কানাডায় ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে গির্জায় শিশুদের নির্যাতন ও হত্যার ঘটনায় আদিবাসীদের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন ক্যাথলিক গির্জার যাজকরা। আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
আল জাজিরার প্রতিবেদন অনুসারে, সরকার ও ধর্মবিষয়ক কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পরিচালিত এসব স্কুলে জোর করে আদিবাসী শিশুদের এনে রাখা হতো। পরে সেখানে শিশুদের শারীরিক, মানসিক নির্যাতনের পাশাপাশি যৌন হয়রানিও করা হতো। এভাবে নির্যাতনের মাধ্যমে কয়েকশ শিশুকে হত্যা করা হয়েছে।
কানাডিয়ান কনফারেন্স অব ক্যাথলিক বিশপস গতকাল শুক্রবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, আমরা স্বীকার করে নিচ্ছি ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের কিছু সদস্য ওই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন। এ ঘটনায় আমরা গভীরভাবে মর্মাহত ও দুঃখিত। দ্ব্যর্থহীনভাবে আমরা ক্ষমা চাচ্ছি।
কানাডার ক্যাথলিক গির্জায় শিশুদের গণকবরের সন্ধান পাওয়ার পর গত জুন মাসে পোপ ফ্রান্সিস এ হত্যাকাণ্ডের জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করলেও এখন পর্যন্ত ক্ষমা চাননি।
এর আগে চলতি বছরের মে মাসের ২৯ তারিখ প্রথম কানাডার একটি পরিত্যক্ত আবাসিক স্কুলে গণকবরের সন্ধান পাওয়া যায়। সেখানে পাওয়া যায় ২১৫টি শিশুর দেহাবশেষ।
ধারণা করা হয়, এরা আদিবাসী শিশু। ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় কামলুপস ইন্ডিয়ান রেসিডেনসিয়াল স্কুল নামের এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি ১৯৭৮ সালে বন্ধ হয়ে যায়।
কানাডার আবাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বাধ্যতামূলক বোর্ডিং স্কুল ছিল। ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে সরকার ও ধর্মবিষয়ক কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পরিচালিত এসব স্কুলে জোর করে আদিবাসী শিশুদের এনে রাখা হতো।
এ ধরনের স্কুলের মধ্যে কামলুপস ছিল সবচেয়ে বড় স্কুল। ১৮৮০ সালে রোমান ক্যাথলিক প্রশাসনের অধীনে এই স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫০ সালে স্কুলটিতে ৫০০ জনের মতো শিক্ষার্থী ছিল। কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৬৯ সালে স্কুলটির দায়িত্ব নিয়ে নেয়। ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত স্কুলটিকে তারা স্থানীয় শিক্ষার্থীদের আবাসন হিসেবে ব্যবহার করে।
স্কুলের ওপর পরিচালিত এক জরিপের সময় একটি টিম গ্রাউন্ড-পেনিট্রেটিং রাডারের (ভূপৃষ্ঠের নিচে কী আছে তা পরীক্ষা করে জানার যন্ত্র) সাহায্যে এই গণকবর আবিষ্কার হয়। অজ্ঞাত এসব শিশুর মৃত্যুর কারণ জানা যায়নি। তাদের মধ্যে কারও কারও বয়স তিন বছরের মতো।
এরপর জুলাই মাসে কানাডায় ফের দেড় শতাধিক গণকবরের সন্ধান মেলে। সম্প্রতি দেশটির পশ্চিম উপকূলে, কুপার দ্বীপের একটি পরিত্যাক্ত আদিবাসী আবাসিক স্কুল সংলগ্ন এলাকায় সম্প্রতি ১৬০ টি গণকবরের সন্ধান পাওয়া যায়।
কানাডার পশ্চিম উপকূলীয় এই দ্বীপটির অধিকাংশ বাসিন্দা দেশটির আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ান জাতির পেনেলাকুট গোত্রভুক্ত। দ্বীপের যে আবাসিক স্কুলের কাছে এই গণকবরসমূহের সন্ধান পাওয়া গেছে, সেটির নাম কুপার আইল্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কুল। ১৮৯০ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল স্কুলটি, প্রায় ৮৫ বছর চলার পর ১৯৭৫ সালে বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
ভয়াবহ ইতিহাস
পঞ্চদশ শতকে স্পেনীয় অভিযাত্রী ক্রিস্টোফার কলম্বাস যখন প্রথম ইউরোপীয় হিসেবে আমেরিকায় পৌঁছেছিলেন, তখন তিনি ভুলক্রমে ভেবেছিলেন যে ভারতে উপস্থিত হয়েছেন। সেখানকার স্থানীয় অধিবাসীদের তিনি অভিহিত করেছিলেন ‘ইন্ডিয়ান’ হিসেবে।
গায়ের রঙে লালচে ভাব থাকায় সেই থেকে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার স্থানীয় আদিবাসীদের ‘রেড ইন্ডিয়ান’ জাতি নামেই চিনে আসছে বিশ্ববাসী। তবে কানাডায় রেড ইন্ডিয়ানের পাশাপাশি ইনুইট ও মেটিজ জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরও বসবাস ছিল।
দেশটির ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, অষ্টাদশ শতকের শেষ থেকে উনবিংশ শতকের শুরুর দিকে যখন কানাডায় দলে দলে ইউরোপীয় বসতকাররা (সেটলার) আসতে থাকে তখন দেশটির স্থানীয় রেড ইন্ডিয়ান, ইনুইট ও মেটিজ জাতিগোষ্ঠীর গোত্রসমূহের সঙ্গে তাদের বেশ কয়েকটি সংঘাত হয়েছিল। ইউরোপীয় বসতকারদের হাতে উন্নত অস্ত্র ও প্রযুক্তি থাকায় সবগুলো সংঘাতেই শোচনীয় পরাজয় ঘটেছিল আদিবাসীদের।
পরাজিত আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর মানুষের একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে হত্যা করে মাটিচাপা দিয়েছিল বসতকাররা। বাকি যারা বেঁচে ছিলেন, তাদের খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষাদান ও ‘অধিকতর সভ্য’ করে তুলতে ১৮০০ সালের পর থেকে দেশটির প্রধান ক্যাথলিক গির্জার অধীনে কানাডাজুড়ে বিভিন্ন আবাসিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করা শুরু হয়।
দেশটির আদিবাসী বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সে সময় দেশটিতে ১৩৯ টি এ রকম আবাসিক স্কুল ছিল। কানাডার কেন্দ্রীয় ক্যাথলিক গির্জার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত এই স্কুলসমূহ পরিচালনা করতেন ক্যাথলিক খ্রিস্টান মিশনারিরা।
কয়েক লাখ আদিবাসী শিশুকে জোরপূর্বক তাদের বাবা-মা ও অভিভাবকদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ভর্তি করা হয়েছিল এসব স্কুলে। নিজেদের মাতৃভাষায় কথা বলা ও নিজেদের ধর্মবিশ্বাস চর্চা নিষিদ্ধ ছিল এই শিশুদের জন্য। তাদের সঙ্গে আচরণ করা হতো ক্রীতদাসের মতো এবং স্কুল শিক্ষক ও কর্তৃপক্ষের হাতে নিয়মিত শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া ছিল নিত্যদিনের ঘটনা।
পাশাপাশি আদিবাসীদের সংস্কৃতি ও জীবনযাপন নিয়ে কটাক্ষ ও ব্যাঙ্গ করাও ছিল সেই স্কুলগুলোর নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রমের অংশ। সহ্যের অতীত নির্যাতনের ফলে বহু শিশুর মৃত্যু হতো। তখন তাদেরকে মাটিচাপা দেওয়া হতো। এসব সমাধিই এখন গণকবর।
দেশটির আদিবাসী বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ১৮০০ সাল থেকে প্রতিষ্ঠা করা শুরু এসব স্কুল এবং সর্বশেষ স্কুলটি বন্ধ ঘোষণা করা হয় ১৯৯৬ সালে।
কানাডার কেন্দ্রীয় সরকার যদিও দেশের ইতিহাসের এই অন্ধকারচ্ছন্ন অধ্যায়ের জন্য ২০০৮ সালে আদিবাসীদের কাছে ক্ষমা চেয়েছে, কিন্তু এসব আবাসিক স্কুল পরিচালনার দায়িত্বে যে প্রতিষ্ঠানের হাতে ছিল, সেই প্রধান ক্যাথলিক চার্চের যাজকেরা এই প্রথম ক্ষমা চাইলেন।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৭১১
আপনার মতামত জানানঃ