যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের সঙ্গে তালেবানের সিনিয়র নেতারা কাতারের রাজধানী দোহায় বৈঠক করেছেন। শনিবার দোহায় উভয় দলের প্রত্যক্ষ উপস্থিতিতে বৈঠকটি শুরু হয়। গত ১৫ আগস্ট আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলের যুক্তরাষ্ট্র-তালেবানের এটা প্রথম বৈঠক।
আল জাজিরার খবরে এই বৈঠককে ‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তালেবানের নতুন অধ্যায়’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে তালিবানের উত্থানে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততার পুরনো প্রশ্নটাও আবার সামনে আসছে। নতুন অধ্যায় নাকি শিয়ালে-শিয়ালে সন্ধি; তা হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই স্পষ্ট হবে বিশ্বের সামনে।
বৈঠকের বিষয়ে তালেবানের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি সাংবাদিকদের বলেন, বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আফগানিস্তানে মানবিক সহায়তাসহ ২০২০ সালের দোহা চুক্তির বাস্তবায়ন ফোকাস করা হয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আফগান প্রতিনিধিরা আফগানিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছিলেন। আর যুক্তরাষ্ট্র আফগান জনসাধারণকে করোনাভাইরাসের টিকা প্রদানের প্রস্তাব দিয়েছে।
বৈঠকের পর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন মুখপাত্র বলেন, তালেবানকে স্বীকৃতি দেওয়া নিয়ে বৈঠক হয়নি, বরং যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিদেশি নাগরিকদের নিরাপদে প্রস্থান, মানবাধিকার ও নারী অধিকার নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
কাতার থেকে আল জাজিরার সাংবাদিক নাতাসা ঘোনিম জানিয়েছেন, মার্কিন প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে তালেবান, নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতার বিষয়ে ফোকাস করেছে। তবে এই বৈঠক থেকে বড় ধরনের কোনো ঘোষণা আসার সম্ভাবনা কম বলেও মন্তব্য করেন এই সাংবাদিক।
কারণ হিসেবে তিনি বলেন, আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া এবং তালেবানের চাওয়ার মধ্যে বেশ পার্থক্য দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সব পক্ষকে নিয়ে সরকার গঠন করতে বললেও তালেবান সেটা করেনি। নারীদের প্রতি তালেবানের আচারণ নিয়েও যুক্তরাষ্ট্র অখুশি।
২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছে তার প্রধান শর্ত ছিল তালেবানকে আল-কায়েদা এবং আইএস এর মতো ‘সন্ত্রাসী’ গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। এবং আফগানিস্তানের মাটি ব্যবহার করে সন্ত্রাসীদেরকে আমেরিকা এবং তার মিত্রদের ওপর হামলা করতে দেওয়া যাবে না।
তালেবান বলেছে যে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী সহায়তা চায় না এবং তারা দেশের সীমানার বাইরে থেকে আফগান ভূখণ্ডে তথাকথিত ‘ওভার দ্য হরাইজন’ আক্রমণের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করেছে।
আল-জাজিরা টিভিকে উদ্ধৃত করে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, তালেবান প্রতিনিধিরা এ বৈঠকের সময় আফগানিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের ওপর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে বলেছেন।
রয়টার্সের রিপোর্টে আরো বলা হয়, আফগানিস্তান থেকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনী ও আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো চলে যাওয়ায় – দেশটি বিপুল পরিমাণ অনুদান থেকে বঞ্চিত হয়েছে যা থেকে তাদের ৭৫% সরকারি ব্যয়ের সংস্থান হতো।
বৈঠকের আগে যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, তালেবানের সঙ্গে আলোচনায় বসার অর্থ এই নয় যে তারা আফগানিস্তানে তালেবানের শাসনকে স্বীকৃতি দিচ্ছে।
তালেবানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এই বৈঠককে যুগান্তকারী হিসেবে দেখছেন অনেক বিশ্লেষক। তারা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরাশক্তিতে আলোচনার টেবিলে আনতে পারাই তালেবানের সবচেয়ে বড় কূটনৈতিক বিজয়। এখন আলোচনা ও দরকষাকষি করে বাকি বিজয়টুকু অর্জন করতে হবে তালেবানকে। আর যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য থাকবে রক্ষণশীল এই গোষ্ঠীকে হাতে রেখে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডগুলো বন্ধ করা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যা ঘটছে আফগানিস্তানে, তার অন্যতম কারণ যুক্তরাষ্ট্র। ভবিষ্যতে যা ঘটবে, তার দায়ও যুক্তরাষ্ট্রকেই নিতে হবে। কাতারে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করতে চেয়েছিল তালেবান। তখন আলোচনায় যায়নি যুক্তরাষ্ট্র। লক্ষ্য ছিল ওসামা বিন লাদেন। যুক্তরাষ্ট্র তালেবানে কাছ থেকে লাদেনকে চেয়েছিল। তাতে রাজি হয়নি তালেবানে। তাতেই যুদ্ধ বাঁধে।
যে যুদ্ধকে আফগানিস্তানের মুক্তির লড়াই হিসাবে তুলে ধরতে চেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু জর্জ বুশ বা বারাক ওবামা-কেউই আফগানিস্তানে রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টা করেননি। কোনও মুক্তিই তারা দিতে চাননি।
এরপর মহামারি আর যুদ্ধের খরচের কারণে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময়ে সেনা প্রত্যাহারের ধীর গতি হঠাৎ বেড়ে গেল জো বাইডেন আসার পর। যুক্তরাষ্ট্র সেনা ফিরল। কিন্তু ফিরল না আফগানদের ভাগ্য। তারা যে অন্ধকারে ছিলেন, সেখানেই পড়ে রইলেন। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পরিস্থিতির কোনও উন্নতি হল না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আফগানিস্তানের একটিও সরকার সঠিক ভাবে নির্বাচিত নয়। গনি সরকারও নয়। যুক্তরাষ্ট্র বাইরে থেকে শক্তি প্রয়োগ করে গনিকে প্রেসিডেন্টের আসনে বসিয়েছিল। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বিরূপ মনোভাব তৈরি হয়েছিল আফগানবাসীর। প্রশাসনের শীর্ষ স্তরের মানুষেরা তালেবানকে চাইতেন না ঠিকই। কিন্তু পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রকেও চাইতেন না।
তার কারণ, আফগানিস্তান জুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমাগত অত্যাচার। রেডক্রসের হাসপাতালও ধ্বংস হয়েছে আমেরিকার হামলায়। অনেক সাধারণ মানুষের মৃত্যু হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধংদেহী মনোভাবের কারণে। যে ঘটনাগুলি কখনওই সামনে আসেনি। এমনকি, আফগানিস্তানে ক্ষমতায় বসে থাকা সরকারও এই সমস্যাগুলিকে কখনও সমাধানের চেষ্টা করেনি। করবেই বা কী করে! কারণ ওদের হাত-পা বাঁধা। আমেরিকার টাকায় ওরা ক্ষমতায় বসে আছে। সেই ক্ষমতায় থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যাওয়া তো সম্ভব নয়। হামিদ কারজাই তার শাসনকালের শেষের দিকে বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। উল্টে তাকেই সরে যেতে হয়েছে।
এবার আবার ক্ষমতা দখল করেছে তালিবান। আর তাদের ক্ষমতা দখলের পথ পারতপক্ষে সহজ করে দেয়া যুক্তরাষ্ট্র হয়তো আবারও আফগানিস্তানের রাজনীতিতে প্রবেশের পথ খুঁজছে। এক্ষেত্রে তারা কিছু মরিয়াই হয়তো। কারণ আফগানিস্তানের উপর চীনের প্রভাব যত বাড়বে দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে অতটাই পিছিয়ে পড়বে যুক্তরাষ্ট্র।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪৩৪
আপনার মতামত জানানঃ