পানির নিচের শহর আটলান্টিসের কথা আমরা গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের এক বইতে সম্ভবত প্রথম জানতে পারি। প্রযুক্তির উন্নতি ঘটার পর ডুবে থাকা এই শহরের খোঁজে বিভিন্ন সময়ে সমুদ্র এবং মহাসাগরে তল্লাশি চালানো হয়, তবুও আটলান্টিসের সন্ধান মেলেনি। তারপরই বিশেষজ্ঞরা মনে করতে শুরু করেন এটি সম্ভবত প্রখ্যাত গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের একটি কাল্পনিক চিন্তা ছিল। তবে আটলান্টিস নয়। এমন এক শহর ঠিকই আছে। তার নাম ‘শি চেং’ বা ‘লায়ন সিটি’।
শি চেং-কে অনেকে অবশ্য ‘প্রাচ্যের আটলান্টিস’ বলে থাকে। যদিও এটি খুব বেশি দিন আগে পানির তলায় চলে যায়নি। ঘটনাটি ঘটে আজ থেকে ৭১ বছর আগে। ঝাঁ চকচকে চোখ ধাঁধানো রাস্তা। একতলা-দোতলা বাড়ি, পাথর দিয়ে নির্মিত মন্দির; দেখতে হবে সাঁতার কেটে। অলিতে গলিতে সাঁতার কাটলে এখনও চোখে পড়ে ড্রাগনের কারুকার্য করা মূর্তি। সবই রয়েছে এই শহরে, শুধু মানুষের দেখা মেলে না। অনেক বছর আগে এক বিশেষ কারণে চিন সরকার পানিতে ডুবিয়ে দিয়েছিল এই গোটা শহরকে!
চিনের ঝেজিয়াং প্রদেশের অন্তর্গত ছিল শহরটি। জমজমাট শহরটি ঝেজিয়াংয়ের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কাজকর্মের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল সে সময়। যিশুখ্রিস্টের জন্মের কিছু বছর পর অর্থাৎ ২৫ থেকে ২০০ সাল পর্যন্ত পূর্বাঞ্চলীয় হান বংশ বর্তমান চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে রাজত্ব করত। এই আমলেই সম্ভবত শি চেং জনপদটি প্রথম গড়ে ওঠে। বর্তমান চীনের বাণিজ্য নগরী বলে পরিচিত সাংহাই থেকে শি চেং-এর দূরত্ব ২০০ কিলোমিটার।
বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্র থেকে যা জানা গিয়েছে তাতে এই জনপদটির আয়তন কমবেশি ৬০টি ফুটবল মাঠের সমান। স্থানীয় উয়ো-শি বা ফাইভ লায়ন পর্বতমালার নামানুসারেই জনপদটির নাম শি চেং বা লায়ন সিটি রাখা হয়েছে বলে অনেক ঐতিহাসিক করেন।
এরপর পানিবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ১৯৫৯ সালে বাঁধ নির্মাণের প্রয়োজন ছিল। চিন সরকার ঝেজিয়াং প্রদেশের শি চেং শহরের উপকণ্ঠে বাঁধ নির্মাণ করবে স্থির করে। পানিবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য হ্রদের প্রয়োজন। কিন্তু ঝেজিয়াঙে তেমন কোনও হ্রদ ছিল না। বাধ্য হয়ে কৃত্রিম ভাবে হ্রদ বানাতে শুরু করে চিন।
শি চেং শহরটি ছিল ফাইভ লায়ন পর্বতের পাদদেশে। শহরের চারদিক পাহাড় দিয়ে ঘেরা ছিল। তাই চিন সরকার সে সময় এই শহরটিকেই হ্রদে পরিণত করার মনস্থির করে। শহরের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া জিনান নদীকে কেন্দ্র করেই ওই হ্রদ বানানো হয়েছিল।
পানি ধরে রাখার জন্য বাঁধ নির্মাণ করে এবং ওই পর্বতের পাদদেশে পানি ভরে হ্রদ বানিয়ে ফেলে চিন। এই হ্রদের পানিতেই নিমজ্জিত হয়ে যায় গোটা শহর। ১৩০ ফুট পানির নীচে তলিয়ে যায় শহরটি।
কৃত্রিম ভাবে সৃষ্ট হ্রদটির নাম রাখা হয় কুইআনদাও হ্রদ। ৬২ বছর ধরে এ ভাবেই পানির তলায় ডুবে রয়েছে শহরটি। রাস্তাঘাট, মন্দির, ঘরবাড়ি সবই রয়েছে আগের মতোই। এই হ্রদের উপর নির্মিত বাঁধটির নাম দেওয়া হয় জিনান।
বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের সবুজ সঙ্কেত মেলার পর থেকেই ভাগ্য বদলাতে শুরু করেছিল শহরের বাসিন্দাদের। এক এক করে সকলকেই নিজের ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয়। শহর পুরোপুরি খালি করে দেওয়ার পর, সেখানে পানি ভরে দেওয়া হয়।
চারদিকে পাহাড়ে ঘেরা থাকায় শহরে পানি ভরে ফেলতেও সুবিধা হয়েছিল। হ্রদ তৈরি হওয়ার পর ওই পাহাড়গুলিই এক একটি দ্বীপে পরিণত হয়। দ্বীপগুলির আলাদা নামও রয়েছে।
কোনওটি পক্ষী দ্বীপ, কোনওটি বাঁদর দ্বীপ এবং কোনওটি সাপের দ্বীপ। একটি দ্বীপে গেলে নাকি আবার ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে যায়। হ্রদ জুড়ে ছোট-বড় মিলিয়ে এমন এক হাজারের বেশি দ্বীপ রয়েছে।
৫৭৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে রয়েছে হ্রদটি। তার মধ্যে মাত্র ৮৬ বর্গ কিলোমিটার অংশ জুড়ে রয়েছে দ্বীপগুলি। জিনান বাঁধই হল পানিবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য নির্মিত চিনের প্রথম বাঁধ।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭৪৩
আপনার মতামত জানানঃ