উত্তপ্ত জম্মু-কাশ্মীর। গত ছয়দিনে ভারতের কেন্দ্রশাসিত জম্মু-কাশ্মিরে স্বাধীনতাকামীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে গিয়ে দেশটির অন্তত ৯ সেনা নিহত হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে অঞ্চলটিতে সন্ত্রাস বিরোধী অভিযান জোরদার করেছে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী।
জনসাধারণের নিরাপত্তার অজুহাতে জম্মু ও কাশ্মীরে বেড়েছে নির্যাতন। গ্রেপ্তার করা হচ্ছে শত শত যুবককে। আর এতে বেড়েছে যোদ্ধাদের প্রতিরোধ।
প্রসঙ্গত, জম্মু-কাশ্মিরে পুঞ্চ জেলায় গত ৪৮ ঘণ্টায় সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান চালানো হয়। শনিবার সন্ধ্যায় পুঞ্চ জেলা থেকে নিখোঁজ দুই সেনা সদস্যের লাশ উদ্ধার করেছে ভারতীয় সেনাবাহিনী।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার দিকে জম্মু-কাশ্মীরের পুঞ্চ জেলায় সন্ত্রাসীদের সঙ্গে ভয়াবহ বন্দুকযুদ্ধের সময় নিখোঁজ হওয়া একজন জুনিয়র কমিশন্ড অফিসারসহ (জেসিও) দুই সেনা সদস্যের লাশ উদ্ধার করেছে সামরিক বাহিনী। পুঞ্চের বনাঞ্চলে সামরিক বাহিনীর অভিযান পরিচালনার সময় ওই দুই সেনা সদস্য নিখোঁজ থাকার ৪৮ ঘণ্টা পর তাদের লাশ উদ্ধার করে সেনাবাহিনী। সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীরা গভীর বনাঞ্চলে পালিয়ে গেছে।
গত সোমবার থেকে পুঞ্চ জেলায় ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের গোলাগুলি চলছে, এতে এ পর্যন্ত নয় ভারতীয় সৈন্য নিহত হয়েছে।
দেশটির সেনাবাহিনী এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার পুঞ্চ জেলায় সেনাবাহিনীর সদস্যরা সন্ত্রাসীদের ব্যাপক গুলিবর্ষণের কবলে পড়ার পর থেকে নিখোঁজ ছিলেন ওই জেসিও ও অন্য সেনা সদস্য। একই এলাকায় অভিযানের সময় পাঁচ সেনা সদস্য নিহত হওয়ার চারদিন পর পুঞ্চ-রাজৌরির বনাঞ্চলে যোগাম্বর সিং এবং বিক্রম সিং নেগি নামে আরও দুই সেনার প্রাণহানি ঘটে।
এর আগে গত সোমবার ডেরা কি গালি এলাকায় চিরুনি অভিযান শুরু করে ভারতের সামরিক বাহিনী। অভিযানে বিদ্রোহীদের সঙ্গে গোলাগুলিতে সামরিক বাহিনীর একজন জেসিওসহ মোট পাঁচ সেনাসদস্য নিহত হয়। এ ঘটনার পর ওই এলাকায় সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করা হয়। তারপর থেকেই ওই এলাকায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর অন্যতম দীর্ঘ সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান চলছে।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তা বলেছেন, বৃহস্পতিবার সামরিক বাহিনীর সদস্যরা আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে ওই জেসিওর সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। জনসাধারণের নিরাপত্তা বিবেচনা পুঞ্চ-জম্মু মহাসড়ক বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকেই বন্ধ রয়েছে।
বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন বৃদ্ধি
কাশ্মীরে ভারতীয় সেনাদের নির্যাতনের শুরু মূলত ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট কাশ্মীরকে বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া অনুচ্ছেদ ৩৭০ বিলোপ করার মাধ্যমে। এরপর থেকে তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরে কার্যত বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা হয় কাশ্মীরকে। ওই সময় ভারত শাসিত কাশ্মীরের নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে স্থানীয়দের মারধর এবং নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে। সেখানকার একাধিক গ্রামবাসীরা জানান, তাদেরকে বৈদ্যুতিক ক্যাবল ও লাঠি দিয়ে মারা হয়েছে এবং বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়েছে।
ওই সময়ে প্রকাশিত বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, একটি গ্রামের দুজন বাসিন্দা। যারা সম্পর্কে দুই ভাই। তারা সাংবাদিকদের বলেন ঐ দিন সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাদের বাড়ি থেকে জোর করে বের করে নিয়ে যায়। এরপর আরো কয়েকজন গ্রামবাসীর সঙ্গে তাদের দাঁড় করায়। অন্যান্যদের মত ঐ দুই ভাইও নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করতে চায়নি।
দুই ভাইয়ের একজন জানান, ‘সেনাবাহিনীর সদস্যরা আমাদের ব্যাপক মারধর করে। আমরা তাদের জিজ্ঞাসা করি- আমরা কী করেছি? কিন্তু তারা আমাদের কোনো কথাই শোনেনি, কিছু বলেওনি, তারা আমাদের মারতেই থাকে।’
‘আমার শরীরের প্রতিটি অংশে তারা আঘাত করে। তারা আমাদের লাথি দেয়। লাঠি ও তার দিয়ে মারে, বৈদ্যুতিক শকও দেয়। নির্যাতনের একপর্যায়ে যখন আমরা অজ্ঞান হয়ে যাই তখন বৈদ্যুতিক শক দিয়ে আমাদের জ্ঞান ফিরিয়ে আনে।’
গ্রামের আরেকজন তরুণ জানান, সেনা সদস্যরা তাকে বারবার চাপ দিতে থাকে যে, কিশোর ও তরুণদের মধ্যে কে কে সড়কে পাথর ছুঁড়ে মেরেছে তাদের নাম বলতে। তখন সেনা সদস্যদের ঐ তরুণ বলেন, তিনি তাদের নাম জানেন না। তারপর সেনা সদস্যরা তার চশমা, জুতা ও কাপড় খুলতে নির্দেশ দেন।
তরুণ বলেন, ‘আমার গায়ের কাপড় খোলার পর তারা আমাকে লোহার রড ও লাঠি দিয়ে নির্মমভাবে পেটায়। প্রায় দুই ঘণ্টা পেটায়। যখনই অজ্ঞান হয়ে যেতাম, তারা বৈদ্যুতিক শক দিতো আমার জ্ঞান ফেরানোর জন্য। আমি তাদের বলেছি, আমাদের এভাবে মেরো না, বরং গুলি করে মেরে ফেলো।’
এই তরুণ বলেন, ‘সেনারা যদি আবারো আমার সঙ্গে এরকম করে, তাহলে আমি যে কোনোভাবে এর প্রতিরোধ করবো। প্রয়োজনে অস্ত্র হাতে তুলে নেবো।’
নির্যাতনের শিকার আরেকজন জানান, অন্তত ১৫-১৬ জন সেনা সদস্য তাকে মাটিতে ফেলে রড, লাঠি দিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন করে। তিনি বলেন, ‘এরকম অবস্থা যদি চলতে থাকে তাহলে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হবো আমি। তারা আমাদের এমনভাবে মারে যেন আমরা মানুষ না, পশু।’
স্থানীয়রাই এখন হাতে অস্ত্র তুলে নিচ্ছে
প্রসঙ্গত, ভারতের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এরকম নির্যাতনের কথা আরো অনেক কাশ্মীরী বলেছেন। ফলে দেখা গেছে, এসব নির্যাতনের কারণে কাশ্মীরে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রতি সমর্থন দিন দিন বাড়ছে। স্থানীয়রাই এখন বেশি অস্ত্র তুলে নিচ্ছে। ভারত সরকার কাশ্মীর এলাকার আংশিক-স্বায়ত্তশাসনের সাংবিধানিক অধিকার বিলোপ করার পর স্থানীয় বিচ্ছিন্নতাকামীদের মৃত্যুর হারও খুব বেশি বেড়ে গেছে বলে মৃত্যুর পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে।
গত কয়েক মাসে সশস্ত্র বাহিনী এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে বন্দুক যুদ্ধের ঘটনা খুবই বেড়েছে। জম্মু ও কাশ্মীরে এ ধরনের লড়াইয়ে এবছরের জানুয়ারি মাস থেকে আগস্ট পর্যন্ত প্রায় ৯০জন সন্দেহভাজন জঙ্গীর মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে ৮২ জনই স্থানীয় জঙ্গী এবং এদের মধ্যে এমনকি ১৪ বছর বয়সীরাও আছে। খবরে জানা গেছে নিহতদের মধ্যে কেউ কেউ বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীতে যোগ দিয়েছিল মৃত্যুর মাত্র তিনদিন আগে।
পিটিআই সংবাদ সংস্থার এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে জম্মু ও কাশ্মীরে ২০৩ জন বিচ্ছিন্নতাবাদীকে হত্যা করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ১৬৬ জনই স্থানীয়। ২০১৯ সালে হত্যা করা হয় ১৫২ জন জঙ্গীকে, যাদের মধ্যে ১২০ জনই ছিল স্থানীয় কাশ্মীরি।
সূত্র মতে, কাশ্মীরে এই মুহূর্তে সক্রিয় জঙ্গীর সংখ্যা ২০০-এর বেশি। এদের মধ্যে প্রায় ৮০ জন বিদেশি এবং ১২০ জনের বেশি স্থানীয় কাশ্মীরি।
ভারতের ঊর্ধ্বতন একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেন, কাশ্মীরে সক্রিয় জঙ্গীদের তালিকায় এ বছর বিদেশি কোন জঙ্গীর যোগদানের নজির নেই। যেসব বিদেশি জঙ্গী সেখানে সক্রিয় রয়েছে, তারা আগে থেকেই সেখানে তৎপর বলে ধারণা করা হচ্ছে। বরং এখন প্রতিদিন স্থানীয়রা বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীতে যোগ দিচ্ছে। এবছর জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত প্রায় ৭৬ জন কাশ্মীরি হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে এবং এই সংখ্যা বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬২২
আপনার মতামত জানানঃ