মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে নানামুখি সংকট চলমান রয়েছে। দেশটিতে দারিদ্রতার পরিমাণ এতটাই যে, গত ২০ বছরের মধ্যে দেশটিতে এই পর্যায়ের দারিদ্র্য আর দেখা যায়নি। দেশটির এইসব নানামুখি সংকট দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াজুড়ে, এমনকি এর বাইরেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। আর এমন হলে তা বৃহৎ সংঘাতে রূপ নিতে পারে।
দারিদ্রতায় বিপর্যস্ত মিয়ানমার
মিয়ানমারে নিযুক্ত জাতিসংঘের শীর্ষ কর্মকর্তা বলেছেন, দেশটির জনগণ ‘এক মারাত্মক সংকটের’ মধ্যে জীবন কাটাচ্ছে। বৃহস্পতিবার তিনি বলেন, গত ২০ বছরের মধ্যে দেশটিতে এই পর্যায়ের দারিদ্র্য দেখা যায়নি।
জাতিসংঘ প্রতিনিধিদের এক ভার্চুয়াল ব্রিফিংয়ে অ্যান্ড্রু কিরকুড জানান, গত ১ ফেব্রুয়ারির অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারে সহায়তার প্রয়োজন পড়া মানুষের সংখ্যা তিনগুণ বেড়েছে। এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ কোটিতে। আর দুই কোটি জনগণ দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করে, যা দেশটির জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক।
ইয়াঙ্গুন থেকে যুক্ত হয়ে অ্যান্ড্রু কিরকুড বলেন, এই সংকটের কারণ হলো ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িক বিভাজন, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে সেনাবাহিনীর ক্ষমতাচ্যুত করা এবং করোনা মহামারি।
জাতিসংঘের মিয়ানমার দূত কিরকুড বলেন, গত ১ ফেব্রুয়ারির অভ্যুত্থানের পর জাতিসংঘের খাবার ও অর্থ সহায়তা ১৪ লাখের বেশি মানুষের কাছে পৌঁছেছে। মূলত প্রান্তিক এলাকায় এসব সহায়তা দেওয়া হলেও কয়েকটি শহর এবং আধা শহর এলাকাতেও এই সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
অ্যান্ড্রু কিরকুড বলেন, ‘আমরা জীবন রক্ষা করছি। একটা পার্থক্য গড়ছি। কিন্তু আমরা হতাশাগ্রস্তও যে এই সংখ্যা বাড়ছে না আর আমরা সেই তিন কোটি মানুষের সবার কাছে পৌঁছাতে পারছি না যাদের অবিলম্বে মানবিক সহায়তা প্রয়োজন।’
সহায়তা প্রদানে নানা চ্যালেঞ্জে পড়ার কথাও জানান জাতিসংঘের ভারপ্রাপ্ত মানবিক সহায়তা সমন্বয়ক অ্যান্ড্রু কিরকুড। তিনি বলেন, সড়ক অবরোধ, মহামারি নিষেধাজ্ঞা এবং সামগ্রিক নিরাপত্তাহীনতার কারণে সমস্যায় পড়ছেন তারা। মানবিক সহায়তা পৌঁছাতে সংশ্লিষ্ট সকলকে সহায়তা করার আহ্বান জানান তিনি।
এক মাসে মিয়ানমারের মুদ্রার দর কমেছে ৬০ শতাংশ
এক মাসে মিয়ানমারের মুদ্রার দর কমেছে ৬০ শতাংশ। আট মাস আগে সামরিক অভ্যুত্থান হয় দেশটিতে, আর এরপর তৈরি হওয়া মুদ্রাস্ফীতির কারণে দেশটিতে খাদ্য ও জ্বালানির মূল্য বেড়েছে কয়েক গুণ। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের মিয়ানমার বিশেষজ্ঞ রিচার্ড হর্সে বলেন, এটি জেনারেলদের হতবিহ্বল করবে। কারণ, তারা অর্থনীতির বিস্তৃত ব্যারোমিটার হিসাবে মিয়ানমারের মুদ্রার দর নিয়ে বেশ চিন্তিত এবং এটি তারই প্রতিফলন।
আগস্টে মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের বিপরীতে কিয়েট দরপতন শূন্য দশমিক ৮ শতাংশের মধ্যে বেঁধে রাখার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বিনিময় হার অনেক বেড়ে যাওয়ায় ১০ সেপ্টেম্বর সেই অবস্থান থেকে সরে আসে। ডলারের সংকট এতটাই তীব্র যে কিছু মুদ্রা ব্যবসায়ী তাদের প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এক মুদ্রা ব্যবসায়ী পোস্ট দিয়েছেন, ‘এখন থেকে মুদ্রার দামের অস্থিতিশীলতার কারণে…নর্দার্ন ব্রিজ এক্সচেঞ্জের সব সার্ভিস শাখা সাময়িকভাবে বন্ধ থাকবে।’
এখনো যারা তাদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন, তারা প্রতি ডলারের বিপরীতে ২ হাজার ৭০০ মিয়ানমারের মুদ্রা বা কিয়েট চাচ্ছেন। অথচ ১ সেপ্টেম্বরে এটি ছিল ১ হাজার ৬৯৫ কিয়েট। গত ১ ফেব্রুয়ারি যখন সেনাবাহিনী নোবেল বিজয়ী অং সান সু চির নেতৃত্বে গড়া গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে, তখন এটি ছিল ১ হাজার ৩৯৫ কিয়েট।
বিশ্বব্যাংক তাদের পূর্বাভাসে জানিয়েছে, এই বছর মিয়ানমারের অর্থনীতির ১৮ শতাংশ স্ফীতি হতে পারে। দেশটিতে বাড়বে বেকারত্ব এবং দরিদ্রদের সংখ্যা।
মিয়ানমার ব্যাংকের এক নির্বাহী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এটি সবচেয়ে ভয়াবহ রাজনৈতিক পরিস্থিতি। তাই মুদ্রার দরপতনও স্বাভাবিক।
এই বিষয়ে মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মন্তব্য জানা যায়নি। তবে বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ২০২০ সালের শেষের দিকে দেশটির রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৭.৬৮ বিলিয়ন ডলার। দরপতন ঠেকাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৬৫ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে। ১৩-২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তারা ১ হাজার ৭৫০ থেকে ১ হাজার ৭৫৫ কিয়েট দরে ডলার কিনেছে।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই উদ্যোগের প্রভাব ছিল খুব সামান্য। মুদ্রার বাজার নিয়ে মানুষের মনে আস্থা নেই।
অর্থনৈতিক সংকট পণ্য মূল্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। জাতিসংঘ বলেছে, মিয়ানমারে এখন প্রায় ৩০ লাখ মানুষের মানবিক সহায়তা প্রয়োজন, অভ্যুত্থানের আগে যা ছিল ১০ লাখ। এখন ৪৮ কেজির এক ব্যাগ চালের দাম ৪৮ হাজার কিয়েট, যা ফেব্রুয়ারি থেকে ৪০ শতাংশ বেশি। গ্যাসের দাম বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। এক লিটারের দাম ১ হাজার ৪৪৫ কিয়েট। এই সংকট ব্যবসা-বাণিজ্যেরও মারাত্মক ক্ষতি করছে, বিশেষত যারা কাঁচামাল আমদানি করেন।
মিয়ানমারের সংকট দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াজুড়ে, এমনকি এর বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে বৃহৎ সংঘাতে রূপ নিতে পারে বলে সতর্ক করেছেন জাতিসংঘপ্রধান আন্তোনিও গুতেরেস। এমন ‘বহুমুখী বিপর্যয়’ মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধভাবে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পদক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
দেশটির নানামুখি সংকটে ঝুঁকিতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া
মিয়ানমারের সংকট দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াজুড়ে, এমনকি এর বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে বৃহৎ সংঘাতে রূপ নিতে পারে বলে সতর্ক করেছেন জাতিসংঘপ্রধান আন্তোনিও গুতেরেস। এমন ‘বহুমুখী বিপর্যয়’ মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধভাবে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পদক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। বুধবার (২৯ সেপ্টেম্বর) জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে উপস্থাপিত এক প্রতিবেদনে এ আহ্বান জানান সংস্থাটির মহাসচিব।
গুতেরেস সতর্ক করে বলেছেন, মিয়ানমারে সেনাশাসন প্রতিরোধের সুযোগ ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসতে পারে। সেখানে গণতান্ত্রিক শাসন ফেরাতে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক দেশগুলোর সাহায্য জরুরি।
তিনি বলেন, মিয়ানমারের সাংবিধানিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা ও ২০২০ সালের নভেম্বরের নির্বাচনের ফলাফল বহাল অপরিহার্য। এটি আদায়ে প্রতিবেশী দেশগুলো মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, অং সান সু চি, প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টসহ অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তাদের অবিলম্বে মুক্তির জন্য আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক প্রচেষ্টা থাকতে হবে। এছাড়া রাখাইনে থেকে যাওয়া ছয় লাখ এবং ২০১৭ সালে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা সাত লক্ষাধিক রোহিঙ্গাসহ দুর্বল জনগোষ্ঠীর জন্য দ্রুততম সময়ে মানবিক সহায়তা প্রয়োজন।
সাধারণ নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ তুলে সু চির সরকারকে হটিয়ে গত ১ ফেব্রুয়ারি ক্ষমতা দখল করে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী। সঙ্গে সঙ্গেই এর প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসেন দেশটির সাধারণ মানুষ। শুরু হয় সংঘাত। এতে প্রাণ হারিয়েছেন এক হাজারের বেশি মানুষ।
মিয়ানমারের সংকট সমাধানে দক্ষিণপূর্ব এশীয় দেশগুলোর জোট আসিয়ানের পাঁচ দফা প্রস্তাবনায় সমর্থন জানিয়েছে জাতিসংঘ। ওই প্রস্তাবনার মধ্যে রয়েছে— মিয়ানমারে সহিংসতা বন্ধ, গঠনমূলক আলোচনা, মধ্যস্থতাকারী হিসেবে আসিয়ানের বিশেষ দূত নিয়োগ এবং মানবিক সহায়তা বৃদ্ধি।
গত আগস্টে ব্রুনাইয়ের দ্বিতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এরিওয়ান ইউসুফকে মধ্যস্থতাকারী দূত হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে আসিয়ান। এরই মধ্যে কাজও শুরু করেছেন তিনি। বুধবারের প্রতিবেদনে ইউসুফের নিয়োগকে স্বাগত জানিয়েছেন জাতিসংঘ প্রধান। অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেন, মিয়ানমার সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানে পাঁচ দফা প্রস্তাবনা সময়মতো বাস্তবায়ন জরুরি। এ বিষয়ে আসিয়ানকে জাতিসংঘের বিশেষ দূতের সঙ্গে কাজ করতেও উৎসাহিত করেন গুতেরেস।
নিজ দেশের জনগণের ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার করে দমনপীড়নের জন্য বিশ্বজুড়ে সমালোচিত হয়েছেন জান্তাপ্রধান হ্লাইং। পশ্চিমা দেশগুলো মিয়ানমারের সেনাসদস্য ও সেনাসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এরপরও কমেনি জান্তার দমনপীড়ন। পাল্টা-আক্রমণের পথ বেছে নিয়েছেন সেনাশাসনের বিরোধীরা। দেশটিতে প্রায় প্রতিদিনই দুই পক্ষের সংঘর্ষ চলছে। এর মধ্য দিয়ে মিয়ানমার দীর্ঘমেয়াদি গৃহযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা বিশ্লেষকদের।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭১৪
আপনার মতামত জানানঃ