পৃথিবীর বুকে আয়তনে ক্ষুদ্র একটি রাষ্ট্র লেবানন। মাত্র ১০ হাজার ৪৫২ বর্গকিলোমিটার আয়তনের একটি দেশ। ক্ষুদ্র হলেও আন্তর্জাতিক স্বার্থান্বেষী মহলের কাছে ভূরাজনৈতিক বিবেচনায় দেশটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অতীতে নানা আগ্রাসন, বাইরের হস্তক্ষেপ ও দেড় দশকের গৃহযুদ্ধ অন্তত সেটাই প্রমাণ করে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে সংকটে থাকা দেশটি শনিবার বিদ্যুৎহীন অন্ধকারে পতিত হয়েছে। কেননা, জ্বালানি স্বল্পতার কারণে লেবাননের দুটি বৃহত্তম বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে। এক কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স এখবর জানিয়েছে।
আল জাহরানি ও দেইর আমর নামের স্টেশন দুটি পর্যাপ্ত ডিজেল এর অভাবে আপাতত বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না। আর এ কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহ ২০০ মেগাওয়াটের কম হয়ে গেছে।
এই বিদ্যূৎ-বিভ্রাট আরো কদিন স্থায়ী হতে পারে বলে বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছে একটি দায়িত্বশীল সূত্র।
সরকারি সূত্র জানায়, এই ব্ল্যাকআউট কয়েকদিন ধরে চলতে পারে। এতে দেশটির ৬০ লাখ মানুষ ভুক্তভোগী হবেন।
ইলেক্ট্রিসিটি ডু লিবানের তথ্য অনুসারে, জ্বালানি সংকটে বন্ধ হওয়া দুটি কেন্দ্র হলো ডেইর আম্মার ও জাহরানি। এই দুটি দেশটির ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ সরবরাহ করে।
আগস্টে রয়টার্স এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, লেবাননে রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ কোম্পানি বলেছে জ্বালানি সংকটের কারণে সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে টোটাল ব্ল্যাকআউট হতে পারে।
মারাত্মক জ্বালানি সংকট ও বিদ্যুৎহীন পরিস্থিতি অনেকটা পঙ্গু করে দিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ লেবাননকে। জ্বালানি ও বিদ্যুতের এমন সংকটের ফলে কিছু প্রতিষ্ঠান তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছে।
এক দশক ধরেই মারাত্মক বিদ্যুৎ সংকটে ভুগছে লেবানন। দেশব্যাপী দুর্নীতির ঊর্ধ্বগতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে এ সংকট আরো মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ভূমধ্যসাগরীয় দেশটিতে বর্তমানে প্রায় ৬০ লাখের বেশি মানুষের বসবাস। এর মধ্যে ১০ লাখ সিরীয় শরণার্থী আছে অনেকটা দেউলিয়া অবস্থায়।
এই ব্ল্যাকআউট কয়েকদিন ধরে চলতে পারে। এতে দেশটির ৬০ লাখ মানুষ ভুক্তভোগী হবেন।
সংশ্লিষ্ট অনেকেই জ্বালানি সংকটের জন্য বেশ কয়েকটি কারণকে দায়ী করেছেন। এরমধ্যে অন্যতম কারণ হিসেবে চোরাচালান, অতিরিক্ত মজুদ, নগদ অর্থের সংকট ও আমদানীকৃত জ্বালানির সঠিক সরবরাহ নিশ্চিতে সরকারের ব্যর্থতাকে দায়ী করা হচ্ছে।
দেশটির রাজনীতিবিদদের অদক্ষতা ও সিদ্ধান্তহীনতা সংকটকে আরো গভীরে ঠেলে দিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সংকট উত্তরণে নতুন সরকার গঠন নিয়ে সমন্বয়হীনতা ও আর্থিক সংকট থেকে পুনরুদ্ধারের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে আলোচনায় বসা নিয়ে সিদ্ধান্তে না আসতে পারার মতো পরিস্থিতি সংকটকে বাড়িয়ে তুলছে। এরই মধ্যে বৈরুতসহ দেশটির বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভকারীরা রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকটের প্রতিবাদে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে তারা।
এর আগে দেশটির জ্বালানিমন্ত্রী রেমন্ড গজার জানান, বর্তমানে লেবাননের প্রয়োজন তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। কিন্তু এর পরিবর্তে দেশটির বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা মাত্র ৭৫০ মেগাওয়াট। এক দশক ধরে বিভিন্ন বেসরকারি জেনারেটর মালিকরা এ ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তবে সম্প্রতি মারাত্মক জ্বালানি সংকটের ফলে তারাও বাড়তি এ বিদ্যুতের সরবরাহ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। অনেক হাসাপাতাল পর্যাপ্ত জ্বালানি সরবরাহ না পেলে শিগগিরই তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে হবে বলেও আগাম সতর্কবার্তা দিয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, লেবানন এমন একটি দেশ, যেখানে ৫৪ শতাংশ জনসাধারণ মুসলিম, ৪১ শতাংশ খ্রিষ্টান এবং ৫ শতাংশ দ্রুজ জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। রাষ্ট্রব্যবস্থায় ক্ষমতা বণ্টনে রাষ্ট্রপতি খ্রিষ্টান, প্রধানমন্ত্রী সুন্নি মুসলিম এবং স্পিকার শিয়া মুসলিম। অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে এখানে এমন একটি বহুপক্ষীয় ঐক্য তৈরি হয়েছে। এই ঐক্য ধরে রাখতে হলে লেবানিজদের ধৈর্য, ত্যাগ ও সহনশীলতার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটাতে হবে। দুর্নীতিবাজদের রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে যেমন হটাতে হবে, তেমনি ধর্মীয় ও জাতিগত ঐক্য রক্ষা করতে হবে। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রও মোকাবিলা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে লেবাননের জন্য সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে, সৎ ও বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী সন্ধান করা।
তারা বলেন, মধ্যপ্রাচ্যকে যেভাবে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রমূলক রাজনীতি তছনছ করে দিয়েছে, সে ক্ষেত্রে মুসলিম কোনো দেশ মনে হয় না, লেবাননকে নিরাপদ করতে পারে। কেননা মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় প্রতিটি দেশ আজ কোনো না কোনোভাবে ষড়যন্ত্র ও বিপর্যয়ের শিকার। লেবানিজ শাসকগোষ্ঠীর নিজেদের স্বার্থ কুক্ষিগত করার চেয়েও নিজ নিজ ধর্ম ও গোষ্ঠীগত স্বার্থের কথা ভাবতে হবে কিংবা জনগণকে তাদের সরকারকে সেটি ভাবতে বাধ্য করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০০৮
আপনার মতামত জানানঃ