পানামা জঙ্গলকে অভিবাসীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ পথ হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। পানামার জঙ্গলে চলতি বছর ৫০ জনের বেশি অভিবাসী মারা গেছেন। দেশটির জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পথে তারা মারা যায়। মধ্য আমেরিকার দেশটির কর্মকর্তারা এ তথ্য জানিয়েছে। বৃহস্পতিবার সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানায়।
খবরে বলা হয়েছে, এ পর্যন্ত ৫৩ অভিবাসন প্রত্যাশীর মৃত্যু নথিভুক্ত করেছে দ্য ইন্সটিটিউট অব ফরেনসিক মেডিসিন অব পানামা। এ ছাড়া গত সেপ্টেম্বরে জঙ্গলে দুই শিশুসহ ১০ ব্যক্তির মৃতদেহ পাওয়ার কথা জানায় পানামার অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়।
আগের বছরগুলোর তুলনায় এ বছর মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেশি। কারণ এর আগে দেশটির দারিয়েন গ্যাপ নামক জায়গা থেকে গড়ে ২০-৩০টি মরদেহ উদ্ধার করা হতো। জাতিসংঘ পানামা ও কলম্বিয়া সীমান্তের এ স্থানটিকে বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক পথ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
অভিবাসীরা দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলো থেকে প্রথমে মেক্সিকো সীমান্তে যায়। পরে সেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের চেষ্টা করে তারা। কিন্তু মেক্সিকো সীমান্তে যাওয়ার এ পথটি অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। পাড়ি দিতে হয় দীর্ঘ ভয়ঙ্কর জঙ্গল। যেখানে শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগই নয় অভিবাসীদের সম্মুখীন হতে হয় বিষধর সাপ, কঠিন ভূখণ্ড এবং বিপজ্জনক পানি পথের। এছাড়াও নিয়মিত ধর্ষণ এবং ডাকাতিরও শিকার হন তারা।
পানামা কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে কমপক্ষে ৭০ হাজার মানুষ বিপজ্জনক দারিয়ান গ্যাপ পাড়ি দিয়েছে। যা আগের পাঁচ বছরের সমান। পানামার অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় এ বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর দুই শিশুসহ ১০টি মরদেহ পাওয়া খবর জানিয়েছে।
করোনা মহামারির মাসগুলোতে এ পথ দিয়ে অভিবাসীদের গমন উল্লেখযোগ্য হারে কমলেও এখন আবার ধীরে ধীরে এ পথের ব্যবহার বাড়ছে।
প্রায়ই সংবাদ শিরোনাম হয় দালালের হাত ধরে ইতালি ও স্পেন প্রবেশের চেষ্টায় ভূমধ্যসাগরে ডুবে শত শত অভিবাসনপ্রত্যাশীর মৃত্যু। খবর আসে, আমেরিকায় যাওয়ার পথে বনে-জঙ্গলে দালালের অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন তারা। ইউরোপে ঢোকার আশায় বলকানের বরফঢাকা জঙ্গলে হাজারো মানুষ মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে অপেক্ষায় থাকার সংবাদও আসে। এ বছর ভূমধ্যসাগরে এক হাজারেরও বেশি অভিবাসীর মৃত্যু হয়েছে। জুলাই মাসে প্রায় ৬০ বাংলাদেশির মৃত্যু হয় নৌকা ডুবে। অনেকেই মনে করেন জলবায়ু পরিবর্তনই মূলত এই অভিবাসন প্রত্যাশার কারণ।
বাংলাদেশি শ্রমিকদের সমুদ্রপথে বৈধভাবে বিদেশ যাওয়ার সুযোগ নেই। দেশের আইন অনুযায়ী তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছাড়া তাদের আর কোনো বহির্গমন পথ নেই। প্রতারকচক্র সবকিছু জেনেও সাধারণ মানুষকে উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখিয়ে সমুদ্রপথে পাঠানোর নামে ঠেলে দিচ্ছে মৃত্যুর মুখে।
অবৈধভাবে সমুদ্রপথে যাত্রা করে স্বপ্নের দেশে নোঙ্গর করে না অনেক সমুদ্রযান। দালালদের খপ্পরে পড়ে অনেক মানুষের জীবন হয় বিপন্ন। টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিয়ে মাঝপথেই প্রতারকরা পালিয়ে গেছে, এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে।
অনেক ক্ষেত্রে আটকে রেখে পরিবারের সদস্যদের কাছে দাবি করা হয় মুক্তিপণ। মেটাতে না পারলে চলে অমানুষিক অত্যাচার। অনেককে বিক্রি করে দেয়া হয় দাসশ্রমিক হিসেবে।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর’র দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে ইউরোপে প্রবেশের তালিকায় শীর্ষে আছে বাংলাদেশ। ২১ জুলাই পর্যন্ত সমুদ্রপাড়ি দিয়েছে বিভিন্ন দেশের ৪১ হাজার ৭৭৭ জন। তাদের মধ্যে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার আছে বাংলাদেশি। গত ১০ জুনও ১৬৪ বাংলাদেশিকে তিউনিসিয়া উপকূল থেকে উদ্ধার করা হয়।
এর আগে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার সময় ১৮ মে ৩৬ জন, ২৭ ও ২৮ মে ২৪৩ বাংলাদেশিকে উদ্ধার করে তিউনিসিয়ার কোস্টগার্ড। এ বছর এভাবে মোট তিন হাজার ৩৩২ জন বাংলাদেশিকে উদ্ধার বা আটক করা হয়।
ইউএনএইচসিআর-এর তথ্যানুযায়ী, ২০১৪ থেকে এ বছরের জুন পর্যন্ত নানা দেশের ২২ লাখ ২৪ হাজার ২৪৫ জন মানুষ সাগরপথ পাড়ি দিয়ে ইউরোপে আসে। একই সময়ে এ পথে আসতে গিয়ে মারা গেছে ২১ হাজার ৭০৭ জন।
বিশ্লেষকরা বলেন, বাংলাদেশের সিলেটসহ কিছু জেলার মানুষের মধ্যে একটি বদ্ধমূল ধারণা আছে। সেটি হলো— আপনি যদি কোনোভাবে ইউরোপে যেতে পারেন, তাহলেই জীবনের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে যারা অবৈধভাবে ইউরোপে প্রবেশের জন্য রওয়ানা হন, তাদের অধিকাংশের বয়স ৩০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে এবং তাদের একটি বিপুল অংশ লিবিয়া থেকে নৌপথে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রবেশের চেষ্টা করেন
তারা বলেন, প্রতিবছর ইউরোপে যেসব বাংলাদেশি প্রবেশ করেন, তাদের প্রায় সবাই মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। ইউরোপে প্রবেশের জন্য প্রচুর টাকাপয়সা খরচ করতে হয় এবং পরিবার সেই টাকার যোগান দেয়। এ থেকে সহজেই ধারণা করা যায়, এই অনুপ্রবেশকারীদের প্রায় সবাই মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা। তারা এই বিষয়টিকে দেখছে একপ্রকার বিনিয়োগ হিসেবে। আগে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত পরিবার জমি বা বাড়ি নির্মাণের জন্য অর্থলগ্নি করতো, এখন তারা নতুন খাত হিসেবে ইউরোপ প্রবেশকে বেছে নিয়েছে। বাংলাদেশের নীতি নির্ধারকরা যদিও বরাবরই বলে আসছেন, দারিদ্র্যের কারণে এই প্রবণতা বাড়ছে এবং দেশে বিনিয়োগ ও উৎপাদন বাড়লে এটি কমে যাবে। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখছি, বাংলাদেশে অর্থনৈতিক তৎপরতা ও উন্নয়ন যেমন বাড়ছে, সেইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্রতিবছর ইউরোপে অবৈধ অনুপ্রবেশের হারও।
আরও বলেন, বাংলাদেশের মানুষদের সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতের সমন্বয় প্রয়োজন। পাশাপাশি, দালালদের ও ভুয়া রিক্রুটিং এজেন্সির সদস্যদের গ্রেপ্তার ও আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। পরস্পরকে দোষারোপ না করে ইউরোপ এবং বাংলাদেশ উভয়কেই এ বিষয়ে উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৪২
আপনার মতামত জানানঃ