়ে ৯ হাজার
কুমিল্লার ঘটনার জের ধরে গত বুধবার থেকে দেশের ১০ জেলায় পূজামণ্ডপ, মন্দিরসহ হিন্দুদের বাসাবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব হামলার ঘটনায় ২৮টি মামলায় অজ্ঞাতসহ ৯ হাজার ৫২৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। মামলায় এ পর্যন্ত ২২৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের মধ্যে অধিকাংশই আওয়ামী লীগের। এছাড়া জামায়াত-বিএনপির কয়েকজন নেতাও আছেন।
ফেনী, নোয়াখালী, চাঁদপুর, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, লক্ষ্মীপুর, সিলেট, কুড়িগ্রাম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও গাজীপুর জেলায় দেশের শীর্ষস্থানীয় এক পত্রিকার প্রতিনিধিরা খোঁজ নিয়ে থানা-পুলিশ সূত্রে এসব তথ্য পেয়েছেন।
গত শনিবার সন্ধ্যায় ফেনী শহরে হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে ফেনী মডেল থানায় পৃথক দুটি মামলা করে। একটি মামলায় ২০০-২৫০ জন এবং অপর মামলায় ১০০-১৫০ জন অজ্ঞাত ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।
ফেনী মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মনির হোসেন জানান, পৃথক দুটি মামলায় প্রায় ৪০০ অজ্ঞাত ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। রোববার বিকেল পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে আসামি চিহ্নিত করার কাজ শুরু হয়েছে।
নোয়াখালীর হাতিয়ায় মন্দির ও বসতঘরে দুই দিন ধরে চলা হামলা-ভাঙচুরের ঘটনায় থানায় গতকাল রোববার দুপুর পর্যন্ত মামলা হয়েছে ছয়টি। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ১ হাজার ২৯৩ জনকে।
আসামির তালিকায় আওয়ামী লীগের স্থানীয় একাধিক নেতার অনুসারী ছাড়াও জামায়াত-শিবিরের সমর্থকদের নাম রয়েছে। একাধিক মামলার বাদী অভিযোগ করেছেন, হামলাকারী হিসেবে তারা যাদের নাম দিয়েছেন, তাদের নাম এজাহারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের দেওয়া নামই মামলায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এসব মামলায় এ পর্যন্ত ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
জানতে চাইলে হাতিয়া থানার ওসি আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, বাদীরা লিখিত অভিযোগ থানায় জমা দিয়েছেন। বাদীর দেওয়া অভিযোগই মামলা হিসেবে রেকর্ড করা হয়েছে।
চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে গত বুধবার রাতে বিভিন্ন স্থানে হামলার ঘটনায় পৃথক তিনটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আটজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ২ হাজার ৯৫০ জনকে আসামি করা হয়। পুলিশ বুধবার রাতে সাতজন ও শনিবার রাতে আটজনকে গ্রেপ্তার দেখায়।
চট্টগ্রাম নগর ও জেলায় পূজামণ্ডপে হামলা ও তোরণ ভাঙচুরের ঘটনায় পৃথক চারটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ১৫০ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতপরিচয় ১ হাজার ৩০০ জনকে আসামি করা হয়।
সিলেট নগরের দুটি পূজামণ্ডপে গত শুক্রবার দুপুরে হামলার ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে ৪২ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ২০০-২৫০ জনকে আসামি করে মামলা করেছে। এ ঘটনায় পুলিশ শনিবার দিবাগত রাতে ১২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। মামলার বাদী জালালাবাদ থানার এসআই কাজী জামাল।
সিলেটের জকিগঞ্জের কালীগঞ্জ বাজারে বুধবার রাতে স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর এবং হামলার ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে অজ্ঞাত ৪০০-৫০০ জনকে আসামি করে মামলা করেছিল। পুলিশ তিনজনকে ওই মামলায় গ্রেপ্তার করে। ওই মামলায় গতকাল ভোরে কালীগঞ্জ বাজার এলাকা থেকে আরও তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
কুড়িগ্রামের উলিপুরে তিনটি মন্দিরে ভাঙচুর ও দুটি মন্দিরে আগুন দেওয়া হয়। হামলায় আরও তিনটি মন্দির আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মন্দিরে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় ২০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বৃহস্পতিবারই তাদের আদালতের মাধ্যমে কুড়িগ্রাম কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য
বিশেষজ্ঞরা বলেন, আওয়ামী লীগ নেতারা তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর এই হামলার দায় চাপাতে চাইছেন। তাদের দাবি, সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে বিএনপি ও উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তি এই ঘটনা ঘটিয়েছে। তাহলে সোজাসাপটা প্রশ্ন করতে হয়, হামলা রুখতে আপনারা কি করেছিলেন? জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে কিংবা নয়াপল্টনে বিএনপির অফিসের সামনে কয়েক শ লোকের সমাবেশ হলে কয়েক হাজার পুলিশ মোতায়েন করা হয়। আর কুমিল্লা, গাজীপুর, নোয়াখালী, ফেনীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দুর্বৃত্তরা কীভাবে লঙ্কাকাণ্ড ঘটাল? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিংবা গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা কী করছিলেন?
তারা বলেন, সরকারবিরোধী দলকে ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করতে পারে আর সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ও মন্দির মণ্ডপে যারা হামলা করেছে, তাদের খুঁজে পায় না, এ কথা কি বিশ্বাসযোগ্য? সরকারি দলের নেতারা এখন ভিডিও ফুটেজ দেখে মিছিলকারীদের ধরবেন বলে জানিয়েছেন। কিন্তু তারা পূজামণ্ডপগুলোতে কেন সিসিটিভি বসালেন না? সিসিটিভি বসালে ধরা পড়ত নানুয়া দিঘির পাড়ের পূজামণ্ডপে কে অঘটন ঘটিয়েছে? ওই মন্দিরে কয়েক ঘণ্টা বিদ্যুৎ বন্ধ ছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন। কারা বিদ্যুৎ বন্ধ করেছিল?
আরও বলেন, কুমিল্লার ঘটনা দেশের অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যকে ম্লান করেছে। সরকার সঠিক পদক্ষেপ নিলে কুমিল্লা ও চৌমুহনীতে প্রাণহানি ও সহিংসতা হতো না। রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য সরকারের মদদেই দেশের বিভিন্ন স্থানে এসব ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন তারা ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৪৬
আপনার মতামত জানানঃ